সিনেমা ব্যবসার নতুন সম্ভাবনা মিনি সিনেপ্লেক্স
৫ মে ২০২২ ১৮:৪৩
ঢাকা: এক যুগে টিনের ছাদ দেওয়া ঘরে কাঠের টুলে বসে মানুষ সিনেমা দেখতো। আস্তে আস্তে টিনের ঘর হলো পাকা দালান। কাঠের টুলের জায়গায় বসল স্টিলের ও ফোমের চেয়ার। বিশেষ ক্ষেত্রে সোফা সেট। সাধারণ পর্দার জায়গায় যুক্ত হলো সিলভার স্ক্রিন। মাইকের সাউন্ডবক্সের জায়গায় যুক্ত হলো ডলবি অ্যাটমোস্ফিয়ার সাউন্ড সিস্টেম। এক-দেড় হাজার আসনের হল নেমে এলো দুইশ আসনে। একক পর্দা থেকে শুরু হলো একাধিক পর্দার মাল্টিপ্লেক্স। যা সাধারণের কাছে সিনেপ্লেক্স নামে পরিচিত। সে ধারাবাহিকতায় দেশে এসেছে মিনি সিনেপ্লেক্স। আপাতত একটি করে পর্দা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জে চলছে দুটি সিনেমা হল। মিনি সিনেপ্লেক্স সিনেমা ব্যবসার নতুন সম্ভাবনা বলে মনে করছেন ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্টরা।
পরিত্যক্ত পার্কিংয়ে সিনেস্কোপ
দেশের প্রথম মিনি সিনেপ্লেক্স নারায়ণগঞ্জের ‘সিনেস্কোপ’। ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ ছবিটি প্রদর্শনের মাধ্যমে নগরীর আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তন ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে এটি চালু হয়। ৩৫ আসনের হলটির উদ্যেক্ততা স্থপতি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মোহাম্মদ নূরুজ্জামান ডালিম। মোট আটশ’ বর্গফুট জায়গার উপর নির্মিত হলে একটি কফি শপ রয়েছে। এতে ফোর কে রেজ্যুলেশনের পর্দা এবং ৭.১ ডলবি ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে। এখানকার সদস্যদের জন্য রয়েছে আজীবন ১০ শতাংশ ছাড়ের ব্যবস্থা। এছাড়া তাদের জন্য আলাদা শোয়ের ব্যবস্থাও করা হয়। প্রতিদিন এখানে ৪টি করে শো হয়। টিকেটের দাম ২০০ টাকা। দেশ বিদেশের ছবি মিলিয়ে শতাধিক ছবি এখানে প্রদর্শিত হয়েছে।
হলটির নির্বাহী পরিচালক রবি সারাবাংলাকে জানান, মোহাম্মদ নূরুজ্জামান ডালিম আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তন ভবনের স্থপতি ছিলেন। মিলনায়তনটি নির্মাণের পর বহুদিন এর আন্ডারগ্রাউন্ডে গাড়ি পার্কিংয়ের একটি অংশ অব্যবহৃত ছিল। এক সময় তা ময়লা অবর্জনায় ভরে যায়। তখন মোহাম্মদ নূরুজ্জামান ডালিম নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র সেলিনা হায়াত আইভির কাছে এখানে একটি হল করার অনুমতি চান। মেয়র দ্রুতই অনুমতি দেন।
রবি বলেন, ‘চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকেই আমরা এ হলটি করেছি। আমারা নারায়ণগঞ্জে আরও দুটি হল করব। এছাড়া দেশের প্রতি জেলায় একটি করে আমাদের শাখা করার ইচ্ছে আছে।’
বাসভবনের নিচতলায় রুটস সিনেক্লাব
সিরাজগঞ্জের ধানবান্ধীর জেসি রোডে অবস্থিত ‘রুটস সিনেক্লাব’। এর উদ্যোক্তা সিরাজগঞ্জের সংস্কৃতিকর্মী সামিনা ইসলাম নীলা। মোট আড়াই হাজার বর্গফুট আয়তনের হলে আসন সংখ্যা ২২। এতে রয়েছে কফি শপ, ফোর কে রেজ্যুলেশনের পর্দা, ১১.২ ডলবি অ্যাটমোস্ফিয়ার সাউন্ড সিস্টেম। টিকেটের দাম ২০০ টাকা। স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একটি সিনেক্লাব রয়েছে। যারা এখানে অর্ধেক ছাড়ে ছবি দেখতে পারেন। ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর ক্লাবটির সদস্যদের পছন্দের ছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করা হয়। তবে এখানে বাণিজ্যিক প্রদর্শন শুরু হয় ‘মিশন এক্সট্রিম’র মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত ১০টির মতো বাংলা ছবি প্রদর্শিত হয়েছে এখানে।
সামিনা ইসলাম নীলা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যখন বাড়িটি করি তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল এখানে একটি সিনেমা হল করব। আমি ও আমার স্বামী শিল্প চর্চার সঙ্গে যুক্ত। আমি মঞ্চে অভিনয় করি, তিনি লেখালেখি করেন। আমাদের কথা ছিল, কেউ যদি ছবি দেখতে না আসে তাহলে আমরা নিজের দেখব। সেই ইচ্ছে থেকে নিজেদের বাসভবনের নিচতলায় হলটি করি।’
তিনি জানান, যশোরে তাদের আরেকটি শাখা খোলার ব্যাপারে কথা চলছে। এছাড়া সিরাজগঞ্জেও নতুন শাখা খুলবেন তারা। দেশের কোনো জায়গা থেকে যদি কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাহলে তারা সেখানেও শাখা করতে সহায়তা করবেন।
যেমন চলছে হলগুলো
রুটস সিনেক্লাবের চেয়ারম্যান নীলা বলেন, ‘এবারের ইদে এখানে শান চলছে। দর্শকরা আসছেন, ছবিটি ভালো চলছে। এর আগে এখানে মিশন এক্সট্রিম, রাতজাগা ফুল, মুখোশ, মৃধা বনাম মৃধা ভালো চলছে। এ ধরনের ভালো ছবি নিয়মিত পাচ্ছি না। পেলে আমরা ব্যবসায়িকভাবে লাভের মুখ দেখব। প্রতি মাসে আমাদের প্রায় ৫০ হাজার টাকা ভুতর্কি দিতে হচ্ছে। তবে আশা করছি খুব শিগগিরই আমরা ব্রেক ইভেনে পৌঁছে যাব।’
২০১৯ এ চালুর পর করোনার কারণে ২০২০ সালে আট মাস এবং ২০২১ সালে ছয় মাস করে মোট ১৪ মাস বন্ধ ছিল সিনেস্কোপ। এরপর করোনার প্রভাবে দর্শক কিছুটা কমে আসে। তবে এবারের ইদে ‘শান’র প্রতিটি শো হাউজফুল ব্যবসা করেছে। শনিবার (৭ মে) পর্যন্ত সব শো’য়ের টিকিট অগ্রিম বিক্রি হয়ে গেছে।
সিনেস্কোপের পরিচালক রবিও জানালেন, নিয়মিত ভালো ছবি এলে তারা ভালোভাবেই হলটি চালিয়ে নিতে পারবেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, বর্তমানে পাইপলাইনে অনেকগুলো ভালো বাংলা ছবি রয়েছে। এগুলো মুক্তি পেলে দর্শকরা নিয়মিত হলমুখী হবেন। তখন এ ধরনের হল সারাদেশে অনেক বেশি হবে।
কতটুকু খরচ মিনি সিনেপ্লেক্স নির্মাণে
পুরাতন সিনেমা হল সংস্কার ও নতুন সিনেমা হল নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক হাজার কোটি টাকার ফান্ডের ঘোষণা দিয়েছেন। এর আওতায় এখন পর্যন্ত ৫৩টি আবেদন জমা পড়েছে। যার বিপরীতে ৩৮০ কোটি টাকা ঋণ চাওয়া হয়েছে। ঋণের অর্থ নিয়ে কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে সিনেপ্লেক্স করছেন। স্টার সিনেপ্লেক্স, লায়নসহ দেশে এই মুহূর্তে চালু সিনেপ্লেক্স আছে ১০টির মতো। বছর শেষে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ২০।
এ ধরনের একটি সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করতে গেলে জায়গার প্রয়োজন পড়ছে দশ হাজার বর্গফুট বা তারও বেশি। খরচ পড়ছে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা। আবার ব্যাংকের ঋণ নিয়ে করলে তা পরিশোধের ব্যাপারও রয়েছে। তাই কেউ যদি চায় স্বল্প খরচে একটি আধুনিক সিনেমা হল করবে তাহলে মিনি সিনেপ্লেক্স তাদের জন্য সহজ সমাধান।
এ ব্যপারে রুটস সিনেক্লাবের চেয়ারম্যান নীলা জানান, হলের জায়গাটি তাদের নিজেদের হওয়ায় নির্মাণ বা ক্রয় বাবদ আলাদা কোনো খরচ হয়নি। তবে হলের আসন, প্রজেকশন মেশিন, সাউন্ড সিস্টেম, সিল্ভার স্ক্রিন ও অন্যান্য সাজসজ্জা মিলিয়ে ৬৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আর জায়গার দামসহ ধরলে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা খরচ।
প্রযোজকের লাভ কতটুকু
জানা গেছে, ২০০ টাকার টিকিটে প্রবেশ মূল্য হিসেবে ধরা হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকা। বাকি টাকা বিভিন্ন ট্যাক্স ও হলের পরিচালন খরচ। প্রবেশ মূল্যের অর্ধেক একজন প্রযোজক পান। অবশ্য দ্বিতীয় সপ্তাহে গিয়ে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পান। এ ধরনের হলগুলোতে সাধারণত শো ফাঁকা যায় না। তাতে কোনো ছবি প্রতিদিন চার শো করে এক সপ্তাহ চললে শেয়ার মানি বাবদ ৫০ থেকে ৬৭ হাজার টাকা পর্যন্ত পাবে। যা দেশের প্রধান কয়েকটি সিনেমা হল ছাড়া অন্যান্য হলের তুলনায় অনেক বেশি। তাছাড়া স্টার সিনেপ্লেক্সসহ অল্প কয়েকটি হল টিকিট বিক্রির সঠিক হিসাব দেয় না। ফলে প্রযোজকরা বঞ্চিত হন তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে। এ ধরনের ৫০টা মিনি সিনেপ্লেক্সে কোন ছবি মুক্তি পেলে এক মাসে এক কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হবে। ফলে নতুন প্রযোজক পাবে ইন্ডাস্ট্রি।
যা ভাবছেন ইন্ডাস্ট্রির মানুষরা
প্রযোজক নেতা খোরশেদ আলম খসরু সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০ বা ৩০ আসনের হল কনসেপ্ট আমাদের দেশে নতুন। সিনেমা হলের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। এতে প্রযোজকদের লাভ। যত বেশি হল হবে, তত বেশি সিনেমার ব্যবসা হবে। তাই মিনি সিনেপ্লেক্স ব্যাপারটিকে আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি। তবে আসন সংখ্যা এক থেকে দেড়শ’ হলে ভালো হয়।’
চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের মতে আসন সংখ্যার চেয়ে জরুরি একটা ছবি ভালো হলে চলছে কি না। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ভালো হলে চললে ভালো দর্শক আসে। আর দর্শক বেশি মানে বেশি শেয়ার মানি। প্রযোজক তার পুঁজি ঘরে তুলতে পারেন। যেটা এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি জরুরি। তাই আমার কাছে মিনি সিনেপ্লেক্সের ব্যাপারটি দারুণ লেগেছে। আমি যমুনা ব্লকবাস্টার সিনেমাসের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তাদের একটা শো হাউজফুল গেলে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হয়। মিনি সিনেপ্লেক্সগুলোতে হয়তো এত টাকার টিকিট বিক্রি হবে না। কিন্তু অল্প অল্প করে যখন অনেকগুলো হলে ছবি চলবে তখন কিন্তু একটা বড় অংকের অর্থ আসবে।’
এবারের ঈদে দুটি মিনি সিনেপ্লেক্সেই চলছে ‘শান’। ছবিটির পরিচালক এম রাহিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের মতো নতুন নির্মাতাদের জন্য যেকোনো হলই আর্শীবাদ। দিন শেষে ছোট/বড় হল ফ্যাক্ট না। ফ্যাক্ট হচ্ছে দর্শকরা আমাদের ছবি দেখার জন্য ভালো পরিবেশ পাচ্ছে। তারা যখন মিনি সিনেপ্লেক্স বা সাধারণ হলে ভালোভাবে ছবিটা পরিবার-পরিজন নিয়ে দেখতে পারছে তখন আমরা নতুন ছবি নির্মাণের সাহস দেখাই।’
যা চান উদ্যোক্তরা
সরকারের এক হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণে আবেদন করেননি দুটি মিনিপ্লেক্সের কেউই। তবে দুটি হলের কর্তৃপক্ষই বলছে, তারা মিনি সিনেপ্লেক্স ধারণাটি সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চলচ্চিত্রের মানুষ ও সরকারের আন্তরিক সহায়তা চান।
সারাবাংলা/এজেডএস/পিটিএম
নারায়ণগঞ্জ মিনি সিনেপ্লেক্স রুটস সিনেক্লাব সিনেমা ব্যবসার নতুন সম্ভাবনা সিনেমা হলের ব্যবসা সিনেস্কোপ সিরাজগঞ্জ