জহির রায়হানের সেই না-বানানো ছবির গল্প
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৩:০৪
বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের সাথে একেবারে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জহির রায়হান। যিনি শুধু একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিকই নন, একাধারে ছিলেন গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক। বায়ান্ন’র ফেব্রুয়ারির সেই ঐতিহাসিক ক্ষণে ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম দশজনের মধ্যে একজন ছিলেন জহির রায়হান।
বলা হয়ে থাকে, নিজে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেই তার সাহিত্যকর্মে ভাষা আন্দোলন এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, ‘জহির রায়হান সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র কথাসাহিত্যিক যাঁর উদ্ভবের পেছনে আছে ভাষা আন্দোলন…। যদি বায়ান্নর একুশ না ঘটত তবে জহির রায়হান হয়ত কথাশিল্পী হতেন না।’ জহির রায়হান নিজেও বলতেন, ‘আমি যা কিছু সৃষ্টি করেছি তা একুশেরই দান’।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটা সিনেমা তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন জহির রায়হান। ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি এই ছবির চরিত্র নির্বাচন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিলো। ছবির নাম ঠিক করা হয়েছিল ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে সম্পূর্ণ আলাদা এক কাহিনী। পরবর্তীতে সেই কাজ আর এগোয়নি। এ প্রসঙ্গে ‘৭০ সালের মার্চে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন যে, তদানীন্তন সরকারী মহল থেকে অনুমতি পাননি বলে ছবিটা করতে পারেন নি। তাই সময় নিচ্ছেন। যখন বিনা বাধায় করা যাবে তখনই করবেন।
এই ছবিটি প্রসঙ্গে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় জহির রায়হানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ গ্রন্থে লেখক, সাংবাদিক ও নির্মাতা শাহরিয়ার কবিরের লেখা ভূমিকায়। তিনি লিখেছেন —
“১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি জহির রায়হান ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ছবিটি বানাবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে তিনি ‘আরেক ফাল্গুন’ যদিও এর আগে লিখেছিলেন, কিন্তু ছবির জন্য ভেবেছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা কাহিনী। শিল্পী মুর্তজা বশীরকে তিনি চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব দিয়ে বলেছিলেন, গল্পের কাঠামো হবে এই রকম— চারটি পরিবার সমাজের চারটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করবে। একটি উচ্চবিত্ত, একটি মধ্যবিত্ত, একটি শ্রমিক ও একটি কৃষক দম্পতি থাকবে, যারা ঘটনাক্রমে বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিতে এমন একটি জায়গায় একত্রিত হবে যেখানে ছাত্রদের মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে। গুলির শব্দ হওয়ার পরই দেখা যাবে একটি কাক আর্ত কন্ঠে উড়ছে গোটা ঢাকা শহরের আকাশে।”
শাহরিয়ার কবির লিখেছেন, “মুর্তজা বশীর জহির রায়হানের মুখে বলা গল্পটির উপর ভিত্তি করে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র চিত্রনাট্য লেখেন। শ্রমিক চরিত্রটির মুখে ঢাকার আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করার জন্য বস্তিতে ঘুরে শব্দচয়ন করেন। চিত্রনাট্য সম্পুর্ণ হলে জহির রায়হান এটি এফডিসি স্টুডিওতে জমা দেন। নবারুণ ফিল্মস-এর ব্যানারে নির্মিতব্য এই ছবির জন্য চরিত্র নির্বাচন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিলো। এ ছবিতে অভিনয় করার কথা ছিল খান আতা, সুমিতা, রহমান, শবনম, আনোয়ার, সুচন্দা, কবরী প্রমুখ চিত্র তারকার। কিন্তু এ ছবি নির্মাণের অনুমতি তাকে দেয়া হয়নি। মুর্তজা বশীর আমাকে পরে বলেছেন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র চিত্রনাট্য লেখার জন্য জহির রায়হান তাকে অগ্রিম একশ টাকাও দিয়েছিলেন। তার মতে এফডিসিতে খুঁজলে এই চিত্রনাট্যটি পাওয়া যাবে।”
“এরপর জহির রায়হান বাণিজ্যিক ছবি বানাবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ বানাবার সিদ্ধান্ত স্থগিত থাকে। পাঁচ বছর পর জহির রায়হানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র চিত্রকাহিনী প্রথম প্রকাশিত হয় মাসিক ‘সমীপেষু’তে।”
শাহরিয়ার কবির আরো জানিয়েছিলেন, “১৯৬৫ সালে মুর্তজা বশীরকে যে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, ১৯৭০-এ সেই কাহিনীতে জহির রায়হান আরো কটি চরিত্র সংযোজন করেছেন। কাকের প্রতীকটি এখানে আছে কিন্তু মুখ্য হচ্ছে কাহিনীর শেষে নদীর প্রতীকটি। ছবি তৈরি হলে এই কাহিনীতে যে আরো বহু প্রতীক ও উপাদান যুক্ত হতো এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে প্রথম ও শেষ দৃশ্যে অনেকগুলো মন্টাজ এফেক্ট-এর কথা তিনি আমার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।”
পরবর্তীতে শাহরিয়ার কবিরের চাপাচাপিতে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র চিত্রকাহিনী প্রকাশিত হয়েছিল মাসিক ‘সমীপেষু’তে এবং বর্তমানে আমরা জহির রায়হানের যে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ পড়ে থাকি সেটা মূলত সেই চলচ্চিত্র, যা জহির রায়হানের অন্যতম ‘অসমাপ্ত’ কাজের একটি।
জহির রায়হান ছিলেন তার সময়ের অন্যান্য সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকারের তুলনায় অগ্রগামী, যার ফলে তার কাজগুলো যুগে যুগে মানুষের দ্বারা হয়েছে প্রশংসিত ও সমাদৃত। তার ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র চিত্রকাহিনীতে সে সময়ের ঘটনাগুলো এবং নানা ধরণের মানুষের জীবনে কিভাবে এসেছে তাকে খুব বেশী বাস্তব ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। জাজ্বল্যমান একুশে ফেব্রুয়ারীর চেতনাকে কেন্দ্রে রেখে বৈচিত্র্যকে ভয়ানক সুন্দরভাবে একত্রিত করেছেন। একুশে ফেব্রুয়ারীর মাঝে যে শোষণের শেকল ভাঙ্গা স্পৃহা রয়েছে, তার চিরন্তনতা এবং বহমানতাকে যেভাবে জহির রায়হান মূর্তিত করেছেন সেটা হয়তো তিনি ভাষা সৈনিক বলেই সম্ভব হয়েছে…
‘সুতোর মত সরু পানির লহরি বালির বালির উপর দিয়ে ঝিরঝির করে বয়ে যাচ্ছে।
ধলপহরের আগে রাস্তায় নেমে এলো এক জোড়া খালি পা।
সুতোর মত সরু পানি ঝরনা হয়ে বয়ে যাচ্ছে এখন।
কয়েকটি খালি পা কংক্রিটের পথ ধরে এগিয়ে আসছে সামনে।
ঝরনা এখন নদী হয়ে ছুটে চলেছে সাগরের দিকে।
সামনে বিশাল সমুদ্র।
সমুদ্রের মত জনতা।
নগ্নপায়ে এগিয়ে চলেছে শহীদ মিনারের দিকে।
অসংখ্য কালো পতাকা।
পতপত করে উড়ছে।
উড়ছে আকাশে।
মানুষগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ের মত অসংখ্য ঢেউ তুলে এগিয়ে আসছে সামনে। ইউক্যালিপ্টাসের পাতা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে নিচে। মাটিতে।
ঝরে।
প্রতি বছর ঝরে।
তবু ফুরোয় না।’
তথ্যসূত্র: জহির রায়হানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ গ্রন্থে লেখক, সাংবাদিক ও নির্মাতা শাহরিয়ার কবিরের লেখা ভূমিকা ও ইন্টারনেট থেকে।
সারাবাংলা/এএসজি
জহির রায়হান জহির রায়হানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ জহির রায়হানের সেই না-বানানো ছবির গল্প