ইরফান খান: মৃত্যুই পরাজিত যে শিল্পীর কাছে
২৯ এপ্রিল ২০২১ ১৪:১৭
দেখতে দেখতেই কেটে গেল একটি বছর। গত বছর এমনই দিনে এই পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছিলেন অভিনেতা ইরফান খান। ভারতের যে গুটি কয়েকজন অভিনয় শিল্পীর নাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। হলিউড-বলিউড ছাড়াও ব্রিটিশ ফিল্মসহ বিভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মনে স্থান করে নিয়েছেন এই বরেণ্য অভিনেতা।
১৯৮৮ সালের মীরা নায়ার পরিচালিত ‘সালাম বম্বে’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে প্রথম চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটে এই গুণী অভিনেতার। তার এই প্রথম সিনেমাটি অস্কারেও মনোনয়ন পেয়েছিল। দিন যত পেরিয়েছে নিজের অসামান্য বাস্তবধর্মী অভিনয় দিয়ে দর্শক মনে নিজের জয়গা ততটাই শক্ত করেছেন তিনি। একে একে অভিনয় করেছেন ‘লাইফ ইন অ্যা মেট্রো’, ‘দ্য লাঞ্চবক্স’, ‘নিউ ইয়র্ক আই লাভ ইউ’, ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’, ‘এ মাইটি হার্ট’,‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’, ‘জঙ্গল বুক’, ‘দ্য নেমসেক’, ‘লাইফ অব পাই’ ও ‘দ্যা ইনফার্নো’সহ দেশি-বিদেশি ৫০টির মতো চলচ্চিত্রে।
১৯৬৭ সালের ৭ জানুয়ারি জয়পুরের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন ইরফান খান। তার আসল নাম সাহাবজাদে ইরফান আলি খান। অভিনেতা নিজের লম্বা নামটি শুনতে ভালোবাসতেন না। সে কারণে নামটি ছোট করে ইরফান করে নেন। ২০১২ সালে নামের মধ্যে তিনি একটি অতিরিক্ত ‘R’ যোগ করেন। কারণ তার এই শব্দটি শুনতে ভালো লাগত।
অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত ইরফান খানের নাম হয়তো লেখা হবে বিশ্বের বিখ্যাত অভিনয় শিল্পীদের তালিকায়। কিন্তু এই অভিনয় শিল্পীর নাম হয়তো থাকতে পারতো বিশ্বের খ্যাতনামা ক্রিকেটারদের তালিকায়। অবাক করার মতো কথা হলেও এটাই সত্যি। ২৩ বছরের কম বয়সীদের জন্য ‘সিকে নাইডু’ টুর্নামেন্টের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ইরফান খান। টুর্নামেন্ট খেলতে যেতে হতো জয়পুর থেকে আজমির, প্রয়োজন ছিল ২০০ রুপির। ট্রেনের টিকিট কেনার সেই সামর্থ্য না থাকায় সেদিন গন্তব্য বদলে দিয়েছিল তার জীবনের ট্রেন।
এক সাক্ষাৎকারে জীবনের দিক পাল্টানোর এই গল্প বলতে গিয়ে ইরফান খান বলেছিলেন, ‘আমি অভিনয়ে আসার আগে একজন ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলাম। অলরাউন্ডার ছিলাম। বোলিং-ব্যাটিং দুটোই ভালো লাগতো। তবে আমার ক্যাপ্টেন চাইতেন আমাকে বোলিং করাতে। তিনি সবসময় বলতেন, ভালো একটা বল করো এবং আমি তাই করতাম। কোনো একভাবে উইকেট পেয়েও যেতাম!’
আফসোস করে এই অভিনেতা বলেন, ‘আমার ক্যাপ্টেন আমাকে সিকে নাইডু টুর্নামেন্টের জন্য সিলেক্ট করেছিল। কিন্তু টুর্নামেন্ট খেলতে জয়পুর থেকে আজমির যেতে হতো। আর ওই সময় আমাদের বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না। আমাকে মিথ্যা বলে ক্রিকেট খেলতে যেতে হতো। তারওপর ওই টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়ার জন্য ট্রেনের ভাড়া লাগত ২০০ বা ২৫০ রুপি। এই টাকা আমার কাছে ছিল না। ওই দিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম এটা আমার জন্য না।’
মুম্বাইতে যাওয়ার পর ইরফানের প্রথম চাকরি হয় একজন এসি মেকানিকের। একটি কথা প্রচলিত আছে, চাকরির প্রথম দিকে তিনি নাকি তখনকার সুপারস্টার রাজেশ খান্নার বাড়িতে এসি মেরামত করতে গিয়েছিলেন। ইরফানের একটা অদ্ভুত স্বপ্ন ছিল, নিজের মাকে স্যুটকেস ভর্তি টাকা দেবেন তিনি। ঠিক যেমন হিন্দি সিনেমায় দেখা যায়। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ না হলেও অভিনেতা হয়ে এই স্বপ্নটা নাকি ঠিকই পূরণ করেছিলেন ইরফান।
ইরফান খান এম এ পড়তে পড়তেই ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় পড়ার জন্য একটি স্কলারশিপ পান। ভর্তির সময়ে তিনি নাকি তার থিয়েটারের অভিজ্ঞতা নিয়ে মিথ্যে বলেছিলেন। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামাতেই তিনি দেখা পান তার স্ত্রী সুতপা শিকদারের। বলিউড অভিনেতা হিসেবে পরিচিত হলেও ইরফান খান তার অভিনয়ের কেরিয়ার শুরু করেছিলেন টেলিভিশনে। ‘চানক্য’, ‘ভারত এক খোঁজ’, ‘সারা জাহাঁ হামারা’, ‘বানেগি আপনি বাত’, ‘চন্দ্রকান্তা’ এবং ‘স্টার বেস্ট সেলার্সে’র মতো ধারাবাহিকে তিনি অভিনয় করেন।
২০০৮ সালে ইরফান খান ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’-এ এক পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। সিনেমাটি বেস্ট পিকচার, বেস্ট ডিরেক্টরসহ ৮টি ক্যাটাগরিতে অস্কার জিতে নেয়। এছাড়া ৭টি বাফটা অ্যাওয়ার্ড ও ৪টি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডও আছে এই সিনেমার ঝুড়িতে। এই সিনেমার জন্য তিনি এবং সিনেমার অভিনেতারা স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড অ্যাওয়ার্ড ফর আউটস্ট্যান্ডিং পারফর্মেন্স বাই আ কাস্ট ইন আ মোশান পিকচার অ্যাওয়ার্ড জয় করেন।
স্লামডগ মিলিয়নিয়ারের অস্কারজয়ী পরিচালক ড্যানি বয়েল ইরফান খান সম্বন্ধে বলেছেন, ‘ইরফান একই অভিনয় বারবার একইরকম নিখুঁতভাবে করতে পারেন। এটা দেখতে পারা সত্যিই অসাধারণ।’
২০১২ সালে হলিউড মুভি ‘দ্য অ্যামাজিং স্পাইডারম্যান’-এ ইরফান খান ড. রাজিত রাথা চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি হলিউডের সিনেমা ‘লাইফ অব পাই’-এর পাই চরিত্রটির পূর্ণবয়স্ক চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। ‘লাইফ অব পাই’ অ্যাকাডেমী অ্যাওয়ার্ড বা অস্কারে ১১টি ক্যাটাগরীতে মনোনয়ন লাভ করেছিল, যা ২০১২ সালে অন্য যেকোনো সিনেমার চেয়ে বেশি ছিল। চারটি ক্যাটাগরীতে অস্কার পুরস্কারও জিতে নিয়েছিল ছবিটি। তিনটি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডে মনোনয়ন পেয়ে বেস্ট অরিজিনাল স্কোরের জন্য একটি গোল্ডেন গ্লোব জেতে সিনেমাটি। এছাড়াও এই সিনেমা ২টি ব্রিটিশ অ্যাকাডেমী ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডও জিতেছে।
২০১২ সালে ইরফান খান বলিউডে ‘পান সিং তোমার’ নামে আরেকটি সিনেমায় অভিনয় করেন। সিনেমাটি সমালোচকদের কাছ থেকে অসাধারণ প্রশংসা পায়। সিনেমাটিতে ভারতের ন্যাশনাল গেমে স্বর্ণপদক পাওয়া একজন সৈনিকের খেলোয়াড় থেকে ডাকাতে পরিণত হওয়ার সত্য কাহিনীর উপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয়েছিল। সাড়ে চার কোটি রুপিতে নির্মিত এই সিনেমাটি বক্স অফিসে প্রায় ৩৯ কোটি রুপির ব্যবসা করে। এই সিনেমার জন্য ইরফান খান ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা অভিনেতার পুরস্কার জেতেন যা বলিউড কাঁপানো তিন খানের কেউই কখনও জেতেননি। ফিল্মফেয়ারে তিনি সমালোচকদের মতে সেরা অভিনেতার পুরস্কারটিও জিতে নেন। এছাড়াও ২০১৩ সালে তিনি ‘দ্য লাঞ্চ বক্স’-এর জন্য এশিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডে সেরা অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন।
অসাধারণ অভিনয়ের জন্য ২০১১ সালে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ পদকে ভূষিত বলিউডের প্রভাবশালী এই অভিনেতা ২০২০ সালের ২৯ এপ্রিল সকালে মুম্বাইয়ের ধিরুভাই আম্বানি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান করে। এর আগে, ২০১৮ সালে তার নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমার ধরা পড়ে। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে টিউমারের চিকিৎসা শেষে লন্ডন থেকে মুম্বাইয়ে ফিরেছিলেন তিনি।
নিজের অভিনয়, গুন, ব্যবহার সব কিছুর দ্বারাই দর্শকদের ভালোবাসা এবং সম্মান অর্জন করেছিলেন ইরফান খান। অসাধারণ অভিনয় তিনি উপহার দিয়ে গিয়েছেন বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতে। তাই ‘বাফতা’ (BAFTA) ২০২১ এবং অস্কার ২০২১ এর মঞ্চে সম্মান জানান হয়েছে তাকে। এই বছর হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে তার অবদানকে সম্মান জানিয়ে ফিল্মফেয়ার ইরফানকে প্রদান করেছে ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’। প্রয়াত বাবার হয়ে পুরষ্কার নিতে মঞ্চে উঠেছিলেন বড় ছেলে বাবিল খান। চোখের জলে বাবার এই সম্মান দুহাতে গ্রহণ করেছেন বাবিল।
ছবি ও তথ্য: ইন্টারনেট
ইরফান খান ইরফান খানের মৃত্যুবার্ষিকী দ্য অ্যামাজিং স্পাইডারম্যা পান সিং তোমার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী বলিউড অভিনেতা লাইফ অব পাই স্লামডগ মিলিয়নিয়ার