কলকাতার অলি গলি এখন সত্যজিৎময়
২২ মে ২০২২ ১৫:১৮
মান্যবর অনীক দত্ত, আপনি যুদ্ধে জিতে গিয়েছেন। ‘অপরাজিত’ বাঙালিদের আবার নতুন করে অক্সিজেনের দিল। আপনাকে কুর্নিশ।
হাতিবাগান পাড়ায় একের পর এক সিনেমা আর থিয়েটার হলের মৃত্যুই গত ১২ বছর ধরে খবর হয়েছে।
সেই হাতিবাগান এলাকার কোনও হলে দুপুরের শো-তে বাংলা সিনেমা হাউসফুল! যে সিনেমায় না আছে পাগলু ড্যান্স, না আছে গান, না আছে নাম করা কোনও হিরো হিরোইন। শহর জুড়ে যাদের বিরাট বিরাট পোস্টার বা কাট আউট দেখা যায়। বা হাসিমুখে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে!
সিনেমার প্লট কী?
তাও চলতি গথ বাঁধা সিনেমার গল্প নয়। বলা যায় রীতিমত বেখাপ্পা, কঠিন বিষয়। কী করে বাংলার ক্ষয়িষ্ণু গ্রাম-জীবনের উপরে ভিত্তি করে লেখা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস পথের পাঁচালীকে আজ থেকে ৬৬ বছর আগে সত্যজিৎ রায় নামে এক তরুন পরিচালক সিনেমার পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন, সেটাই সিনেমার প্লট। এবং গোটা ঘটনাটি অল ইন্ডিয়া রেডিওর স্টুডিওতে সিনেমা পরিচালকের একটা সাক্ষাৎকারের সূত্রে বাঁধা। মাঝে মধ্যেই ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হচ্ছে। সব কিছুই পুরনো দিনের। এমনকি অল ইণ্ডিয়া রেডিওর স্টুডিওটি পর্যন্ত। সেই সময়কে ধরে রাখতে গোটা ছবিটাই সাদা কালোতে নির্মাণ করা হয়েছে। যেমনটি তখন হত।
কিন্তু তাই দেখতে এই দুপুরের দাবদাহে স্টার থিয়েটারের সামনে দীর্ঘ লাইন দেখে কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম। আরও অবাক করার পালা হল ভর্তি দর্শক দেখে। সেই দর্শকের মধ্যে যেমন উত্তম-সুচিত্রা বা সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের ছবি উপভোগ করা বয়স্ক দর্শক আছেন, ঠিক তেমনি ১৮-২৪ এর যুবক যুবতীরাও আছেন। যারা সাবালক হয়েছেন এই নেই রাজ্যের বঙ্গে দেব-জিৎ-নুসরাত আর মিমিকে দেখে। হলফ করে বলতে পারি, এদের অধিকাংশই সত্যজিতের পথের পাঁচালী দেখেননি। এমনকি সত্যজিৎ রায়ের প্রচ্ছদ আঁকা পথের পাঁচালীর প্রথম খণ্ড, যার নাম ‘আম আটির ভেঁপু’, যা পড়ে আমরা ছেলেবেলায় কাঁদতাম, সাতদিন ধরে মন ভারাক্রান্ত হয়ে থাকতো, সেই বইটাও পড়েনি। যে বইটাকে কেন্দ্র করেই সত্যজিৎ রায় অপুর ট্রিলজির প্রথমটি, ‘পথের পাঁচালী’ করেছিলেন। সিনেমায় যা বলা হয়েছে, ‘পথের পদাবলী’।
সত্যজিৎ রায় এই ছবিতে নাম বদলিয়ে যে অপরাজিত রায় হয়েছেন, এবং জিতু কমল সেই ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। সেটা নতুন করে বলার নেই। জিতুর মেকআপ অবিকল সত্যজিৎ রায়কে মনে করিয়ে দেয়। বিশেষ করে তার বিভিন্ন mannerism। কিন্তু কিছু শটে অভিনয় একটু আড়ষ্ট লেগেছে। তুলনায় বিজয়া রায়ের ভূমিকায় সায়নী সাবলীল। জিতুর গলায় ডাব করেছেন চন্দ্রাশিস রায়। বিধান রায়ের ভূমিকায় পরান বন্দ্যোপাধ্যায় মানানসই।
সব থেকে বড় কথা সত্যজিতের পথের পাঁচালীর সাফল্যের পিছনে বিরাট ভূমিকা ছিল নবীন সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্র আর শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্তর। সত্যজিতের অনেক ছবিতেই সুব্রত মিত্রর কাজই ছবিকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। যদিও পরবর্তী কলে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু এই সিনেমায় সুব্রত মিত্রকে প্রাপ্য সেই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। যা অনেকেই জানেন না। পরিচালক তা দর্শকদের জানিয়ে দিলেন।
এই হতাশাময় সময়, যখন বঙ্গের বাঙালির মেরুদণ্ডটা প্রতিদিন আরও একটু করে বেঁকে যাচ্ছে, চারিদিকে শুধুই স্তাবক আর অনুপ্রাণিতদের ভীড় বাড়ছে, তখন পরিচালক অনীক দত্ত কী করে এমন একটি ছবি করার ঝুঁকি নিলেন জানি না। ছবিটির বিষয় বস্তু যা তাতে দুই দিন পরেই হলে মাছি তাড়াতে হলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।
কিন্তু তা হয়নি। এক মিনিটও স্ক্রীনের বাইরে চোখ রাখতে কাউকে দেখিনি। বেশ কয়েকটি দৃশ্য দেখে দর্শকরা হাততালি দিয়েছেন। যা নাটকে দেখা যায়। যেমন বড়ো বড়ো ঘাসের মধ্যে অপুর দুর্গাকে খোঁজা বা দুই ভাই বোন মিলে কাশ বনের মধ্যে দিয়ে রেল গাড়ি দেখতে যাওয়া।
এই ছবি অনেকটাই লিটমাস পেপারের কাজ করলো। তা হলে এখনও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ভালো ছবির বা শিল্পের কদর করে! সেটা স্পষ্ট হল।
সরকার বাহাদুরও বোধহয় পাবলিকের চাপে পড়ে একটু নরম হয়েছে। সম্ভবত চলতি সপ্তাহ থেকে সত্যজিৎ রায়ের স্বপ্নের নন্দনেও ছবিটি দেখা যাবে।
মান্যবর অনীক দত্ত, আপনি জিতে গিয়েছেন লড়াইতে।
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি