Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রেখো’

এন্টারটেইনমেন্ট করেসপনডেন্ট
৪ আগস্ট ২০২১ ১৫:২০

ছোট বেলায় নাকি তার গানের গলা ভাল ছিল না একদম। কথিত আছে, একবার কিশোর কুমার পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন। সেই আঘাত পাওয়ার পর তিন-চার দিন নাকি তিনি শুধু কেঁদেছেন। সেই কান্নার পর তার গলায় কী এক পরিবর্তন আসলো, গলায় সুর চলে আসলো, আওয়াজ পরিবর্তন হয়ে গেল। কথার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে, কিন্তু যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে সেই কয়েক দিনের কান্না অনেক যুগের কোটি মানুষের মনের খোরাক হয়ে চলে আসছে।

‘আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রেখো, আমায় পড়বে মনে কাছে দূরে যেখানেই থাকো’। আজকের দিনটি- সত্যিই মনে রাখার মতো। আজ যে অমর শিল্পী কিশোর কুমারের ৯২তম জন্মদিন।

বিজ্ঞাপন

‘সে যেন আমার পাশে আজো বসে আছে’, ‘সে তো এলো না’, ‘মোর স্বপনের সাথী তুমি কাছে এসো’, ‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে’, ‘আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রেখো’, বা হিন্দি ভাষায় ‘হামে তুমসে পেয়ার কিতনা’, ‘মেরে সামনে ওয়ালি খিড়কি মে’, ‘মেরে স্বপনো কি রানী’, ‘রূপ তেরা মাস্তানা’সহ এমন অসংখ্য অমর গানের স্রষ্টা তিনি। শুধু শিল্পী নন, গীতিকার, সুরকার, অভিনয় শিল্পী-হিসেবেও অসামান্য সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন যে কিংবদন্তি, তিনি কিশোর কুমার। বাংলা এবং হিন্দি- দুই ভাষার চলচ্চিত্রেই সমানভাবে দাপট নিয়ে চলেছেন তিনি। মৃত্যুও তাকে থামাতে পারেনি। আজও তার গান সমান জনপ্রিয়। ছোট থেকে বড় সবাই তার গানে মুগ্ধ। কিছু যেন একটা ছিল তার কণ্ঠে, যা সকল শ্রোতাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। সবাইকে বাধ্য করে তার গান শুনতে।

১৯২৯ সালের ৪ আগস্ট ভারতের মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়াতে এক বাঙালি পরিবারে কিশোর কুমারের জন্ম। তার আসল নাম আভাস কুমার গাঙ্গুলি। বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি ছিলেন একজন আইনজীবী। মা গৌরী দেবী ছিলেন ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে।

বিজ্ঞাপন

কৈশোরকাল থেকেই শিল্পাঙ্গনের সঙ্গে কিশোর কুমারের জানাশোনা। বড় ভাই ভারতের চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম দিকপাল অশোক কুমার। বলিউডের সবাই তাকে ‘দাদামণি’ বলে ডাকতো। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট কিশোর কুমারের স্বপ্ন ছিল ভাইয়ের মতো নায়ক হওয়া। অশোকের সাফল্য তাকে বেশ প্রভাবিত করেছিল। তবে ভাগ্যচক্রে অভিনেতা না হয়ে, অমর শিল্পী হয়েছেন কিশোর। যদিও অভিনয়টাও কিছু করেছেন তিনি।

সংগীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গায়ক ছিলেন না তিনি। প্রকৃতির উপহার হিসেবে গলায় সুর নিয়েই যেন জন্মেছিলেন। কোমল, মিষ্টি-মধুর ছিল তার কণ্ঠ। জীবনের নির্দিষ্ট একটি সময় বাদ দিলে তার পুরো জীবনটাই সাফল্যে ভরপুর। একজন সফল অভিনেতা, গায়ক, প্রযোজক, গীতিকার এবং সঙ্গীত পরিচালক। তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর বেশিরভাগই ছিল কমেডি ধাঁচের। লোক হাসানোয় তার অন্ত ছিল না- সেটি পর্দার ভিতরে হোক বা বাইরে। বিভিন্ন ধাঁচের গান গেয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন, তার মতো কেউ নেই, কিশোর কুমার শুধু একজনই হতে পারে।

আর ডি বর্মন, লতা মঙ্গেশকর, কিশোর কুমার ও আশা ভোঁসলে

আর ডি বর্মন, লতা মঙ্গেশকর, কিশোর কুমার ও আশা ভোঁসলে

১৯৪৯ সালে প্রথম জিদ্দি চলচ্চিত্রে আরেক বিখ্যাত অভিনেতা দেব আনন্দের জন্য গান গেয়ে চলচ্চিত্র জগতে পদচারণা শুরু করেন। এরপর ১৯৫১ সালে আন্দোলন চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৪ সালের পর থেকে নউকরি, নিউ দিল্লী, আশা, চালতি কা নাম গাড়ি, হাফ টিকিট, পারোসান, ঝুমরু ইত্যাদি চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এগুলোর প্রত্যেকটিতেই গান গেয়েছেন শুধু নিজের জন্য। ১৯৬৮ সালের আগে পর্যন্ত তিনি হয় নিজের জন্য, নাহয় দেব আনন্দের জন্য গেয়েছেন। অন্য কোনো অভিনেতার জন্য নয়।

তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে চালতি কা নাম গাড়ি, হাফ টিকিট, পারোসান– এখনো বিখ্যাত। তার চলচ্চিত্রগুলোর সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সলীল চৌধুরী, এস ডি বর্মণ এর মতো বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকরা। এ সময়ে তার বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে ছিল- ছোটা সা ঘার হোগা বাদাল কি ছাও মে (নউকরি), ইনা মিনা ডিকা (আশা), নাখরে ওয়ালি (নিউ দিল্লী), পাঁচ রুপিয়া বারা আনা, এক লারকি ভিগি ভাগি সি (চালতি কা নাম গাড়ি), চিল চিল চিল্লাকে (হাফ টিকিট), এক চাতুর নর, মেরে সামনে ওয়ালি খিড়কি মে (পারোসান), মেরি মেহবুব কেয়ামাত হোগি (মি. এক্স), দুখি মান মেরে (ফানটুস) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

একসময় শচীন দেব বর্মণ তাকে দিয়ে গান গাওয়ালেন। নায়ক ছিলেন তখনকার সদ্য ইন্ডাস্ট্রিতে আসা রাজেশ খান্না। চলচ্চিত্রটির প্রত্যেকটি গান দর্শকরা পছন্দ করলো। কিশোর কুমার হয়ে গেলেন সুপার হিট। এরপর থেকে বলিউডের সবাই কিশোর কুমারকে দিয়ে তাদের গান গাওয়ানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন।

এরপর কিশোর কুমার জীবিত কিংবদন্তী অমিতাভ বচ্চনের জন্য গান করেন। এক পর্যায়ে দেখা গেল, অমিতাভের ছবি মানেই সেখানে কিশোর কুমারের নাম থাকবে। এর অন্যথা যেন হতেই পারে না। এসময় এস ডি বর্মণের সুপুত্র রাহুল দেব বর্মণের সঙ্গীত পরিচালনায় গান গাওয়া শুরু করেন কিশোর কুমার। এখানেও সফল হলেন। একের পর এক দর্শক প্রিয় গান দিয়ে যাচ্ছিল এ জুটি। যেমন- হামে তুমসে পেয়ার কিতনা, হামে অর জিনে কি, দেখা এক খাওয়াব, সাগার কিনারে, চেহরা হে ইয়া, ইয়ে দোস্তি, রিম ঝিম ঘিরে সাওয়ান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

সত্যজিৎ রায় ও কিশোর কুমার

সত্যজিৎ রায় ও কিশোর কুমার

তিনি শুধু যে হিন্দি গান গেয়েছেন, তা কিন্তু নয়। বাংলা গানও গেয়েছেন। মহানায়ক উত্তম কুমারের জন্য গেয়েছেন তিনি অনেক গান। ‘আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চির দিনের সাথী’, ‘আশা ছিল ভালবাসা ছিল’, ‘যদি হই চোর কাঁটা’, ‘এই তো জীবন’, ‘নারীর চরিত্র বেজায় জটিল’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সত্যজিৎ রায়ের জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন তিনি। তার ‘চারুলতা’তে ‘আমি চিনিগো চিনি তোমারে’ গানটি গেয়েছিলেন। আবার সত্যজিতের ‘ঘরে বাইরে’ চলচ্চিত্রেও গান করেছিলেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের মতে, কিশোর কুমারের গানের গলা চলচ্চিত্রের যেকোনো পরিস্থিতি মোতাবেক দৃশ্যে মানিয়ে যায়।

১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান এই মহান শিল্পী। মৃত্যুর আগের দিনেও তিনি গান রেকর্ড করেছিলেন। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তার গান এখনো রয়ে গেছে, তার সুরেলা কণ্ঠ এখনও রয়ে গেছে। তিনি বেঁচে আছেন বাংলা গানে, বেঁচে থাকবেন হাজার বছর।

সারাবাংলা/এএসজি

কিশোর কুমার কিশোর কুমারের ৯২তম জন্মদিন জন্মদিন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর