সুবীর নন্দী : টুকরো স্মৃতির অনুধাবন
৭ মে ২০২২ ১৯:২৭
[দেশবরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দী প্রয়াত হয়েছেন ৩ বছর হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ২০১৯ সালের ৭ মে প্রয়াত হয়েছিলেন সুবীর নন্দী। এতো দ্রুত সুবীর নন্দী জীবনের মায়া কাটিয়ে ওপারে পাড়ি জমাবেন; তা কেউ কল্পনাও করেনি। সবাই আশায় বুক বেঁধে ছিল, এই বুঝি মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফিরে আসবেন তিনি। কিন্তু না, মৃত্যুর চোখ রাঙানি উপেক্ষা করতে পারেননি এই কিংবদন্তি। তার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে সারাবাংলায় স্মৃতিচারণ করেছিলেন সংগীতশিল্পী ও চিকিৎসক ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল। সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দীর ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে সেই লেখাটি পুনপ্রকাশ করা হল।]
মৃত্যুর তেরো বছর আগে শিল্পী সুবীর নন্দীর সাথে পরিচয়। আমি তখন সদ্য পাশ করা নবীন ডাক্তার। কুমিল্লা শহরের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে প্রভাষক পদে শিক্ষকতা করি। মাঝে মধ্যে ঢাকায় আসা-যাওয়া করি। পরিচয় পর্বটি ছিল মজার। ফোনে ঠিক হলো শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টোদিকে মৌলি রেস্টুরেন্টে বসে আমরা কথা বলব।
আমি যথা সময়ে যথাস্থানে উপস্থিত। উনিও এসেছেন। আমি রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটা সাদা করলা গাড়ি থেকে উনি নামলেন, ফরসা টকটকে একজন অভিজাত চেহারার মানুষ। নেমেই বললেন, ‘স্যরি, একটু দেরি করে ফেললাম। বোঝেনই তো ব্যাংকে চাকরি করি।’
আমাদের প্রাথমিক পরিচয় হলো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েই। আমার ভিজিটিং কার্ডটা দিলাম। শিল্পী সুবীর নন্দী বললেন, ‘ওহ আপনি তো ডাক্তার তার উপর শিক্ষক। রেস্টুরেন্টে না, আমার বাসায় চলেন।’
আমি মৃদু আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু সেই আপত্তি টিকলোনা। উনি বললেন ‘বৈদ্য নারায়নকে বাড়িতে না নিলে শীতলা দেবী রুষ্ট হবেন৷’ বলেই একটা ভুবনজয়ী হাসি দিলেন।
রাজি হয়ে গেলাম। রাজি না হয়ে পারা যায়না আসলে। এতটা সম্মান আমার জন্য অপ্রত্যাশিত ছিল। জীবন্ত কিংবদন্তীকে আমি অনুসরণ করতে লাগলাম। তার গ্রীন রোডের বাসায় নিয়ে গেলেন। বৌদির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাকে ড্রইং রুমে বসিয়ে বিশ মিনিট সময় নিয়ে মেয়েকে কোচিং থেকে নিয়ে এলেন। তারপর চেইঞ্জ করে একদম ঘরের পোশাকে গল্প করতে বসলেন। ততক্ষণে দুপুরের খাবারের আয়োজন হলো। এত সহজে একজন নতুন মানুষকে আপন করে নিতে পারে দেখে আমি ভীষণ অবাক হলাম।
খাবার শেষ আমি ড্রইং রুমে বসলাম। সুবীর দা দুজনের জন্য দুই বাটি রসমালাই নিয়ে এলেন। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন ‘কুমিল্লার মানুষ, আপনাকে রসমালাই দিয়েই আপ্যায়ন করলাম। গঙ্গা দিয়ে গঙ্গা পুজো – হা হা হা।’ আমি বললাম- দাদা, চাইলে আপনি আমাকে তুমি করেও বলতে পারেন৷ বয়সে তো অনেক ছোটই। তাছাড়া আমি গানও করি। সেই সূত্রে আমি আপনার ছাত্রতূল্যও বটে।
দাদা, জিব কেটে বললেন, ‘আরে কি বলেন! বয়স যাই হোক। আপনি বড় মানুষ। আপনি ডাক্তার আবার শিক্ষক। আমার বাবা ডাক্তার। আমি ডাক্তারদের অনেক সম্মান করি। আমার মেরুদণ্ডে একটি জটিল অসুখ হয়েছিল কয়েকবছর আগে। ডাক্তাররা অনেক করেছেন আমার জন্য৷ আমি সেই ঋণ ভুলবনা।’
এরপর কথায় কথায় আমরা কাজের কথায় আসলাম। আমি ব্যাগে করে টাকা নিয়ে এসেছিলাম কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে একটি অনুষ্ঠানে উনাকে নেব বলে। সম্মানীর পুরো টাকাই দিয়ে দেব, এটাই ছিল প্ল্যান। উনি নিলেন না। বললেন, ‘নিয়ে যান, যদি অনু্ষ্ঠানে যাই তো সেদিনই দিয়েন। এডভান্স করতে হবেনা। যদি অনুষ্ঠানটি করতে না পারেন তাহলে টাকা ফেরত নিতে আবার ঢাকায় আসতে হবে।’
আমি অবাক হয়ে সুবীর দা’র দিকে তাকিয়েছিলাম। এই লেখার উদ্দেশ্য ভিন্ন। আমি সেদিন দুই ঘন্টা ছিলাম সুবীর নন্দীর বাসায়। এই দুই ঘণ্টা তিনি অনেক গল্প করলেন। সেদিন আমার একটা নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমার দেখা সুবীর নন্দীই একজন সেলিব্রেটি শিল্পী যিনি কখনো তার কোন সহকর্মী শিল্পীকে অশ্রদ্ধা করে কথা বলেননি।
তখন আমার বয়স অল্প। সিনিয়র শিল্পীরা সহশিল্পীদের নিয়ে অশোভন মন্তব্য করতো দেখে একধরণের কৌতুক অনুভব করতাম। তাই ইচ্ছে করে খোঁচাতাম, মজা নিতাম। সুবীর দাকেও খোঁচা দিয়েছি। সেসময় যাদের নিয়ে সব শিল্পীরা কটু মন্তব্য করত তাদের নাম নিয়েছি।
দাদা, আসিফের গান কেমন লাগে?
‘ওহ দারুন ভয়েস।’
একটু বেসুরো না?
‘ওটা তেমন না। দেখবেন যেটুকু আছে গাইতে গাইতে ঠিক হয়ে যাবে।’
আমি একটু হতাশ হলাম। লোকটাকে উস্কানো যাচ্ছেনা।
দাদা মমতাজ কে কেমন লাগে?
‘এক্সিলেন্ট পারফরমার। কি পাওয়ার ওর গলায়!’
কিন্তু উনার গানের কথা তো…
‘সেটা হয়ত সামান্য কিছু থাকতে পারে। কি করবে বলেন? ওর লড়াইটাও আপনাকে দেখতে হবে। কোথা সে কোথায় এসেছে।’
আর শাকিলা জাফর?
‘ও তো আমার বোন। আই ফিল প্রাউড অব হার।’
এন্ড্রু কিশোরকে কেমন লাগে?
‘গোল্ডেন ভয়েস। একজন সত্যিকারের প্লেব্যাক সিংগার। নায়কোচিত কন্ঠ।’
আমাকে শেষ পর্যন্ত হতাশ করলেন সুবীর দা। আমি কোনোভাবেই তার মুখ দিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য বের করতে পারলাম না। একটা নতুন ধরণের অভিজ্ঞতা নিয়ে বের হলাম সুবীর দার বাসা থেকে। সেদিন সন্ধ্যায় জানতে পারি আমাদের অনুষ্ঠানটি করতে দেবেনা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। কারণ আমরা সরকার দলের সমর্থক নই, আর যারা আমাদের অতিথি তারাও বিরোধী পক্ষের বুদ্ধিজীবি-চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত। আমি সাথে সাথেই সুবীরদাকে ফোন দিলাম। দাদা হেসে বললেন, আমি আপনাদের অতিথির নাম শুনেই বুঝেছিলাম অনুষ্ঠানটা করতে পারবেন না। তাই এডভান্সটা রাখিনি।
সুবীরদার শরীরটা কয়েকবছর যাবতই ভাল যাচ্ছিনা। কদিন ধরে ভাবছিলাম দেখতে যাব। নানা ব্যস্ততায় যাওয়া হলোনা। একজন ভাল মানুষ ও শিল্পীর পায়ের কাছে কিছুক্ষণ বসলেও মনটা ভাল হয়ে যায়। যাওয়া হলোনা। আর যাবার দরকার হবেনা। সুবীর দা চলে গেলেন অনন্তলোকে।
লেখক: চিকিৎসক ও সঙ্গীতশিল্পী।
সারাবাংলা/এএসজি
ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল সুবীর নন্দী সুবীর নন্দী : টুকরো স্মৃতির অনুধাবন