Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৮৪ বছরের এক চিরতরুণীর গল্প

এন্টারটেইনমেন্ট ডেস্ক
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৯:৪৩

ছোটবেলায় ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু জীবন বইল অন্য খাতে। তিনি হয়ে গেলেন হিন্দি সিনেমার অন্যতম বলিষ্ঠ অভিনেত্রী এবং ক্লাসিক সুন্দরী। বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে তার ব্যক্তিত্ব, অভিনয় এবং উপস্থিতির মতোই ব্যক্তিগত পরিসরেও একইরকম পরিশীলিত অভিনেত্রী বলতে যাকে বোঝায়, তিনি ওয়াহিদা রহমান। সেযুগে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে নাম বদলের একটা চল ছিল। কিন্তু নাম অপরিবপর্তিত রাখা নিয়ে জেদী ছিলেন ওয়াহিদা। বললেন, ‘তখনকার সময় নাম বদলটা একরকমের ফ্যাশন ছিল। দিলীপ কুমার, মীনা কুমারি, মধুবালা অনেকেই নাম বদল করে এসেছিলেন ইন্ডাস্ট্রিতে। অনেকেই বলেছিলেন আমার নামটা অনেক বড়, বদলে কোনও ছোট নাম রাখতে। আমি তাতে কোনও মতেই রাজি ছিলাম না। আমার মা-বাবা আমার নাম দিয়েছেন, সুতরাং নাম বদলের কোনও প্রশ্নই ছিল না।’

বিজ্ঞাপন

আজ (৩ ফেব্রুয়ারি) বলিউডের এই কিংবদন্তীর জন্মদিন। ১৯৩৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ওয়াহিদার জন্ম ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির চেঙ্গালপট্টুতে। চার বোনের মধ্যে ওয়াহিদা ছিলেন সব থেকে ছোট। তার বাবা ছিলেন জেলাশাসক। ফলে ভারতের বিভিন্ন শহরে কেটেছে তাদের শৈশব। ছোট থেকেই ওয়াহিদা এবং তার ছোট বোন ভরতনাট্যমের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।

জীবনে চলার পথে সুর কাটল ১৯৫১ সালে। মারা গেলেন বাবা, মহম্মদ আব্দুল রহমান। মা, মমতাজ বেগম অসুস্থ। বড় দুই বোন জাহিদা আর শাহিদার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বন্ধ হয়ে গেল ছোট দুই বোন সাইদা আর ওয়াহিদার পড়াশোনা। সংসারের কথা ভেবে সিনেমায় অভিনয় করবেন বলে ঠিক করলেন ওয়াহিদা। ভাল নাচতেন বলে এল সিনেমায় কাজের সুযোগ। মূলত আইটেম নাম্বারের শিল্পী হিসেবে ওয়াহিদা ১৯৫৫ সালে কাজ করলেন তেলুগু ছবি ‘রোজুলু মারাই’-তে। এরপর আরও কিছু দক্ষিণী ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। ক্রমশ নৃত্যশিল্পী থেকে অভিনেত্রী হিসেবে দেখা গেল তাকে।

১৯৫৬ সালে ওয়াহিদা নজরে পড়লেন পরিচালক-প্রযোজক গুরু দত্তের। তিনি ওয়াহিদাকে নিয়ে এলেন সাবেক বম্বে, আজকের মুম্বাইয়ে। ওয়াহিদাকে সুযোগ দিলেন তার ‘সিআইডি’ ছবিতে। এই ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করে হিন্দি সিনেমায় পা রাখলেন ওয়াহিদা। কিংবদন্তি গুরু দত্ত সিআইডি সিনেমায় তাকে একটি ভ্যাম্পায়ারের চরিত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়াহিদাকে দেখে অবশ্য একবারের জন্যও ভ্যাম্পায়ার বলে মনে হয়নি। তাই দত্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে পরবর্তী সিনেমাগুলোতে তিনি ওয়াহিদাকে শুধুমাত্র মুখ্য চরিত্রগুলোতে ব্যবহার করবেন। ১৯৫৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘প্যায়াসা’ সিনেমায় গুলাব নামের একটি সিংহহৃদয়ের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করে ওয়াহিদা সকলকে ছাপিয়ে যান। এর পর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

বিজ্ঞাপন

অভিনয়ের গুণে খুব অল্প দিনেই ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জায়গা করে নেন ওয়াহিদা। দেব আনন্দের সঙ্গে তার জুটি বক্স অফিসে ছিল দারুণ জনপ্রিয়। ‘ষোলওয়া সাল’, ‘কালা বাজার’, ‘রূপ কি রানি চোরোঁ কা রাজা’, ‘কোহরা’ ছবির সুবাদে ওয়াহিদা দ্রুত উঠে আসেন প্রথম সারিতে।

১৯৬২ সালে সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘অভিযান’-এ স্মরণীয় অভিনয় করেন ওয়াহিদা। ষাটের দশকে গুরু দত্ত-ওয়াহিদা রহমান জুটি ছিল চর্চার বিষয়। ওয়াহিদা নিজে গুরু দত্তকে তাঁর মেন্টর বলতেন। ‘প্যায়াসা’, ‘এক ফুল চার কাঁটে’, ‘চৌধভি কা চাঁদ’ ছবির সুবাদে নিজের কেরিয়ারে আর্থিক ক্ষতি অনেকটাই সামলে নিয়েছিলেন গুরু দত্ত। কানাঘুষা রয়েছে, তার জন্যই নাকি ভেঙে গিয়েছিল গুরু দত্ত এবং গীতা দত্তের দাম্পত্য। কিন্তু গুরু দত্তের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে কোনওদিনই প্রকাশ্যে কিছু বলেননি ওয়াহিদা। কিন্তু শোনা যায়, তাদের ঘনিষ্ঠতার জন্য স্ত্রী গীতার সঙ্গে গুরু দত্তের সম্পর্কে ভাঙন ধরে। অশান্তি চরমে উঠলে সন্তানদের নিয়ে গীতা বাড়ি ছেড়ে চলে যান। ক্রমশ অর্থকষ্ট আর সুরার নেশায় জর্জরিত হয়ে পড়েন গুরু দত্ত।

ত্রিকোণ সম্পর্কের জেরে তিনজনের কেরিয়ারই ধাক্কা খেতে থাকে। শেষদিকে ওয়াহিদাও নিজেকে সরিয়ে নেন গুরু দত্তের থেকে। ১৯৬২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সাহেব বিবি অউর গুলাম’ ছিল একসঙ্গে তাদের শেষ কাজ। এদিকে সবদিক থেকে বিধ্বস্ত গুরু দত্ত দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ১৯৬৪ সালে তাকে নিজের ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

জীবনে গুরু দত্তের পর্ব থেকে ক্রমশ মূলস্রোতে ফিরে আসেন ওয়াহিদা। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পায় তার কেরিয়ারের মাইলফলক ছবি ‘গাইড’। আরকে নারায়ণের লেখা ‘গাইড’ উপন্যাসটির থেকে তৈরি বিজয় আনন্দের নির্দেশিত এই সিনেমার রোজি চরিত্রটির সঙ্গে তিনি যেন নিজেকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। ওয়াহিদা রহমান নিজেও মনে করেন যে এই সিনেমায় তিনি তার জীবনের সেরা অভিনয়টা করতে পেরেছিলেন। এবং তিনি হয়তো ঠিকই মনে করেন।

‘গাইড’ ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারে ওয়াহিদাকে সে সময়ে অনেকেই বলেছিলেন তিনি যেন রোজির মতো একজন আধুনিক মেয়ের চরিত্রে অভিনয় না করেন। ষাটের দশকে এই সিনেমাটিকে বেশ ‘আধুনিক’ বলে মনে করা হয়েছিল। কারণ এই সিনেমার মুখ্য চরিত্র রোজি নিজের স্বামীকে পরিত্যাগ করে রাজু বলে একজন গাইডের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। রাজুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন দেব আনন্দ। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত রোজির চরিত্রে অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তিনি সফলও হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, ‘গাইড’ ছবিটি ওয়াহিদা রেহমান ও দেবানন্দের অভিনয় জীবনের ধারাটাই বদলে দিয়েছিল। এই দুজনের এবং পরিচালক বিজয় আনন্দের নিষ্ঠার জেরে ‘গাইড’ বলিউড ক্লাসিকের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল।

‘গাইড’ ছবিটির পর ‘তিসরি কসম’, ‘নীল কমল’, ‘খামোশি’, ‘পাত্থর কে সনম’, ‘ধাত্রী’, ‘শতরঞ্জ’ ছবির জোরে আবার ওয়াহিদা চলে আসেন স্পটলাইটে। ১৯৭১ সালে ‘রেশমা অউর শেরা’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেলেও সত্তরের দশকে ওয়াহিদার কেরিয়ারে ভাটার টান চলে আসে। নায়িকার ভূমিকার বাইরে গিয়ে তিনি অন্য ভূমিকায় অভিনয় শুরু করেন। কিন্তু আর ফিরতে পারেননি আগের সেই তারকাবৃত্তে।

১২ বছর অভিনয় জগত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন ওয়াহিদা। ১৯৯১ সালে ‘লমহে’ সিনেমার মাধ্যমে আবার ফিরে আসেন অভিনয়ে। এরপর ‘ওয়াটার’, ‘ওম জয় জগদীশ’, ‘রং দে বসন্তী’, ‘১৫ পার্ক অ্যাভিনিউ’, ‘দিল্লি সিক্স’-সহ কিছু ছবিতে কাজ করেছেন তিনি।

১৯৭৪ সালে ওয়াহিদা বিয়ে করেন সহঅভিনেতা শশী রেখি ওরফে কমলজিৎকে। ‘শগুন’ ছবিতে তারা একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। বিয়ের পরে বেঙ্গালুরুতে থাকতে শুরু করেন ওয়াহিদা। ২০০০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পরে তিনি আবার ফিরে আসেন মুম্বাই। দুই সন্তান ছেলে সোহেল এবং মেয়ে কাশভি দু’জনেই লেখক।

২০১১ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হন ওয়াহিদা রহমান। এখন তার বেশির ভাগ সময় কাটে সমাজসেবায়। পাশাপাশি ওয়াহিদা দেখিয়ে দিয়েছেন নিজেকে সময় দেওয়ার, পছন্দের শখ পূর্ণ করার কোনও নির্দিষ্ট বয়স নেই। তার ফোটোগ্রাফির শখ ছিল। এখন চুটিয়ে সেই শখ পূর্ণ করছেন তিনি। ভারতের পাশাপাশি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অরণ্যে তিনি এখন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার। তার তোলা ছবির প্রদর্শনীও হয়েছে। ৮৪ বছরের এই চিরতরুণী জানিয়েছেন, তিনি কোনওদিন ছবি তোলার প্রথাগত প্রশিক্ষণ পাননি। পরিজন ও বন্ধুবান্ধবদের উৎসাহেই তার এই নতুন ভূমিকায় আগমন।

সারাবাংলা/এএসজি

৮৪ বছরের এক চিরতরুণীর গল্প ওয়াহিদা রহমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর