একের পর এক নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ, ভারতের চলচ্চিতত্রের পর এবার অভিনয় করছেন ইরানি নির্মাতা মুর্তজা অতাশ জমজমের নির্দেশনায় ‘ফেরেশতে’ ছবিতে। বাংলাদেশ-ইরানের যৌথ প্রযোজনায় এটি নির্মিত হচ্ছে। এতে তাকে দেখা যাবে প্রান্তিক মানুষের চরিত্রে। ইরানের এই চলচ্চিত্র এবং তার সাম্প্রতিক হালচাল নিয়ে কথা বলেছেন সারাবাংলার সিনিয়র নিউজরুম এডিটর আহমেদ জামান শিমুল
- ‘ফেরেশতে’ ছবিতে সম্পৃক্ততার গল্পটা শুনতে চাই।
এ ছবিটার অফার এসেছে মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মুমিত আল রশিদের মাধ্যমে। উনি একদিন আমাকে জানালেন ছবিটি তৈরি হতে যাচ্ছে। তারপর যা যা হয় আরকি— নানাভাবে আলাপ আলোচনা চলতে থাকলো। একসময় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম আমরা ছবিটি করছি। কাজটা একটু আনন্দ করেই শুরু হল। আপনাদেরকে প্রথমে জানাতে পারিনি। এজন্য অনেকে হয়ত মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন। আমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। এ জন্য আমি আপনাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি।
- এ ছবির বিষয়বস্তু কী?
পরিচালক বেছে নিয়েছেন আমাদের দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের গল্প। কিন্তু এটা মোটেও হতাশার গল্প নয়। আরেকটা বিষয় ও কিন্তু কোন ইস্যুভিত্তিক ছবি বানাচ্ছে না। এ ব্যাপারটা আমার কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী বলে মনে হয়েছে।
- ইরানি পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ভাষাগত কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন কি?
আসলে কাজ করতে গিয়ে পরিচালককে ভালোভাবে চেনা যায়। আসলে যেটা হয়, অভিনয়টা কেন করি? ভালো কাজের আশায় করি। এই যে আরেক দেশের কৃষ্টি, শিল্প, সংস্কৃতি এগুলোকে জানা কাছ থেকে—আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জও ছিল ব্যাপারগুলো। ও কিন্তু ওর ভাষায়, ওর দেশের ভাষায় কথা বলছে। আমরা পুরো টিম অদ্ভূতভাবে কমিউনিকেট করছি। বলে না যে চলচ্চিত্রের কোন ভাষা নেই। যে কোন ভাষায় চলচ্চিত্র কিন্তু আমরা বুঝতে পারি, আমরা দেখতে পারি। সাবটাইটেল না থাকলেও চলচ্চিত্র দেখা যায়। ওর সাথে আমার ভাষায় সংযোগটা না থাকলেও কিংবা আমার টিমের সবাই কিন্তু বুঝে বুঝে কাজটা করছি।
- ছবিতে আপনারা কোন ভাষায় অভিনয় করছেন?
আমরা কিন্তু বাংলাতে অভিনয় করেছি। যখন ইরানে দেখানো হবে তখন সাবটাইটেল বা ডাবিংয়ে দেখানো হবে।
- আমরা যখন ইরানি ছবি দেখি, তখন আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। আপনি বাংলাদেশ ও ভারতের নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। এ ছবিতে কাজ করতে গিয়ে আপনি বেসিক কোন পার্থক্য দেখতে পেয়েছেন ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে, যা তাদেরকে আলাদা করেছে সবার থেকে?
আমাদের দেশে এখন যারা ছবি বানান, কিংবা যারা অভিনয় করি—ইরানি বড় বড় নির্মাতার ছবি দেখি। আমি নিজেও দেখি। কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে কোন ক্যামেরা নেই। অভিনয় যখন আমার কাছ থেকে চাইছে, তখন চাইছে অভিনয়টা যেন না হয়—যতটুকু সম্ভব বাস্তব জীবনের সঙ্গে মিল থাকে। এটা ভালো লাগে না। এটার সুযোগ আমরা ভারতেও পাই না, বাংলাদেশেও কম পাই। এখানে তারা অনন্য বলে আমার মনে হয়। আমি বলবো আরেকটা বিষয়, আপনারা হয়ত ছবিটি দেখে বলবেন, কী সাবলিল! অভিনয়ই করেনি। কই এগুলো তো আমরা সারাক্ষণ এমন দেখি। কিন্তু এগুলো করতে গিয়ে কী কষ্ট আমাদের টিম ও উনি (পরিচালক) করেছে—তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। হাঁটতে পারছি না কাদা দিয়ে, পা ডুবে যাচ্ছে। বাচ্চাটা অনেক ভারী লাগছে। অনেক ইফোর্ট দিতে হচ্ছে। কিন্তু উনি কিন্তু হেঁসে বারবার বলছেন—ওয়ানস মোর, ওয়ানস মোর। সেরাটা আদায় না হওয়া পর্যন্ত উনি সেটা করেই গেলেন। এবং একজন ফিল্মমেকার এটাই হওয়ায় উচিত, এটাই হয়।
- দেশের পাশাপাশি আপনি ভারতে সমান তালে অভিনয় করে যাচ্ছেন। সেখানে তৃতীয়বারের মত ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেলেন। বিষয়গুলো আমাদের গর্বিত করে। আপনার ভক্তদের উদ্দেশ্য এ নিয়ে কিছু বলার আছে?
আমার কিছু বলার নেই। ভালো লাগে, অবশ্যই ভালো লাগে। আমি আমার বাড়িতে যে অ্যাওয়ার্ডগুলো পাই, সেগুলো চোখের সামনে রাখি না। রাখি আমার দরজার পেছনে। আমার কাছে মনে হয়, সত্যি আমি এগুলো পাওয়ার যোগ্য কিনা। যতটা সম্ভব দূরে রাখি। আমার বাড়িতে গেলে আমার অ্যাওয়ার্ডগুলো কেউ কখনও দেখতে পাবেন না। মা মাঝে মধ্যে যখন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার পুরস্কারগুলো আঁচল দিয়ে মুছেন তখন ভালো লাগে। এর বেশি আমি অ্যাওয়ার্ড নিয়ে বেশি কিছু বলবো না। অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তি অনেক সময় শিল্পীকে নষ্ট করে দেয়। আমি সারাজীবন ছাত্র থাকতে চাই, শিখতে চাই। শিক্ষক হতে চাই না।
- ছবিটিতে অভিনয় করতে গিয়ে মজার কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছে কিনা।
অনেক হয়েছে। একটা বলি—প্রকাশিত ছবিগুলোতে আপনারা দেখেছেন এখানে আমার কাপড় ছোপড় অতি সাধারণ। যার হয়ত গাড়িতে ছড়্রারই ক্ষমতা নেই। শুটিং শেষ করে আমার নিজের গাড়িতে করে আমার সহকারীকে নিয়ে রাস্তায় জ্যামে দাঁড়ানো ইফতারের আগে। সাধারণত কী হয়, ভিখারি এসে বলে—ভিক্ষা দেন, ভিক্ষা দেন। কিন্তু পোশাক দেখে আমার কাছে ভিক্ষায় চাইলো না। আমার সহকারি মানিকের কাছে গিয়ে চাইলো। ও তখন মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিল।
আরেকটা মজার কথা বলি, আমরা পল্টনের একটি স্কুলে শুটিং করছিলাম। ইফতারের আগে দিয়ে আমরা শাড়ি দিব, এরকম একটা আয়োজন ছিল। আমার একটা সুবিধা ছিল, ইচ্ছে মত মেকআপ নিয়ে সবার সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি—কেউ আমাকে চিনতে পারছিল না। পহেলা বৈশাখে কিন্তু আপনাদের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি—আপনারা চিনতে পারেননি। তো, আমি বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে গেলাম। ওখানে একজন বয়স্ক মহিলা, খুবই দরিদ্র। আমাদের গার্ডকে বারবার বলতেছে—আমাকে একটা শাড়ি দেন, একটা শাড়ি দেন। আমি বলতেছি—খালা, আপনি আপনাকে দিব তো। কেন বারবার চান ওর কাছে। এরপরও আবার আমার দিকে তাকায় এবং একইভাবে চাইতে থাকে। উনি কোনভাবে বিশ্বাস করলেন না আমি উনাকে কোন টাকা দিতে পারি বা সাহায্য করতে পারি। আমি ফেরার সময় মানিককে (সহকারি) বললাম, আমি ওই বয়স্ক মহিলা ডাকো। আমি উনাকে কিছু সহায়তা করতে চাই। মানিক বললো, উনি গেছে গ্যা। উনি আপনার কথা বিশ্বাস করে নাই।
শুটিংয়ের মাঝামাঝি সবাই হাঁটাহাটি করছিল। একজন মাছ বিক্রেতা মাছ বিক্রি করছিল দেখে কিনতে গেলাম। তখন সে আমার বেশভূষা দেখে, আমাকে টাটকা কোন মাছের দাম বলছিল না। কিছু পঁচা মাছ দেখিয়ে আমাকে বলে, এগুলো পঞ্চাশ টাকা দিয়ে নিয়ে যান। আসলে আমাদের অভিনয়ের মজাটাই তো এটা। এক জীবনে বহুজীবন দেখা যায়। বহুজীবন যাপন করা যায়, আপন করা যায়। যে মানুষটা আমি নই, আমাদের চোখে নিচুতলার মানুষ—সে মানুষটার জীবনও যাপন করতে পারি।
- ছবি প্রযোজনা করেছেন, পরিচালনা করার ইচ্ছে রয়েছে কি?
প্রযোজনা করেছি, করব। কিন্তু পরিচালনার ইচ্ছে আমার নেই।