সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়: বাংলার সংগীত জগতে এক স্বর্ণযুগের অবসান
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২২:১৪
গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় গত ২৬ জানুয়ারি কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলা গানের প্রবাদপ্রতিম সংগীতশিল্পী গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। আজ মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় চলে গেলেন এই মহীয়সী। অবসান ঘটলো বাংলার সংগীত জগতের এক স্বর্ণযুগের। শিল্পীর প্রয়াণে শোকাহত অনুরাগীরা।
মঙ্গলবার সকালে হাসপাতালের পক্ষ থেকে মেডিক্যাল বুলেটিনে জানানো হয়েছিল, গীতশ্রীর শারীরিক পরিস্থিতি রীতিমতো উদ্বেগজনক। এদিন সকালে তার রক্তচাপ কমে যায়। যে কারণে ভেসোপ্রেশার সাপোর্টে রাখা হয়েছিল কিংবদন্তি সংগীতশিল্পীকে।
‘মধুমালতী’র মতো নিজের কণ্ঠের জাদুতে কয়েক দশক ধরে সংগীত জগৎকে মাতিয়ে রেখেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর কলকাতার ঢাকুরিয়া এলাকায় জন্ম শিল্পীর। ৬ ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে ছোট। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি অনুরাগ। পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, অধ্যাপক এ টি কান্নান, অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে তার শিক্ষা শুরু। ছিলেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁর শিষ্যা। মুম্বাইয়ে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। রাইচাঁদ বড়াল, শচীন দেববর্মনের মতো সংগীত পরিচালকের তত্ত্বাবধানে ‘আঞ্জান গড়’, ‘তরানা’র মতো সিনেমার গানে নেপথ্য কণ্ঠ দিয়েছিলেন।
প্রায় ১৭টি হিন্দি ছবির জন্য গান গাওয়ার পর ব্যক্তিগত কারণে কলকাতায় চলে আসেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই থেকে শুরু বাংলার সুরেলা জগতের এক নতুন অধ্যায়। ‘সপ্তপদী’, ‘পথে হল দেরী’, ‘অগ্নি পরীক্ষা’, ‘দেওয়া নেওয়া’, ‘পিতা পুত্র’ — একের পর এক সিনেমায় তার কণ্ঠের জাদু শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে বললে কম বলা হবে। বলা যায়, বাঙালির সাংস্কৃতিক মননে যোগ করেছে এক অভূতপূর্ব মাইলফলক।
এক সময় সুচিত্রা সেনের কণ্ঠ হিসেবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কাউকেই ভাবতে পারতেন না সংগীত পরিচালকরা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরীর সঙ্গে জুটি বেঁধে বহু কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন গীতশ্রী। জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন ‘জয় জয়ন্তী’, ‘নিশিপদ্ম’ সিনেমায় গান গেয়ে। পেয়েছেন বঙ্গ বিভূষণ। ১৯৬৬ সালে কবি ও গীতিকার শ্যামল গুপ্তকে বিয়ে করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। শিল্পীর গাওয়া বহু গানের কথাই শ্যামল গুপ্তর লেখা।
শুধু গান নয়, রাজনৈতিক কারণেও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মনে থেকে যাবেন অনেকেরই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দুঃস্থ আশ্রয়প্রার্থীদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। অর্থ তোলার বিষয়ে তিনি পুরোভাগে দাঁড়িয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে রেডিয়ো সেন্টার খোলার বিষয়েও তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘তুমি ফিরে এলে’ বলে একটি গানও পরিবেশন করেন সন্ধ্যা। এপার বাংলার পাশাপাশি ওপার বাংলাতেও তাই তার জনপ্রিয়তা ছিল সমান মাপের।
এত সুর, এত গানের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গত কয়েকদিন আগে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের ঠিক আগেই তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কার দিতে চেয়েছিল কেন্দ্র সরকার। অভিমানে তা প্রত্যাখ্যান করেন শিল্পী। বলেছিলেন, ‘আমার শ্রোতারাই আমার পুরস্কার’। তার পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলেন শিল্পী। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আর ফিরে আসা হয়নি। হাসপাতাল থেকেই তিনি যাত্রা করলেন ইন্দ্রপুরিতে।
সারাবাংলা/এএসজি