‘আমার আছে কণ্ঠ, সেটাই দেশের জন্য উৎসর্গ করেছি’
২৬ মার্চ ২০২১ ১৫:৪৩
শাহীন সামাদ— ৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন কণ্ঠযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিসেনারা যেমন অস্ত্র দিয়ে দুর্নিবার গতিতে পাক সেনাদের পরাভূত করেন, ঠিক তেমনি শাহীন সামাদ যুদ্ধ করেছেন কণ্ঠ দিয়ে। কণ্ঠকে হাতিয়ার বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছিলেন গানে গানে। পাশাপাশি বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সদস্য হিসেবে ছুটে বেড়ান শরণার্থী শিবির থেকে রণাঙ্গনের নানা প্রান্তে। স্বাধীনবাংলা বেতারের কেন্দ্রের এই কণ্ঠ যোদ্ধা যুদ্ধদিনের নানা স্মৃতি তুলে ধরেছেন সারাবাংলার স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আশীষ সেনগুপ্তের সঙ্গে কথোপকথনে। জানালেন মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতিকথা…
সারাবাংলা: মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আপনার বয়স অনেক কম। এত অল্প বয়সে যে রাজনৈতিক চেতনা আপনার মাঝে জন্ম নেয় তার সূচনা কীভাবে? অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন কারা?
শাহীন সামাদ: ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকেই আমাদের লড়াই শুরু হয়ে যায়। আমি তখন ছায়ানটে। আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের কিংবদন্তীদের আনাগোনায় মুখর থাকতো ছায়ানট। পটুয়া কামরুল হাসান থেকে শুরু করে আলতাফ মাহমুদ, সুজেয় শ্যাম, অজিত রায়সহ অসংখ্য গুনীদের পদচারণায় ধন্য সেই সময়। বলা যায়, তাদের কাছ থেকেই অনুপ্রেরণাটা পাই। ছায়ানটে আমাদের রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল সংগীতের পাশাপাশি গণসংগীতও শেখানো হতো। গণঅভ্যুত্থানের সময় এই গানগুলো আমরা বিভিন্ন সমাবেশে গাইতাম। সেটা শহীদ মিনার থেকে শুরু করে পথে-ঘাটে যেখানেই হোক। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, দেশে যখনই কোন দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দেয়, তখন তার বিরুদ্ধে সবার আগে সাংস্কৃতিক অঙ্গনই সোচ্চার হয়। আমরা তখন যে গানগুলো গাইতাম সেসব গান মানুষের মনে প্রেরণা যোগাতো। আর এই গানগুলো গাইতে গাইতে আমার মধ্যেও কেমন জানি একটা তাগিদ অনুভব করতে থাকলাম। বলা যায়, ছায়ানটই আমার অনুপ্রেরণার প্রথম উৎস।
এরপর, ৭ই মার্চের সেই অমর ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ আমাদের মধ্যে অনুপ্রেরণা যোগালো। যখনই উনি বললেন, ‘যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’- তখনই যেন সাড়ে সাত কোটি জনতা এক হয়ে গেল। আমরা সবাই তখন এক মন, এক আত্মা, এক চিন্তা— সব, সবকিছুই এক। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সবাই তৈরি হলো স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য।
এরপর এলো ২৫শে মার্চের সেই ভয়াল কালরাত্রি। সেই রাতের কথা আমি এখনও ভুলতে পারি না। কখনও ভুলতে পারবোও না। যতদিন বেঁচে থাকবো এই দিনটার কথা মনে থাকবে। ওই দিনের গুলির বিদীর্ণ শব্দ এখনও আমার কানে বাজে। চারদিকে আগুন, ধোঁয়া, থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। আমরা সবাই ভেঙে পড়েছিলাম আগত দিনগুলোর কথা ভেবে। আমাদের বাসা তখন লালবাগ কেল্লার উল্টোদিকে। পরদিন যখন কারফিউ ভাঙল, আমার বড়ভাই বাইরে থেকে ঘুরে এসে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। অনেক পরে সে জানালো যে, চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ। সেই কী তাণ্ডব! পলাশী, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে পাকিস্তানি আর্মিদের নৃশংসতার চিহ্ন চারিদিকে। আমি সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। মার্চ মাসে মাত্র কয়েকটা ক্লাস করেছি। আমাদের বিভাগের অধ্যাপক জি সি দেব স্যারকেও মেরে ফেলেছে শুনে কেঁদে ভাসালাম। দৌড়ে ছাদে গিয়ে দেখি, চারিদেকে শুধু কালো ধোঁয়া আর কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে।
সারাবাংলা: তারপর তো যুদ্ধে গেলেন। কণ্ঠকে হাতিয়ার করে শুরু করলেন স্বাধীনতা সংগ্রাম। সেই গল্পটা শুনতে চাই…
শাহীন সামাদ: আমার বেড়ে ওঠা বেশ সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে। গানবাজনার চর্চা হলেও লেখাপড়াটাকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হত আমাদের বাড়ি। একটা নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাত্রার মধ্য দিয়েই বড় হয়েছি। আমি ছিলাম পরিবারের সবচেয়ে ছোট। বাবাকে হারিয়েছি সেই ১৩ বছর বয়সে। তারপর থেকেই আম্মার আমাকে নিয়েই ভয়। কারণ আমি ছায়ানটের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় গান গেয়ে বেড়াতাম। তখন কয়েকটা পত্রিকায় আমার গান গাওয়ার ছবিও প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর থেকেই আম্মার শুধুই আতঙ্ক, না জানি আমার উপর কোন বিপদ আসে। আমাকে সবসময় পাহারায় রাখা হতো। কিন্তু আমি যে ভেতরে ভেতরে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি যে, আমি যুদ্ধে যাবোই, সেটা কাউকে বুঝতেই দিইনি। আমি তো আর বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করতে পারবো না, আমার কণ্ঠ আছে, সেটাকেই আমি দেশের জন্য উৎসর্গ করতে পারি। গান ভীষণ শক্তিশালি একটা মাধ্যম। গান দিয়েই আমি যুদ্ধ করবো। আর সাথে ৭ই মার্চের ভাষণ তো আছেই। আমার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেল।
ঠিক করলাম কিছু একটা করবই। কিন্তু বাসা থেকে বের হবো কীভাবে। আম্মা তো সারাক্ষনই আমাকে চোখে চোখে রাখছেন। তাঁর চোখকে ফাঁকি দিই কি করে। আমার কলেজের ইংরেজির শিক্ষক- জাকিয়া খাতুনের সঙ্গে আমার বন্ধুর মতো সম্পর্ক। আম্মাও ওনাকে খুবই পছন্দ করতেন। উনি বাসায় এলে আম্মা আর আমাকে পাহারায় রাখতেন না। এরমধ্যে উনি একদিন বাসায় এলে, আমি তাকে আমার মনের ইচ্ছেটা জানালাম। কথাটা শুনেই ভয় পেলেন জাকিয়া আপা। বললেন, চারিদিকে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি। এই অবস্থায় কীভাবে সম্ভব? তিনি আমাকে নিরুৎসাহিত করলেন।
‘৭১-এর মে মাসের শেষ দিকটায়। তখনও পালাবার কোন পথ পাচ্ছিনা। আমাদের বাসার নীচতলায় এক ভাড়াটিয়া থাকতেন। ১২ বছর ধরে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক। তাদের একটাই ছেলে- সুজা। আমি তাকে ধরলাম। বললাম আমার ইচ্ছেটার কথা। শুনেই সে বাধা দিল। প্রথমেই না। তাকে অনেক করে বুঝালাম। এক পর্যায়ে সে রাজি হলো। বললো, সে নীচের মেইন দরজাটা খুলে রাখবে। আর সেটা যেন কেউ জানতে না পারে। আমি তো খুশি। যোগাযোগ করলাম জাকিয়া আপার সাথে। জানালাম আমার প্ল্যানিং। এরপর সেই রাতেই সবাই যখন ঘুমে, আমি এক কাপড়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
লালবাগে একটা গলি আছে, যেটা দিয়ে আজিমপুর যাওয়া যায়। আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল, আজিমপুরে ওই গলির মুখে জাকিয়া আপা দাঁড়িয়ে থাকবেন। রাত তখন ১২টা। চারিদিকে ব্ল্যাকআউট, ঘুটঘুটে অন্ধকার। ওর মধ্যেই আমি পায়ে হেঁটে আজিমপুর পৌছালাম। জাকিয়া আপা দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওই রাতেই আপা আমাকে নিয়ে সোজা মগবাজার কাজী অফিসে এলেন। আমার বিয়ে হল। আম্মাকে জানানো হলো। আম্মা তো হাউমাউ করে কান্না। কিভাবে কি হলো। আম্মা তো মানতেই পারছেন না। আমাকে ফিরে আসার জন্য বোঝালেন। আজ বুঝি, আম্মাকে কত কষ্টই না আমি দিয়েছি। তখনও তো মা হই নি। এখন যখন আমিও একজন মা, বুঝি মা হওয়া কতটা কষ্টের, কতটা ভালোবাসার। মা আসলে কি, অনেক দেরিতে বুঝলাম।
মা যতই বোঝানোর চেষ্টা করলেন না কেন, আমার একটাই কথা- ‘দেশের কাজেই যখন বেরিয়েছি, কাজ শেষ না করে আর ফিরছিনা। আমি ভারতে যাচ্ছি, আমার জন্য দোয়া করো।’ বিয়ের পর তিন দিন ছিলাম ঢাকায়, এক বন্ধুর বাসায়। ভারত পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। আমার জন্য বোরকা কেন হল। সবারই চিন্তা একে আমি অতি মাত্রায় চঞ্চল, তার উপর বোরখা পরার অভ্যাস নাই। সবাই বোঝালো যে, যাওয়ার পথে কোথাও যেন ভুলেও মুখ থেকে নিকাব না সরাই।
মে-জুনের প্রচণ্ড গরম। ওর মধ্যেই বোরখা পরে রওনা হলাম। কুমিল্লার চান্দিনা হয়ে বর্ডার পার করবো। বাসে গরমে হাপিয়ে যাচ্ছি, তারপরও বোরখা সরাচ্ছিনা। এদিকে চান্দিনা থানার কিছুটা আগে হঠাৎই আমাদের বাস থেমে গেল। শুনলাম পাকিস্তানি আর্মিরা রাস্তা আটকে চেক করছে। কয়েকটা আর্মি বাসে উঠে এলো। আমি তো ভয়ে অস্থির। সবার ব্যাগ-সুটকেস যা আছে, সবগুলো খুলে চেক করতে লাগলো। ওদের ধারণা, গাড়িতে মুক্তিফৌজ আছে। আমাদের সৌভাগ্য যে, কারো ব্যাগেই ওদের কাছে সন্দেহজনক মনে হয়, এমন কিছুই ছিলনা। আমাদের যেতে দিল।
চান্দিনায় গিয়ে দেখলাম আমাদের জন্য একজন রিকশাওয়ালা অপেক্ষা করছেন, যিনি মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ডারের ওপারে পৌঁছে দেন। একটা মেঠোপথ দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। আমি মুগ্ধ হয়ে গ্রাম দেখছি। কারণ এর আগে আমার এভাবে কখনোই গ্রাম দেখা হয়নি। এ তো আমারই গ্রাম, আমারই দেশ। রিকশাওয়ালাটা আমাদের জন্য শসা নিয়ে খেতে দিলেন। আর মুক্তিযোদ্ধাদের পারাপারের গল্প শোনাচ্ছেন। মেইন রোডে কিছুদূর যেতেই একটা আর্মি পিক-আপ আমাদের পথ আটকালো। দুজন সৈন্য এগিয়ে এসে জানতে চাইল, কোথায় যাচ্ছি আমরা। বেনু সাথে সাথেই বলল, ‘শ্বশুরাল’। এরমধ্যে একজন আমার মুখের কাপড় সরাতে যাবে, ঠিক তখনই অন্য সৈনিকটা বলল, ‘ছোড়দো’। বেঁচে গেলাম। এখনও ভাবি, সেদিন যদি ধরা পড়তাম, আজ হয়ত মানুষ আমাকে আর জানতেই পারতো না। বা আমার পরিচয়টা অন্যভাবেই হতো।
বিকেল নাগাদ আগরতলা পৌঁছালাম। ওখানে একটা ক্যাম্প ছিল। সেখানে তিনদিন থাকলাম। এ দেশ থেকে অনেকেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন মানুষের সাথে সখ্যতা হলো। নারীপুরুষ আলাদা আলাদা ক্যাম্প। আমাদের বিয়েটা তো ছিল নামে মাত্র। সে এক জায়গায়, আমি আরেক জায়গায়। ক্যাম্পে একটা পাটিতে ঘুমাতাম, কোন বালিশও ছিলনা। কলাপাতায় খিচুড়ি আর বেগুন ভাজি, তৃপ্তি নিয়ে খেতাম। কোন কষ্ট অনুভব করিনি। কারণ তখন মনের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা- কখন কলকাতা পৌঁছাব, কখন দেশের কাজে জড়াতে পারবো।
তিনদিন পর কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। কলকাতা পৌঁছে পার্ক্স স্ট্রিটে এক খালার বাসায় উঠলাম। ওই বাসায় গিয়ে দেখি ওখানে আরও ত্রিশজন আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মধ্যে সম্প্রতি প্রয়াত আলি যাকের, বাদল রহমানসহ প্রত্যেকেই তাদের পরিবার নিয়ে ছিল। আর খালাম্মা আমাদের প্রত্যেককে হাসিমুখে সেবা করে গেছেন। যেভাবে পেরেছেন সাহায্য করেছেন। আমি মনে করি সেই খালাম্মাও একজন মুক্তিযোদ্ধা।
এরপর আমরা আসলাম কলকাতার ১৪৪ নম্বর লেনিন সরণির বাড়িতে। সেখানে ‘বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’ নামে একটা সংগঠন ছিল। তারা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করত। সেই ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে ‘বাংলাদেশি মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’। সেখানে গিয়ে এ দেশের অনেক গুণীজনদের দেখা পেলাম। তাদের মধ্যে ছিলেন ওয়াহিদুল হক, সন্জিদা খাতুন, সৈয়দ হাসান ইমাম, মুস্তাফা মনোয়ার, আলী যাকের, লায়লা হাসান, ইনামুল হক, আসাদুজ্জামান নূর, ডালিয়া নওশিনসহ আরও অনেকে। দেখলাম, একটা ঘরের মধ্যে শতরঞ্জি বিছানো, সেখানে বেশ কয়েকজনকে নিয়ে ডালিয়া নওশিন গান শেখাচ্ছেন। আমিও যোগ দিলাম। আমাকে পেয়ে সবাই এতটাই আনন্দিত হলো যে, সত্যি বলতে কি, আমার মধ্যে নিজের পরিবার বা বাসার কোন চিন্তাই ছিলনা। এর আগে পর্যন্ত আম্মাকে নিয়ে একটা চিন্তা সবসময় মাথায় আসতো। কিন্তু লেনিন সরণির এই বাড়িতে এসে সব ভুলে গেলাম।
সারাবাংলা: তারপর তো নিশ্চয় পুরোপুরি গানবাজনার সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন…
শাহীন সামাদ: ১৪৪ নম্বর লেনিন সরণির বাড়িতে আবার শুরু হলো নতুন করে গানচর্চা। রবীন্দ্র-নজরুল থেকে শুরু করে ডিএল রায়, ফোক, বলা যায় সব ধরণের বাংলা গান। সেই অনুযায়ী আমরা চর্চা করতাম। আমাদের একটা স্ক্রিপ্ট থাকতো, যার নাম ছিল ‘রূপান্তরের গান’। সেটাতে ধারাবর্ণনা করতেন সৈয়দ হাসান ইমাম। আর পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ড স্ক্রিন বানাতেন মুস্তাফা মনোয়ার। যত দিন গেছে এই বাড়িতে শিল্পীদের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বেড়েছে। সবাই যে প্রশিক্ষিত শিল্পী তা না, কিন্তু প্রত্যেকের গলায় যেন সুর ছিল। দেশমাতার মুক্তির জন্য সেই সময়টাতে সবাই যেন শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। আমরা প্রতিদিনই কলকাতার কোথাও না কোথাও প্রোগ্রাম করতাম। তখন আমাদের একটাই উদ্দেশ্য, প্রচুর টাকা যোগাড় করা। যেটা এ দেশে পাঠানো হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য।
বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পেও আমরা গান শোনাতে যেতাম। তবে এক্ষেত্রে আমরা গান বাছাই করতাম অনেক ভেবে-চিন্তে। কারণ অধিকাংশ ক্যাম্পেই এ দেশের সহজ সরল গ্রামের মানুষরা ছিলেন। যারা কঠিন গানগুলো বুঝবেন না। তাই তাদেরকে সহজ বোধগম্য গানগুলোই গেয়ে শোনাতাম। সবাই খুবই খুশি হতেন। এমনও হয়েছে বৃষ্টি হচ্ছে, আমরা মাথায় মাচা ধরে গান গাইতাম। জল জমে গেছে, তারপরও আমরা গান গেয়ে শোনাচ্ছি। আমাদের তখন একটাই উদ্দেশ্য, সবাইকে উৎসাহ দেওয়া। সবার মধ্যে দেশের প্রতি টানটা ধরে রাখা। গান গাইতে ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও গিয়েছিলাম। সেখানে সুর্যকন্যা কল্পনা যোশির সাহচর্য পাই। একমাস ছিলাম। এরপর আবার কলকাতায় ফিরে আসি।
এক সময় শ্রদ্ধেয় সমর দাস ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে আমাদের আমন্ত্রণ জানান। আমরা ৮ থেকে ১০ জনের মতো একটি দল গিয়েছিলাম। তখন আমাদের দিয়ে ৮টি গান রেকর্ড করা হয়। এরপর যখন আবার ডাকলেন তখন আমরা জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে আসি বেতার কেন্দ্রে। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে টালিগঞ্জ স্টুডিও থেকে ১৪টি গান রেকর্ড করে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে জমা দিয়ে আসি। সেই গানগুলোই সব সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বাজত।
সারাবাংলা: তারপর তো দেশ স্বাধীন হল। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে মুক্তি পেল বাঙালি। তারপর দেশে ফিরলেন কবে? ফিরে কী কী দেখলেন?
শাহীন সামাদ: দেশ তো স্বাধীন হল। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই আমরা দেশে ফিরতে পারিনি। কারণ তখন ভারতে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ বাঙালি বাংলাদেশে ফিরছে। যার ফলে যানবাহনের একটা সংকট দেখা দিল। ’৭২-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি আমরা ঢাকায় ফিরি। এখানে এসেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। চারিদিকে শুধু ধ্বংসস্তূপ। মেনেই নিতে পারছিলাম না। ঢাকায় ফিরেছিলাম সন্ধ্যা নাগাদ। সেদিন আর বাসায় যাইনি। পরদিন সকালে বাসায় ঢুকি মনের মধ্যে এক অজানা আশঙ্কা নিয়ে। সবাই বেঁচে আছে তো? নাকি পাকিস্তানি মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে। প্রথমেই দেখা পেলাম আম্মার, উনি তো আমাকে দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। তার ধারণা ছিল, আমি হয়তো মরেই গেছি। কারণ আমার সাথে কোন যোগাযোগই ছিলনা। তারা আমার কোন খোঁজই পায়নি। সবাই একে অপরের গলা জড়িয়ে সে কী কান্না। খুশির বন্যায় মনে হল নতুন এক জীবনে প্রবেশ করলাম। সব ভাইবোনকে দেখতে পাচ্ছি, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!
সারাবাংলা: এই যে ত্যাগ, প্রাপ্তির কথা যদি বলি…
শাহীন সামাদ: এটা সত্যি যে, গত ৫০ বছরে সেদিনের সেই গানগুলো অজস্রবার গেয়েছি, নতুন করে রেকর্ডও করা হয়েছে। যতগুলো রেকর্ড হয়েছে, তার সবগুলোতেই আমার কন্ঠ আছে। বিভিন্ন জায়গায় সম্মানিত হয়েছি। শ্রোতারা আমাকে মুল্যায়ন করেছেন। বাংলাদেশ সরকার আমাকে একুশে পদকে ভূষিত করেছেন। সেটিও তো কম প্রাপ্তি নয়।
সারাবাংলা: ছায়ানট থেকেই তো আপনার যাত্রা শুরু, সেই ছায়ানটের সঙ্গেই আছেন…
শাহীন সামাদ: স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আবারও ছায়ানটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। এবার শিখতে নয়, শেখাতে। চেষ্টা করছি পরবর্তি প্রজন্মে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ইতিহাস দিয়ে যেতে। দেশের গানকে দেশের বাইরেও নিয়ে গেছি। তবে একটা কথা সত্য যে, আজ আমার যে মুল্যায়ন হচ্ছে, আমি যে সম্মান পাচ্ছি, তার পুরো কৃতিত্বটাই ছায়ানটের। সেদিন এখান থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম বলেই আজকের আমাকে আমি তৈরি করতে পেরেছি। ১৩ বছর বয়সে যুক্ত হয়েছিলাম ছায়ানটের সঙ্গে, আজও আছি, ভালোবাসায়।
সারাবাংলা: বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আপনার অনুভূতি…
শাহীন সামাদ: আমি নিজেকে ভীষণ সৌভাগ্যবতী বলে মনে করি যে, স্বাধীনতার ৫০তম বছরটা আর জাতির পিতার ১০১তম জন্মদিনটাও দেখে যেতে পারছি। নিশ্চয় আমার উপর সবার দোয়া ছিল। ৫০তম বছরেও সেদিনের মতো গান গাইতে পারছি। এরইমধ্যে প্রচুর অনুষ্ঠান করছি। যদিও করোনা সবকিছুকেই ম্লান করে দিয়েছে। তারপরও যতটুকুই উদযাপন করা যাচ্ছে, তাও কম কিসের। আমি মনে করি, এটাই আমাদের জন্য অনেক প্রাপ্তি। সেই সাথে বলবো আমরা আমাদের দেশ পেয়েছি। ৭১-এর পরবর্তী সেই বাংলাদেশ আর বর্তমান বাংলাদেশ অনেক পার্থক্য। আমরা এখন নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ।
সবশেষে, যাদের আত্মদানে আমরা এই বাংলাদেশ পেয়েছি, তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
ছবি: ইন্টারনেট
ছায়ানট নজরুল সংগীতশিল্পী বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি বাংলাদেশি মুক্তি সংগ্রামী শিল্প সংস্থা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শাহীন সামাদ সমর দাস স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্বাধীনতা দিবস ২০২১ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী