Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দেশীয় ওটিটির রাজত্ব বাড়ছে, কেমন করছে তারা

আহমেদ জামান শিমুল
১১ জুলাই ২০২২ ১৮:৫৪

প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আমূল বদলে গেছে বিনোদন কনটেন্ট প্রদর্শনের পদ্ধতিতে। এ ক্ষেত্রে ওভার-দ্য-টপ তথা ওটিটি পরিণত হয়েছে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় বিনোদন প্ল্যাটফর্মে। বাংলাদেশেও ২০১৭ সাল থেকেই দেশীয় ওটিটি প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করে। তবে ২০২০ সালের আগ পর্যন্তও বলা চলে এগুলো চলছিল অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ তাদের জন্য হয়ে আসে আশীর্বাদ। ঘরবন্দি মানুষের কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা মোবাইল স্ক্রিনে বিনোদনের প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয় ওটিটি। এর আগ পর্যন্তও নেটফ্লিক্স বা হইচইয়ের মতো বিদেশি প্রতিষ্ঠান দাপটের সঙ্গে বাজার দখলে রাখলেও এই সময়ে এসে দেশীয় ওটিটিগুলো বাজার ধরতে শুরু করে। দেশের বাজারে এখন বলা চলে দেশীয় ওটিটিগুলোই রাজত্ব করছে।

বিজ্ঞাপন

দেশের ওটিটি বাজার কতটুকু বড়

দেশ-বিদেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোতে নিয়মিত বাংলা কনটেন্ট প্রযোজনা করেন কোয়াইট অন সেট প্রোডাকশন্সের প্রধান নির্বাহী রাফায়েল আহসান। তিনি জানালেন, এই মুহূর্তে দেশীয় সবগুলো ওটিটি প্ল্যাটফর্ম মিলে গ্রাহক (সাবস্ক্রাইবার) সংখ্যা ২০ লাখের কম নয়।

রাফায়েল সারাবাংলাকে বলেন, দেশের সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকারী ৬ কোটির মতো। এর মধ্যে ৫০ লাখের মতো মানুষ ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সম্পর্কে জানেন কিংবা কোনো না কোনো সময় তারা ওটিটিতে সাবস্ক্রাইব করেছেন খেলা দেখার জন্য কিংবা পছন্দের কোনো কনটেন্ট দেখার জন্য। এখন আমাদের চ্যালেঞ্জের জায়গাটি হলো তাদের নিয়মিত সাবস্ক্রাইবারে পরিণত করা। ব্যবসায়িক কৌশল নির্ধারণ করে যথাযথভাবে চেষ্টা করলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ২ কোটিতে নেওয়া সম্ভব।

গ্রামীণফোনের প্রতিষ্ঠান বায়োস্কোপের ডিজিটাল কনটেন্ট এক্সপার্ট মাহে নও রওনক শ্রেয়সী জানালেন, মানুষকে তারা আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন নানামুখী কনটেন্ট দিয়ে। এর মধ্য থেকে নিয়মিত গ্রাহক পাওয়াটাকে চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তারা। তারপরও গ্রাহকসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে— এ বিষয়টি নিয়ে তারা আশাবাদী।

ওটিটি ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, যেসব ওটিটি প্ল্যাটফর্মের বাজেট কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা, তারা বছরে ৫০-৬০টি করে কনটেন্ট নির্মাণ করছে। এগুলো থেকে বছরে আয় ৭০ কোটি টাকার মতো। দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে চরকি, বায়োস্কোপ, বঙ্গবিডি ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। সে হিসাবে তারা এখনো বিনিয়োগ পর্যায়েই আছে।

রাফায়েল আহসান বলেন, নেটফ্লিক্স, জিফাইভ বা অ্যামাজনের মতো বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মগুলো তো একদিনে কয়েক কোটি গ্রাহক পায়নি। যার যত বেশি বৈচিত্র্যময় কনটেন্ট আছে, তাদের গ্রাহক তত বেশি। আমাদের ওটিটিগুলো সে হিসাবে মাত্র যাত্রা শুরু করেছে। তাদের লাইব্রেরিও সমৃদ্ধ হচ্ছে ধীরে ধীরে।

বিজ্ঞাপন

থ্রিলার ও ক্রাইম-মিস্ট্রিতে বেশি প্রাধান্য

ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কনটেন্টগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বৈশ্বিক ওটিটিগুলোর মতো দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও থ্রিলার ও ক্রাইম-মিস্ট্রি ঘরানার কনটেন্টগুলোই বেশি জনপ্রিয়। ফলে এ ধরনের কনটেন্টই তৈরি হচ্ছে বেশি। রাফায়েল আহসান বলেন, প্ল্যাটফর্মগুলো খুললে হয়তো মনে হবে আমাদের দেশে খুন-খারাপি, পরকীয়া ছাড়া গল্প নেই। মনে হবে এখানে কোনো প্রেম নেই, পরিবার নেই বা অন্য কোনো গল্প নেই। বিষয়গুলো আমরা যারা প্রযোজনা করছি কিংবা পরিচালনা বা প্ল্যাটফর্মগুলো যারা চালাচ্ছে, সবাই বুঝতে পারছি। এজন্যই যেমন সম্প্রতি আমরা প্রযোজনা করলাম ‘পেটকাটা ষ’-এর মতো হরর সিরিজ। এসব ধারাতেও ধীরে ধীরে অনেকেই ঝুঁকছেন।

তবে ভিন্ন ধরনের বা বৈচিত্র্যময় কনটেন্ট তৈরির দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন বায়োস্কোপের ডিজিটাল কনটেন্ট এক্সপার্ট মাহে নও রওনক শ্রেয়সী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আমরা হয়তো জনপ্রিয় ধারার কনটেন্টগুলো ইদের মতো বড় উৎসবের জন্য রেখে দিই। কিন্তু এর বাইরে ফ্যামিলি ড্রামা বা সোশ্যাল বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক কনটেন্ট আমরা নিয়মিত নিয়ে আসছি।

সিনেম্যাটিক অ্যাপের পরিচালক তামজিদ অতুলও বলেন, আমরা কিন্তু শুরু থেকে দেশীয় গল্পের কনটেন্ট নির্মাণ করছি। পিওর বাংলাদেশি গল্পকে আমরা সবচেয়ে বেশি প্রধান্য দিচ্ছি। আমাদের ‘জানোয়ার’ কিংবা ‘ট্রল’ কিন্তু এর বড় উদাহরণ।

পরিচালনায় নবীন-প্রবীণ মেলবন্ধন

শুরুর দিকে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে রাজত্ব করা পরিচালকদের বাইরে যেতে চায়নি দেশের কোনো ওটিটি প্ল্যাটফর্মই। শিহাব শাহীন ও সুমন আনোয়ারের মতো প্রতিষ্ঠিত পরিচালকরাই শুরুতে গুরুত্ব পেয়েছেন। তবে ধীরে ধীরে সেই ধারাতেও এসেছে পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তনের পথ বেয়ে আবরার আতাহার, সৈয়দ আহমেদ শাওকী, মোহাম্মদ তাওকীর ইসলামের মতো একদমই অপরিচিত তরুণ নির্মাতারাও উঠে এসেছেন পাদপ্রদীপের আলোয়।

মাহে নও রওনক শ্রেয়সী ও তামজিদ অতুল জানাচ্ছেন, প্রবীণ-নবীন সবাইকে নিয়েই তারা কাজ করছেন। এ ক্ষেত্রে পরিচালকের নাম নয়, গল্পটা যারা ভালোভাবে পর্দায় তুলে আনতে পারছেন, প্রধান্য দিচ্ছেন তাদেরই। এ ক্ষেত্রেও একদম হালে তরুণ নির্মাতারাই গুরুত্বটা বেশি পাচ্ছেন।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে রাফায়েল বলেন, প্রতিষ্ঠিত নির্মাতা যারা, যাদের কাছে পরিচানলাই রুটি-রুজি, তাদের অনেকেই ইচ্ছা করে ওটিটিকে এড়িয়ে চলছেন। দেখা যায়, ওটিটির জন্য একটি কনটেন্ট নির্মাণে প্রি-প্রোডাকশন থেকে শুরু পোস্ট প্রোডাকশন শেষ করা পর্যন্ত চার-পাঁচ মাস সময় দিতে হয়। তাড়াহুড়ো করলেও ৯০ দিন লাগবেই। এই সময় দেওয়াটা টেলিভিশনে নিয়মিত কাজ করা একজন পরিচালকের পক্ষে দেওয়া কঠিন। কারণ তাদের সঙ্গে টেলিভিশনেরও বিভিন্ন চুক্তি থাকে। এই সুযোগে তরুণ পরিচালকরা উঠে আসছেন। এ ক্ষেত্রে আমরা যে প্রতিষ্ঠিত ও প্রবীণ পরিচালকদের প্রতি আগ্রহী নই, বিষয়টি তেমন নয়।

তরুণ নির্মাতারা কাজের পরিমাণে এগিয়ে গেলেও নির্মাণে এখনো তাদের মুন্সীয়ানা আয়ত্তে আসেনি বলেও অবশ্য মনে করছেন রাফায়েল। তিনি বলেন, আমি যখন রায়হান খানের ‘দৌড়’ প্রযোজনা করলাম, তখন বুঝলাম অভিজ্ঞ নির্মাতারা কতটুকু ভালো গল্প গাঁথতে পারেন। তরুণরাও যে পারবেন না, তা না। তারাও হয়তো দুই-তিনটি কাজ করার পর শিখে যাবেন।

গল্প বলার স্বাধীনতা বেড়েছে

চলচ্চিত্র কিংবা টিভি পর্দার তুলনায় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নির্মাতারা অনেক বেশি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন বলে মনে করেন তরুণ নির্মাতা রায়হান রাফি। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যে গল্পটি সিনেমার পর্দায় বলতে পারি না, সেটি অনায়সে ওটিটিতে বলতে পারছি। আবার সব গল্প হয়তো বড় পর্দায় ভালো লাগবে না, কিন্তু আমি বলতে চাই। তার জন্য হয়তো টিভি আমাকে বাজেট দেবে না। সেটি নির্মাণের সুযোগও কিন্তু ওটিটিতে পাচ্ছি। ইচ্ছামতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারছি। বলতে পারেন, নির্মাতা হিসেবে আমাদের স্বাধীনতা বেড়েছে।’ কেবল পরিচালকের স্বাধীনতা নয়, এর মাধ্যমে প্রযোজকের বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তাও তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

কনটেন্ট নির্মাণে স্বাধীনতার সঙ্গে আরও অনেককিছুর যোগসূত্র দেখছেন নির্মাতা শিহাব শাহীন। তিনি বলেন, টেলিভিশনে আমরা চাইলেই অনেক কিছু দেখাতে পারতাম না। সে তুলনায় আমরা অনেক বেশি পরিমাণে স্বাধীনতা পেয়েছি। সেটিকেও অবশ্য আন্তর্জাতিক মানের বলা যায় না। এর পেছনে ওটিটিগুলোর সদিচ্ছার অভাব রয়েছে, তা নয়। এর পেছনে ‘অনুভূতিতে আঘাতে’র বিষয়টি সবার আগে দায়ী। কারণ কখন কাকে আপনি খারাপ দেখাবেন আর তার পেশাজীবী সবার মধ্যে অনুভূতিতে আঘাত লেগে যাবে, এটি কিন্তু সবাইকেই মাথায় রাখতে হয়।

শিহাব শাহীন, অনন্য মামুন, সুমন আনোয়ারসহ বেশ কয়েকজন পরিচালকের কনটেন্ট বিষয়বস্তুর কারণে অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল। পরে ওই কনটেন্টগুলো সংশোধিত আকারে প্রকাশ করতে তারা বাধ্য হন। এটি নির্মাতার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে রাফায়েল বলেন, সমস্যা সব জায়গাতেই থাকে। আমরা এর মধ্য দিয়েই কাজ করছি। যতটুকু সম্ভব নিয়মের মধ্যেই থেকে সবকিছু দেখাচ্ছি।

মাহে নও রওনক শ্রেয়সীও এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেক দর্শকই বলেন— বিদেশি অমুক সিরিজের মতো কনটেন্ট কেন বানান না আপনারা। আমি চাইলেই তো তাদের মতো সবকিছু দেখাতে বা বলতে পারি না। এর মধ্য দিয়েই আমাদের নির্মাতারা তাদের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।’

একটু ভিন্নমত জানিয়ে তামজিদ অতুল বলেন, ‘প্রত্যেক দেশেরই নিজস্ব সংস্কৃতি ও আইন আছে। আমদের কারও-ই এর বাইরে কিছু করা উচিত না।’

সারাবাংলা/এজেডএস/টিআর

কেমন করছে চরকি দেশীয় ওটিটি বঙ্গবিডি বায়োস্কোপ রাজত্ব

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর