Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলা চলচ্চিত্র ধ্বংসের নেপথ্যে

শাকিরুল আলম শাকিল
১৯ জুন ২০২২ ১৪:১২

চলচ্চিত্র একটি শিল্প। একে শিল্পের সমাহারও বলা চলে। এখানে সংমিশ্রণ ঘটে অভিনয়, সংগীত, নৃত্যকলা, চিত্রনাট্যের মতো মৌলিক কয়েকটি শিল্পের। তাই চলচ্চিত্রকে ‘যৌগিক’ শিল্প বলতেও বাধা নেই। চলচ্চিত্রের বিশেষ একটি ক্ষমতা আছে, যা শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমে এতটা প্রকট হয়ে ধরা দেয় না। তা হলো, খুব সহজেই নির্দিষ্ট একটি সমাজ, সময় বা পরিস্থিতির সঙ্গে চলচ্চিত্র বিভিন্ন উপায়ে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, ঘনিষ্ঠ হতে পারে। খুব সহজেই গণমানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে। তাই চলচ্চিত্রকে একটি শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম হিসেবে ধরা হয়। সাহিত্য সামাজের সমসাময়িক অবস্থা, প্রেক্ষাপটকে দর্পণের মতো প্রতিফলন করার সক্ষমতা রাখলেও তা ক্ষেত্রবিশেষে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে না, সব দুয়ারে করাঘাত করার শক্তি রাখে না। তবে চলচ্চিত্র এ বিচারে অনেকটাই সফল। চলচ্চিত্র সর্বমহলে স্বীকৃত। তার দৌরাত্ম্য বেশি, বিস্তৃতি অনেক।

বিজ্ঞাপন

বর্তমান সময়কে কেন বাংলা চলচ্চিত্রের দুঃসময় বলা হচ্ছে, তা জানতে হলে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। ষাটের দশকে আমাদের এ অঞ্চলে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনের সহজাত সরলতা, আন্তরিকতা, প্রেম, মমতা, মূল্যবোধ ও ভালোবাসাকে যেভাবে জীবন উপজীব্য গল্প-কাহিনির মাধ্যমে সহজ-সরল ও পরিচ্ছন্ন ভাষায় তুলে ধরার প্রয়াস দেখিয়েছে, তা রীতিমতো ঈর্ষণীয়। তখন গল্পে জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে, তাতে যেমন ছিল প্রেমময়তা, সারল্য ও নির্মল বিনোদন; তেমনি ছিল গাম্ভীর্য, ভাবের গভীরতা ও সময়ের আবেদন। আর অভিনয়ে ফুটে উঠেছে শৈল্পিকতার চূড়ান্ত ছাপ। প্রযুক্তির বাহাদুরি ছিল না, তবে চিত্রকল্পের শৈল্পিকতা সে ছাপ পড়তে দেয়নি। একথা বলার উদ্দেশ্য হলো, তখনকার চলচিচ্চের নিজস্বতা বলে একটি বিষয় ছিল। চলচ্চিত্রই দর্শকদের রুচি তৈরি করেছে। দর্শক তা সাদরে গ্রহণ করেছে। চলচ্চিত্রের স্বকীয়তা ছিল। দর্শক তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি, বহিরাগত সংস্কৃতি তাকে স্পর্শ করতে পারেনি, বর্জুয়া অর্থনীতি তাকে দমাতে পারেনি। বরং তা জনবান্ধব হয়ে দর্শককেই প্রভাবিত করেছে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়েছে। জীবনবোধ, সমাজ-সামাজিকতার প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরেছে; ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের সংগতি-অসংগতিগুলোকে তুলে ধরেছে। তাই দর্শক তাকে গ্রহণ করেছে সানন্দে।

বিজ্ঞাপন

বর্তমান সময়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের সব থেকে বড় ব্যর্থতা হলো তা দর্শকের রুচি তৈরি করতে পারছে না। কারণটাও পরিষ্কার। চলচ্চিত্র তার স্বকীয়তা হারিয়েছে। দর্শক যা গিলছে, দেদারসে যা চলছে—পরিচালক, প্রযোজকগণও সেদিকেই ঝুঁকছেন। তাই সংগত কারণেই চলচ্চিত্রে বাড়ছে বিনোদনের ভাগ, কমছে শৈল্পিক মান। এ সময়ের অধিকাংশ দর্শকের মেধা-মনন নান্দনিকতা বিবর্জিত। তাই তাদের চাওয়া-পাওয়ায় যে শৈল্পিক আবেদন থাকবে না—তা স্বাভাবিক। কিন্তু দর্শকের চাওয়া-পাওয়া মেটানোই তো চলচ্চিত্রের একমাত্র ধর্ম নয়, বরং সময়-সমাজ-সামাজিকতার আশা-আকাঙ্ক্ষা, আবেদন-নিবেদনের প্রতি দৃষ্টিপাত করাই তার বিশেষত্ব।

এবার প্রশ্ন দাঁড়াল, এখনকার চলচ্চিত্র কেন স্বকীয়তা হারাচ্ছে? জবাবে কয়েকটি বিষয় সামনে আসে। আমাদের চলচ্চিত্রে কাহিনি বা চিত্রনাট্য থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে নায়ক-নায়িকা, হেতু-অহেতুক মারপিটের দৃশ্য, কৌতুকের নামে ভাঁড়ামিকে, যা চলচ্চিত্র ও দর্শকের মধ্যে তৈরি করছে দূরত্ব। দর্শকের অভিযোগ চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে না, অন্য পক্ষে নির্মাতারা বলছেন ‘বাজার সংকট’, ‘স্বল্পবাজেট’, ‘ক্ষুদ্র বাজার’ এবং ‘সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব’। এই রেষারেষিতে নির্মাতারা ঝুঁকছেন বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি। নকলের চেষ্টা করছেন হলিউড, বলিউড থেকে। কিন্তু দক্ষ জনবল, পেশাদারিত্ব, দক্ষতা, কলাকৌশল আর প্রযুক্তির অভাবে তাও হচ্ছে না পুরোটা। ফলে যা দাঁড়াচ্ছে, তা ‘হ য ব র ল’ অথবা ‘জগাখিচুড়ি’। যার নিজস্বতা, স্বকীয়তা বলে কিছুই থাকছে না।

বিনোদন প্রাধান্য দিয়ে আমাদের দেশে মূলধারা এবং মূলধারার বাইরেও অনেক ছবি তৈরি হয়েছে। এই ধরনের ছবি হয়তো বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছে; কিন্তু দর্শককে নতুন কিছু দিতে পারেনি, সমাজকে কোনো ম্যাসেজ দিতে পারেনি। তাই দর্শকপ্রিয় হয়েও টিকতে পারেনি। মোট কথা, চলচ্চিত্র শিল্প যদি দর্শকের আত্মার সঙ্গে সম্পর্ক স্হাপন করতে না পারে, সমসাময়িক বাস্তবতাকে নিয়ে ভাবতে না পারে, সমাজকে নিকট ভবিষ্যত্ নিয়ে বার্তা দিতে না পারে, তবে শত চেষ্টাতেও তাকে টিকিয়ে রাখা যাবে না।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বাংলা চলচিত্র ধ্বংসের নেপথ্যে মুক্তমত শাকিরুল আলম শাকিল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর