বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ প্রাধান্য অনুদানের ছবির গল্পে
১৭ জুন ২০২১ ১৫:৩২
রবিবার (১৩ জুন) ২০২০-২১ অর্থ বছরে ২০টি ছবিকে পূর্ণদৈর্ঘ্য শাখায় অনুদান দিয়েছে। এ ছবিগুলোর অধিকাংশ নির্মাতাই দেশের প্রতিষ্ঠ নির্মাতা। তাদের ছবিগুলোর গল্প ভাবনাসহ অন্যান্য পরিকল্পনা নিয়ে সারাবাংলা কথা বলেছে তাদের সঙ্গে। তবে কেউই তাদের ছবিতে কারা অভিনয় করছেন তা বলেননি। তবে ধারণা দিয়েছেন ছবির কাহিনি সম্পর্কে। এতে দেখা যাচ্ছে এবারের অনুদান প্রাপ্ত ছবিগুলোর কাহিনিতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও দেশীয় নানা ঐতিহ্য প্রাধান্য পেয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে মানবিক সংকটের গল্প।
‘জয় বাংলা’ বলবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গল্প
প্রযোজক মিটু সিকদার ৬৫ লাখ টাকা অনুদান পাচ্ছেন ‘জয় বাংলা’ ছবির জন্য। যেটি পরিচালনা করবেন কাজী হায়াৎ। কাজী হায়াৎ বলেন, ‘আমার সকল ছবিতে দেশপ্রেম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়গুলো এসেছে। এছবির নাম শুনে অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন এটি মুক্তিযুদ্ধের গল্পে নির্মাণ করবো কিনা। এটি মুক্তিযুদ্ধের গল্পে নির্মাণ করা না হলেও এর বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।’ কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই তিনি ছবিটির শুটিং শুরু করতে চান। এ ছবির একটা বড় অংশ গোপালগঞ্জে শুটিং হবে।
নৌকা বাইচের গল্প ‘গলুই’
‘নৌকা বাইচ, একজন মাঝির জীবন জীবিকা, প্রেম, ভালোবাসা ও এর মধ্য দিয়ে সমাজের প্রতিচ্ছবি নিয়ে এস এ হক অলিক বানাবেন ‘গলুই’। এ ছবির জন্য প্রযোজক হিসেবে ৬০ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন খোরশেদ আলম খসরু। অলিক বলেন, এখানে ‘গলুই’ নামটা রাখা হয়েছে নৌকা চালানোর জন্য যে গলুই লাগে তা থেকে। এখানে আমরা একটি সম্প্রদায়ের কথা বলবো। বলবো দেশীয় ঐতিহ্য নৌকা বাইচের কথা। যা এখন বিলুপ্তপ্রায়। তা কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে সে গল্প তুলে আনার চেষ্টা থাকবে।
২০১৯-২০ বছরেও অনুদানের ‘যোদ্ধা’ নামক ছবি নির্মাণ করার কথা অলিকের। করোনা পরিস্থিতির কারণে ছবিটির শুটিং শুরু করতে পারেননি তিনি। আবার ‘গলুই’ ছবির একটা অংশ জুড়ে নৌকা বাইচের দৃশ্য থাকবে। তা ধারণের জন্য বর্ষাকালই আদর্শ। অলিক বলেন, ‘আমরা আসলে সপ্তাহখানেক পরে সিদ্ধান্ত নিবো কোন ছবিটা আগে শুরু করবো।’
নারীপ্রধান গল্প ‘দেশান্তর’
বছর ছয়েক আগে ‘বাবার জুতা’ নামক একটি ছবি করতে চেয়েছিলেন আশুতোষ সুজন। বেঙ্গল ক্রিয়েশন এটি প্রযোজনা করার কথা ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি অনুদানের ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত অর্থ ছাড় করেনি। ফলে ছবিটি করতে পারেননি সুজন। তাই ‘দেশান্তর’ হতে যাচ্ছে তার প্রথম ছবি। এর গল্প সম্পর্কে বলেন, এটি দেশপ্রেমের কথা বলবে, দেশের কথা বলবে। সবচেয়ে বড় কথা এটি হবে নারীপ্রধান গল্পের একটা ছবি। এ বছরই ছবিটি শুটিং ফ্লোরে যাবে। এ ছবির প্রযোজক হিসেবেও আছেন সুজন। সরকার থেকে ৬০ লাখ টাকা অনুদান হিসেবে পাবেন।
দেশীয় ঐতিহ্যের গল্প ‘জামদানী’
বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহ্য জামদানী শাড়ি। এটি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত। অনিরুদ্ধ রাসেলের পরিচালনায় ‘জামদানী’র গল্পও দেশীয় এ ঐতিহ্য নিয়ে। এ ছবির জন্য এর প্রযোজক মো: জানে আলম ৬৫ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছে। এর গল্প সম্পর্কে অনিরুদ্ধ রাসেল বলেন, ‘জামদানী পল্লীর একজন তরুণের গল্প বলবো আমরা। যে কিনা স্বপ্ন দেখে তার পল্লীতে একদিন বড় শিল্প প্রতিষ্ঠিত হবে। ইপিজেড হবে। তার পল্লীর মানুষদের ভাগ্য ফিরবে।’ ছবিটির চিত্রনাট্য করার জন্য চিত্রনাট্যকারসহ পরিচালক ঢাকার অদূরে অবস্থিত জামদানী পল্লীতে গিয়েছেন বলে জানালেন। শিল্পী তালিকা চূড়ান্ত করে খুব শিগগিরই শুটিং তারিখ ঘোষণা করবেন অনিরুদ্ধ রাসেল।
মানব পাচার ও নারীর সংগ্রামের গল্প ‘জলরঙ’
প্রযোজক হিসেবে দোলোয়ার হোসেন দিলু ‘জলরঙ’ ছবির জন্য অনুদান পাচ্ছেন ৬০ লাখ টাকা। এটি পরিচালনা করবেন অপূর্ব রানা। পরিচালক জানালেন এর গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে মানব পাচার ও একজন নারীর সংগ্রামের গল্প। তিনি বলেন, ছবিটি মূলত একজন নারীর জার্নিকে ঘিরে। ‘জলরঙ’ মূলত একটি নৌকার নাম। যেটি স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত হয়েছিল। আবার বর্তমানে নৌকাটি দিয়ে একটি চক্র এটি মানব পাচারে ব্যবহার করে। প্রসঙ্গক্রমে এখানে রোহিঙ্গাতের ইস্যু এসেছে। ছবিটির শুটিং হবে কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে। এ ছবির মূল চরিত্র সম্পূর্ণ নতুন একজন নারীকে থাকছেন। এছাড়া বিভিন্ন চরিত্রের জন্য আরজু, সাইমন, শ্যামল মাওলাকে ভেবে রেখেছেন পরিচালক।
বঙ্গবন্ধু ছায়া হয়ে থাকছেন ‘দাওয়াল’-এ
দেশের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে গিয়ে ধান কাটার মৌসুমে যারা ধান কাটতো তাদের ‘দাওয়াল’ বলা হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। সে দুর্ভিক্ষে দাওয়ালরা বেশ সমস্যায় পরে পাকিস্তান সরকারের এক অধ্যাদেশের কারণে। এ নিয়ে তারা আন্দোলন শুরু করে। এতে করে তাদের উপর নানা ধরনের নিপীড়ন, নির্যাতন নেমে আসে। নির্যাতিত দাওয়ালদের পক্ষে আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহায়তা করেন। ‘দাওয়াল’ ছবির জন্য প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে পিকলু চৌধুরী পাচ্ছেন ৬৫ লাখ টাকা। তিনি বলেন, ‘আমাদের ছবিতে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর কোন চরিত্র না থাকলেও তিনি ছায়া হয়ে আসবেন।’
ছবিটি পিরিওডিক্যাল হওয়ায় এবং ধান কাটাসহ বেশ কিছু দৃশ্যের কারণে ছবিটির শুটিং টানা করা সম্ভব নয় বলে জানান পরিচালক। তিনি বলেন, ‘ধান কাটার একটা মৌসুম তো চলে গেল। আরও কয়েক মাস পরে নতুন সিজন আসবে, আমাদের তখন একটা অংশ শুটিং করার ইচ্ছে। এছাড়া যেহেতু দেশভাগের পরবর্তী সময়ের গল্প, তাই ওই সময়টাকে ধরতে আমরা সেট নির্মাণ করবো। ইতোমধ্যে আমাদের একটা শুটিং প্ল্যান করা আছে।’
অনুদানের অর্থের বাইরেও অনেক টাকা লাগবে ছবিটি নির্মাণের জন্য। সেক্ষেত্রে তারা বাইরের প্রযোজক খুঁজবেন। না পেলে নিজেরা প্রযোজনা করার চেষ্টা করবেন।
একটি রেল স্টেশনের গল্প ‘ভাঙন’
মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেন ‘ভাঙন’-এর প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে ৬০ লাখ টাকা অনুদান পাচ্ছেন। তিনি এর আগে ২০১০-১১ অর্থ বছরে সরকারি অনুদানে ‘হরিজন’ ছবিটি পরিচালনা করেন। তিনি জানান, এবারের ছবির গল্প আগের ছবির মতো প্রান্তিক মানুষের জীবন নিয়ে। যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে ছিন্নমূল মানুষের কথা।
মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেন বলেন ,‘ভাঙন’-এর কাহিনি আমারই লেখা একটি ছোট গল্প ‘মোহন গাঙয়ের বাঁশি’ নামক থেকে নেওয়া। এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি রেলস্টেশন। যে স্টেশনে রয়েছে একজন যুবক যে কিনা খুব ভালো বাঁশি বাজায়। সে একজন নারীকে ভালোবাসে। দুজনই ওই স্টেশনে কাজ করে। কিন্তু ওই নারী যুবকের প্রেমে সাড়া দেয় না।
পরিচালক জানান, ছবির গল্পে রেল স্টেশনকে কেন্দ্র করে যে সকল প্রান্তিক মানুষ কাজ করে তাদের জীবনের হাসি, কান্না, প্রেম ও ভালোবাসার কথা বলবেন তিনি ‘ভাঙন’-এ। একই সঙ্গে থাকবে স্টেশনকে ঘিরে নানা ধরণে অপরাধের কথা। ‘হরিজন’-এর মতো তিনি এবারের ছবিতেও দক্ষ অভিনয়শিল্পীদের প্রাধান্য দিবেন বলে জানালেন।
পেইন্টিংয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু হত্যার গল্প ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে পেইন্টিং খুব কমই হয়েছে। তবে অল্প পরিমাণে কাজ হলেও বেশ ভালো কিছু কাজ হয়েছে। এর মধ্যে শিল্পী শাহাবুদ্দিনের অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে। শাহাবুদ্দিনসহ অন্য শিল্পীদের বিখ্যাত কিছু কাজ নিয়ে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’-এর গল্প। যেটির জন্য বেগম বদরুন নেছা খানম প্রযোজক হিসেবে ৬৫ লাখ টাকা অনুদান পাচ্ছেন। এতে পরিচালক হিসেবে থাকছেন বাংলাদেশ টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র ইন্সটিটিউটের প্রথম ব্যাচের ছাত্র উজ্জ্বল কুমার মন্ডল।
সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ‘রইদ’
চার বার ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’ হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী অভিনেত্রী প্রযোজক হিসেবে দ্বিতীয় বারের মতো অনুদান পেলেন ‘রইদ’-এর জন্য। এটি পরিচালনা করবেন মেজবাউর রহমান সুমন। এর গল্প বহু বছর আগে সুমন লিখেছিলেন বলে জানালেন। তিনি বলেন, ‘রইদ’ তো অনেকেই জানেন রোদের আঞ্চলিক ভার্সন শব্দ। নাম থেকে কিছুটা হয়তো আপনারা বুঝতে পারবেন এতে আলোর গল্প বলা হবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে একে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ও উষ্ণতার গল্প বলা যায়।
প্রযোজক জয়া আহসান এ ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন বলে জানালেন সুমন। তবে তা এখনও নিশ্চিত নয় বলে জানালেন তিনি। অনুদানের অর্থের বাইরে অন্যান্য ছবির মতো এ ছবির জন্য বাইরের প্রযোজক লাগবে। সেক্ষেত্রে জয়া আহসানের সি তে সিনেমা এবং তার নিজের ফেসকাট প্রযোজনা করবে বলে জানালেন তিনি।
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস থেকে ‘পেন্সিলে আঁকা পরী’
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বহুল পঠিত উপন্যাস ‘পেন্সিলে আঁকা পরী’। যার প্রধান চরিত্রে একজন তরুণী ও মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন। তরুণীটির নাম কখনও মিতু, কখনও টেপী। বাবা মারা যাওয়ার পর সে মেয়েটি সংসারের হল ধরার জন্য এফডিসিতে এক্সট্রা শিল্পী হিসেবে কাজ নেয়। অন্যদিকে মধ্য বয়স্ক ব্যক্তিটির নাম মোবারক সাহেব। তার অর্থ বিত্ত থাকলেও তিনি মানসিকভাবে অসুখী।
এমন গল্পে অমিতাভ রেজা চৌধুরী নির্মাণ করবেন ‘পেন্সিলে আঁকা পরী’। যেটির জন্য প্রযোজক হিসেবে মাহজাবিন রেজা চৌধুরী, মো: আসাদুজ্জামান ও অমিতাভ রেজা চৌধুরী ৬০ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন।
ছবিতে যারা রয়েছেন
উপরে বাঁ থেকে- কাজী হায়াৎ, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, মেজবাউর রহমান সুমন। মাঝের সারিতে বাঁ থেকে– এস এ হক অলিক, মির্জা সাখাওয়াত হোসেন, পিকলু চৌধুরী, আশুতোষ সুজন। নিচে বাঁ থেকে– অপূর্ব রানা, অনিরুদ্ধ রাসেল ও উজ্জ্বল কুমার মন্ডল
সারাবাংলা/এজেডএস
অনিরুদ্ধ রাসেল অনুদান অপূর্ব রানা অমিতাভ রেজা চৌধুরী আশুতোষ সুজন উজ্জ্বল কুমার মন্ডল এস এ হক অলিক কাজী হায়াৎ পিকলু চৌধুরী পূর্ণদৈর্ঘ্য মির্জা সাখাওয়াত হোসেন মেজবাউর রহমান সুমন