Thursday 16 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এক মাইক্রোফোনের বেতার কেন্দ্র দিয়ে যুদ্ধ করেছি: তিমির নন্দী


২৫ মার্চ ২০১৮ ২২:০৫ | আপডেট: ৫ নভেম্বর ২০১৮ ২০:৫২

মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। কণ্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করেছেন। উদ্বুদ্ধ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। যুদ্ধের পরেও কাজ করছেন দেশের গান নিয়ে, দেশের জন্য। ২০১২ সালে মোদের গরব, ভাষার জন্য যারা দিয়ে গলে প্রাণ, ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়- এই গান তিনটির আন্তর্জাতিক স্বরলিপি করেছেন তিনি। একই বছর, লন্ডন অলিম্পিকে ব্যবহারের জন্য তৈরি করেছেন  জাতীয় সংগীতের আন্তর্জাতিক স্বরলিপি। আর এখন করছেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের আন্তর্জাতিক স্বরলিপি তৈরির কাজ। তিনি ‘তিমির নন্দী’। যুদ্ধদিনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্মৃতিচারণ করেছেন সারাবাংলার কাছে।


১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। কোটি বাঙালির মতো আমার যুদ্ধে যাওয়ার স্পৃহা সেখান থেকেই। আমি তখন কুড়িগ্রামে। আমার বড় ভাই বিয়ে করেছিলেন সেখানে। আমার যুদ্ধের শুরু লাঠি হাতে। সারা রাত জেগে থাকতাম। জেগে থাকার সুবিধার জন্য গাছের সঙ্গে কোনোরকম বাতি জ্বালিয়ে ক্যারাম খেলতাম। অবশ্য তার আগেই ওই এলাকার স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে আমি গণসংগীত ও দেশাত্ববোধক গান গাইতে শুরু করি।

বিজ্ঞাপন

কিছুদিন পরেই শুনলাম পাকিস্তানি আর্মিরা গ্রামে ঢুকে পড়েছে এবং যাকে পাচ্ছে তাকেই হত্যা করছে। আমি মাকে নিয়ে কুড়িগ্রাম থেকে চলে যাই আসামে। সেখানে এক রাত থেকে কলকাতা।

মা-কে আগেই বলেছিলাম আমি যুদ্ধে যাবো। কলকাতায় গিয়ে আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। আগ্রহ বাড়ার একটা কারণও ছিল। আনন্দবাজার পত্রিকায় দেখলাম আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা তার বাবার পায়ের কাছে অস্ত্র রেখে বাবাকে সালাম করছে। ছবিটি দেখে বোঝাই যাচ্ছে, বাবার দোয়া নিয়ে যুদ্ধে যাবে সে। এই ছবিটি দেখে মা-কে বললাম, তাহলে আমি কেন যেতে পারব না? তখন মা বলল, তুমি তো আগে থেকেই গান কর, তুমি কণ্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করো। বলে রাখি, আমি কিন্তু ১৯৬৯ সাল থেকেই রেডিও-টিভিতে গান করি। আর যুদ্ধের সময় আমার বয়স ১৫ বছর। মায়ের কথা শুনে আমার মনে হলো, তাইতো, আমিতো কণ্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করতে পারি।

কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হয়েছে শুনেছি। কিন্তু খুঁজে পাই না। কারণ গোপন জায়গায় ছিল। আমার বড় ভাই যখন কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে চাকরি পেলেন, তখন তিনি এসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর দিলেন। বালিগঞ্জ ৫৭/৮ সার্কুলাল রোড।

দোতলা একটা ভবন, নিচের তলায় রেকর্ডিং স্টুডিও। দোতলায় অনেকেই থাকতেন। সেখানে গিয়ে আমি যা দেখলাম তাতে অবাকই হলাম। সেখানে আমার শ্রদ্ধেয়, সম্মানিত অগ্রজরা আগে থেকেই জড়ো হয়েছেন। সমর দাশ, অজিত রায়, আপেল মাহমুদ, আব্দুল জব্বার, রথীন্দ্রনাথ রায়, সুজেয় শ্যাম এরা সবাই একরকম গাদাগাদি করে থাকতেন সেখানে। সবাই ফ্লোরিং করতেন। বালিশ নেই, কম্বল নেই। আমিও কিছুদিন ফ্লোরিং করেছি। কিন্তু আমি কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে থাকতাম না। বাইরে থাকতাম।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু ছোট্ট ওই ঘরেই যে কত অসাধারণ সব গান তৈরি হয়েছে। বেতার কেন্দ্রে একটাই মাইক্রোফোন ছিল। কোনো ফ্যান ছিল না, জানালা ছিল একটা। রেকর্ডিং-এর সময় সেই জানালা বন্ধ থাকতো। যন্ত্রী ভাইয়েরা সেখানেই বাজাতেন। আমরা তো বেশিরভাগ কোরাস গাইতাম। যখন একসঙ্গে গাইতাম, তখন একে ওপরের কাঁধ, গলা ধরে গান গাইতাম। তারপরও গানগুলো যেন বুলেটের মতো কাজ করতো। আজ ভাবলে বিশ্বাস হয় না। এক মাইক্রোফোনের বেতার কেন্দ্র দিয়ে পৃথিবীর অন্য কোথাও যুদ্ধ হয়েছে কি না আমার জানা নেই।

উপরে বা থেকে ফকির আলমগীর, তিমির নন্দী

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শুধু গান নয়, প্রচার হতো নাটক, কথিকা। জল্লাদ খানা নামের একটা নাটক তখন খুব জনপ্রিয় ছিল। এম আর আকতার মুকুলের চরমপত্র চরমভাবেই উৎসাহ দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বসেই তখন গান লিখতেন শহীদুল ইসলাম, আপেল মাহমুদ। ইন্দ্রমোহন রাজবংশীও গান লিখেছেন, সুর করেছেন। যখন যার যেভাবে শব্দ, কথা মনে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে তা লিপিবদ্ধ করা হতো। অনেকসময় সুর আগে করা হয়েছে, তার ওপর কথা বসানো হয়েছে।

ভারতের গোবিন্দ হালদারের কিছু গান করেছি আমরা। কামাল লোহানির কথা অনুযায়ী, গোবিন্দ হালদার দুটি ডায়েরি দিয়েছিলেন কামাল ভাইকে, যার একটি তিনি দিয়েছিলেন সমর দা-কে অন্যটি আপেল মাহমুদকে। যার মধ্যে দুটি গান আমরা খুব গাই- পূর্ব দিগন্তে এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অধিকাংশ শিল্পী কেন্দ্রের বাইরেও ভাগ ভাগ হয়ে গান করেছেন, কাজ করেছেন। যেমনটা তারেক মাসুদের ছবি ‘মুক্তির গান’-এ আমরা দেখতে পাই। শাহিন সামাদ, বিপুল ভট্টাচার্য, স্বপন চৌধুরী, ডালিয়া নওশিনরা ট্রাকে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রানিত করতেন।

আমিও শরনার্থী শিল্পী গোষ্ঠী নামের একটি দলে গান করেছি। নারকেল ডাঙায় মিতালি মূখার্জি, অনুপ ভট্টাচার্য, বিপ্লব দাস, মামুনুর রশীদ, রফিকুল আলম, ফকির আলমগীর, শুক্লা দে, কমল দাস, আমি কাজ করেছি। বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরে গিয়ে গিয়ে গান করতাম।

কলকাতাসহ বিভিন্ন জায়গার গান করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য টাকাও তুলেছি আমার। অন্যরাও করেছে। তখন সব এসে জমতো মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ তহবিলে।

সেসময় এসব কাজ করতে কষ্ট লাগতো না। বিপদও তেমন মনে হতো না। আমরা যে কষ্টে ছিলাম, তার চেয়ে ঢের কষ্টে ছিল যারা সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আমরা যখন গান গাইছি, তখন হয়ত কোনো মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। তাদের কাছে আমাদের কষ্ট কিছুই না।

আমাদের কিছু খাবারের কষ্ট ছিল। একটা দোকান ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সামনে। সেখানে আমার মাটির ভারে চা খেতাম। অনেকদিন হয়েছে এক ভার চা দুই-তিন জন মিলে খেয়েছি। একটা সিঙারা তিনজন ভাগ করে নিয়েছি। অন্য সবার কষ্টের কথা চিন্তা করে আমাদের আর কষ্ট মনে হতো না।

আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর সকালে অন্য একটি গানের রিহার্সেল করেছি। হঠাৎ করেই শুনলাম ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে শহীদ ভাই (শহীদুল ইসলাম) লিখে ফেললেন ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’। সুজেয় শ্যাম সুর দিলেন আর লিড করলেন অজিত রায়।

তিন বছর আগে কলকাতা গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খোঁজ করেছিলাম। কিন্তু ৫৭/৮ বালিগঞ্জ আর খুঁজে পাইনি। বাংলাদেশ ও কলাকাতা সরকারের কাছে আবেদন জানাতে চাই, ভবনটি যদি থেকে থাকে, তাহলে সেখানে ঐতিহাসিক যাদুঘর তৈরি করা হোক।

অনুলিখন : প্রতীক আকবর

সারাবাংলা/পিএ/পিএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর