Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অনুদানে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের প্রতি বৈষম্য দূর হোক

রাকিবুল হাসান
১৯ জুন ২০২২ ১৮:১১

ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশের মানুষ, প্রকৃতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস, সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদানে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সচিত্র প্রামাণ্য ইতিহাস আমরা জানতে পারি মূলত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র থেকেই। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের যে ভাষণের ভিডিও দেখি সেটাও একটা প্রামাণ্যচিত্র। অথচ সরকারি অনুদানে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র আজ উপেক্ষিত। গত কয়েক বছর এই শাখায় একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকেও সরকারি অনুদান প্রদান করা হয়নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। বিশ শতকের শুরুতে এই উপমহাদেশে প্রথম প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ হয়েছিলো মানিকগঞ্জের হীরালাল সেনের হাতে। মানিকগঞ্জের বগজুড়ি গ্রামের বিবাহোৎসব এবং স্নানার্থীদের নিয়ে নির্মিত হয়েছিলো সেই প্রামাণ্যচিত্র। ১৯৪৮ সালে নাজীর আহমেদ ‘ইন আওয়ার মিডস্ট’ নামে একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন যা ‘৪৭-এর দেশভাগের পর এই অঞ্চলের প্রথম প্রামাণ্যচিত্র। এই অঞ্চলের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র ‘সালামত’ নির্মিত হয় ১৯৫৪ সালে। পরিচালক নাজীর আহমেদ তার বাড়ির রাজমিস্ত্রী সালামতের জীবনকাহিনি নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ্য ছিল ৪ হাজার ফিট।

বিজ্ঞাপন

৬০-এর দশকে সৈয়দ বজলে হোসেনের পরিচালনায় নির্মিত হয়েছিলো ‘সারমনস ইন ব্রিক’। এটি কম্বোডিয়ার নমপেন চলচ্চিত্র উৎসবে এবং ‘ওয়ান একার অব ল্যান্ড’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে সার্টিফিকেট অব মেরিট পুরস্কার পেয়েছিলো। এছাড়া তার নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘নিউ হরাইজন’, ‘সিম্ফনি অব সিজনস’ এবং ‘লেট ওয়াক টুগেদার’ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত এবং প্রশংসিত হয়েছিলো।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম ৪টি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরি হয় ১৯৭১ সালে কলকাতায়। জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড, এ স্টেট ইজ বর্ন, আলমগীর কবিরের লিবারেশন ফাইটার্স ও বাবুল চৌধুরীর ইনোসেন্ট মিলিয়নস। পাকিস্তানিদের গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবহিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ত্বরান্বিত করার পেছনে এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। এই চারটি প্রামাণ্যচিত্রকে বলা হয় ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র’।

দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৩ সালে নির্মিত আলমগীর কবিরের প্রথম কাহিনিচিত্র ‘ধীরে বহে মেঘনা’-তে ছিল প্রামাণ্যচিত্রের মিশ্রণ। ১৯৮৯ সালে চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জীবন-কাজ নিয়ে নির্মিত হয় তারেক মাসুদের অভিষেক প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘আদম সুরত’।

নব্বই এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং স্বৈরাচার পতনের পর প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে যেনও নবপ্রাণের সঞ্চার ঘটে। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম এবং গ্যাটে ইন্সটিটিউটের প্রযোজনায় মানজারে হাসীন, তানভীর মোকাম্মেল এবং তারেক মাসুদ নির্মাণ করেছিলেন ‘কৃষ্ণনগরে একদিন’। ১৬ মিমি ফরম্যাটে ৫৩ মিনিটের এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের পরিচালনা উপদেষ্টা ছিলেন ক্রিস্তব হুবনার। ১৯৯৪ সালে শামীম আখতার, শাহীন আখতার এবং মকবুল চৌধুরীর পরিচালনায় ইউম্যাটিক ক্যামেরায় নির্মিত হয় ৪০ মিনিটের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘গ্রহণকাল’। এতে ফতোয়াবাজদের ভণ্ডামি তুলে ধরা হয়েছে।

১৯৯৫ সালে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মাণ করেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’ যা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রামাণ্য দলিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন জয় বাঙলা নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মার্ণের কাজ শুরু করেছিলেন কিন্তু তা শেষ করতে পারেননি। লিয়ার লেভিনের সেই ফুটেজ উদ্ধার করে নির্মিত হয় ‘মুক্তির গান’। ৩৫ মিমি ফরম্যাটে নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির দৈর্ঘ্য ছিল ৮০ মিনিট। ১৯৯৬ সালে মানজারে হাসীন নির্মাণ করেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘রোকেয়া’। ‘মুক্তির গান’ দেশব্যাপী প্রদর্শনের সময় ওই ফিল্ম ইউনিট নির্মাণ শুরু করেন আরেক প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির কথা’। এতে সব সাধারণ মানুষের যুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা উঠে আসে। ‘মুক্তির কথা’ মুক্তি পায় ১৯৯৬ সালে। একই বছরতানভীর মোকাম্মেল নির্মাণ করেন ‘অচিন পাখি’।

১৯৯৭ সালে ‘চারুকলায় মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামে একটা প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন মানজারে হাসীন। ১৯৯৯ সালে তারেক শাহরিয়ার নির্মাণ করেন ৩০ মিনিটের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘কালিঘর’। ২০০০ সালে ইয়াসমিন কবির নির্মাণ করেন ‘পরবাসী মন আমার’। ২০০১ সালে নির্মিত হয় সাজ্জাদ জহিরের ‘মৃত্যূঞ্জয়ী’ এবং কাওসার চৌধুরীর ‘প্রতিকূলের যাত্রী’। ২০০২ সালে বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগের ঘটনা নিয়ে ইয়াসমিন কবির নির্মাণ করেন ‘স্বাধীনতা’। এই সময়ে কাওসার চৌধুরী নির্মাণ করেন ‘সেই রাতের কথা বলতে এসেছি’। ২০০২ সালে শামীম আখতার নির্মিত ‘শিলালিপি’ ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের বায়োপিক। ২০০৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী-বাঙ্গালীদের সমস্যা নিয়ে তানভীর মোকাম্মেল নির্মাণ করেন ‘কর্ণফুলীর কান্না’।

২০০৭ সালে বেশ কিছু প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। মানজারে হাসীন ও অশোক কর্মকার নির্মাণ করেন ‘কালরাত্রি ‘। একই বছর তানভীর মোকাম্মেল নির্মাণ করেন তিনটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘তাজউদ্দীন আহমদ: নিঃসঙ্গ সারথী’, ‘বস্ত্রবালিকারা’ এবং ‘স্বপ্নভূমি’ । ফৌজিয়া খান নির্মাণ করেন ‘গঠিত হই শূন্যে মিলাই’। শাহীন দিল রিয়াজ নির্মাণ করেন ‘লোহাখোর’।

২০১১ সালে নির্মিত হয় তানভীর মোকাম্মেলের ৪ ঘন্টার প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘১৯৭১’। ২০১১ সালে ১৯৪৭-এর বাংলাভাগের উপর ভিত্তি করে তানভীর মোকাম্মেল নির্মাণ করেন ‘সীমান্তরেখা’। ২০১৫ সালে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিপ্লবের পুরো চিত্র ক্যামেরায় ধারণ করে মানজারে হাসীন মুরাদ নির্মাণ করেছেন ৯৬ মিনিটের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘এখনো ৭১’।

বাংলাদেশে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস এতটাই সমৃদ্ধ যে এই লেখায় তার মধ্য থেকে সামান্যই উপস্থাপিত হয়েছে। ম. হামিদ, ফরিদুর রহমান, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, রাজিয়া কাদির, আমিনুল ইসলাম, আমিনুর রহমান বাচ্চু, মঈনুল হুদা, শবনম ফেরদৌসী, হুমায়রা বিলকিস, রফিকুল আনোয়ার রাসেল, সুমন দেলোয়ার, আবিদ হোসেন খানসহ বহু নাম জড়িয়ে আছে বাংলাদেশে নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের সাথে।

সেই গৌরবময় ইতিহাসের প্রামাণ্যচিত্র আজ উপেক্ষিত। সরকারি অনুদানের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সরকারের প্রস্তাব আহ্বানের ঘোষণায় বলা হয়ে থাকে-‘বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখবে এবং একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন জীবনমুখী, রুচিশীল ও শিল্পমানসমৃদ্ধ গল্পের চলচ্চিত্রকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।’ আবহমান সংস্কৃতি, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের চেয়ে ভালভাবে আর কোথায় উপস্থাপিত হতে পারে?

সরকারি অনুদানে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের প্রতি বৈষম্য দূর হোক।

লেখক: শিক্ষক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ শর্টফিল্ম ফোরাম

সারাবাংলা/এজেডএস

চলচ্চিত্রে অনুদান প্রামাণ্য চলচ্চিত্র রাকিবুল হাসান শর্টফিল্ম ফোরাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর