আবার হবে তো দেখা?
২৪ অক্টোবর ২০২২ ১৩:৩৬
প্রতি বছরের মতো আবারো এলো বিষন্ন কার্তিক। কলকাতার কফি-হাউসে আজো বসেছে আড্ডা। ধুমায়িত কফির কাপে উঠছে ঝড়। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাত ভরে আছে পদচারণায়। মেট্রো চলছে, ট্রাম চলছে। আকাশে বিদায়ী শরতের মেঘদল, হেমন্তের পরিণত হতে যাচ্ছে। কলকাতা থেকে মুখ ফেরাই বিহার রাজ্যের গয়া’র দিকে। যেখানে বুক চিরে বয়ে চলছে ফলগু নদীর অদৃশ্য চোরাস্রোত। প্রকৃতির এইরকম মন উতলা দশায় আবার এলো বাংলা গানের মহীরুহ মান্না দে’র প্রয়াণ দিবস (২৪ অক্টোবর)। শুধু কি কলকাতা? না। পোড়া গাড়ির কালো ধোঁয়ার মতো আকাশ যেমন ঝড়ের আগের ভয়াল রূপ ধরে তাকিয়ে থাকে, তেমনি হৃদয়ভাঙ্গা হাহাকার নিয়ে এসেছে আজ, মান্না দে।
না, মনের কথাই বলি। এক গানের পাখিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মান্না দে’কে কেমন লাগে? উত্তর পাইনি। কিন্তু জল হওয়া মেশানো উত্তর পেয়েছিলাম, তার নির্বাক, অস্ফুট স্বরে গাঢ় নীরবতার অব্যক্ত ভাবটির নামই মান্না দে। রাতের সুরের আবেশ ছড়ানো গানের পাখি দিন শেষে খাঁচার পাখি হয়ে যায়। পাখির বুকে জাগে হাহাকার। সেই তুলনাহীন হাহাকারের প্রতিধ্বনি শুনতে পেতো মান্নার কণ্ঠে। তাই, তার কাছে নীরবতাই মান্না দে। কিংবা গুনগুন নদীর স্বরে গেয়ে উঠার নামই মান্না দে। কিংবা কাছের প্রেম আর দূরের ভালোবাসার মধ্যে টানাপোড়েনই মান্না দে। না; মান্না দে কী নয়, সেটাই তাহলে প্রশ্ন। মান্না কি তাই, যখন ফুল গাছ থেকে তরুণীর খোঁপা হয়ে তরুণের হাত ঈশাণকোণের বায়ুমণ্ডলে রাজত্ব কায়েম করে? মান্না কি তাই, যখন বাতাস চঞ্চল, চিত্ত চঞ্চল কিন্তু তীব্র বিষাদের মতো ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হয় প্রেমিকপ্রবরের হৃদয়ে? মান্না কি তাই? কোনো ব্যর্থ প্রেমের আবেগ হয়ে কাছে-দূরের তিক্ত মানুষের দিকে আরো একবার পরাজিতের চেহারা নিয়ে তাকাতে বলে? তা যদি হয়, তবে মান্না দে এই ভালোবাসার বাংলার। মান্না এসেছে কার্তিকের এই হৃদয় উতালপাথাল করা প্রকৃতিতে।
যুগ পাল্টেছে। এখনকার কিশোররা বেসুরের পিঠ বেয়ে বেয়ে অচেনা ও কল্পনার জগতে ঢুকে পড়তে চায়। কল্পনার জীবন আর স্বপ্নের নায়ক-নায়িকার আদল তাদের সাথে মেলে না। টেলিভিশন, মোবাইল, ফেসবুক প্রযুক্তির কবলে আমাদের অতো সময় কই যে, মনকে শান্ত করে দু’টি মান্না দে শুনবো? দৃশ্যসংস্কৃতি বা ভিজ্যুয়াল কালচারে বুঁদ হয়ে মান্না দে এখন অনেকটাই গলিত-স্থবির। তবুও কানে বাজে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের রিইউনিয়নে ‘কফি হাউজের সেই আড্ডা’র স্মৃতিমেদুরতা।
আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগের কথা। মনে তখন বসন্ত আসি আসি দশা। ছেলের রোমান্টিক দশা দেখে বাবা হদিস দিলেন একটি নিটোল প্রেমের সিনেমা; তিন ভুবনের পারে। বখাটে নায়ককে কিভাবে খাটে তোলা যায়, তারই নিটোল প্রেমের ছবি। গলির মুখে পাড়ার সুন্দরী মেয়েটিকে কী ভীষণ ভালোবাসার দৃষ্টি-আকর্ষণ করা যায়, তারই দারুণ দৃশ্যায়ন। ফুটবল খেলায় শিল্ড জেতে ফেরার সময় মাতাল তরুণের দলের ‘জীবনে কী পাবো না..’ গান গাওয়ার সিনেমা তিন ভুবনের পারে। সেই ‘তিন ভুবনের পারে’ সিনেমার সৌমিত্র-তনুজার প্রেমের রসায়ন দেখে প্রেমে পড়েনি বা পড়ে ব্যথা পায়নি, এমন তরুণ খুব কম। সেই গানের নেপথ্যে স্বর দিয়েছেন কে? আর কেউ নয়- মান্না দে।
মান্না আসলে একজন নয়। বাঙালি যতদিন প্রেমে পড়বে, পড়ে ব্যাথা পাবে, ব্যাথায় আহা-উহু করবে, ততবারই মান্নার খোঁজ নেবে। মান্না দে হাজার-হাজার, লাখো-লাখো। বাংলা সঙ্গীত অনুসারীরা ‘জীবনে কী পাবো না’ বলে যখন উঁকি দিয়ে দেখে যে ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’ আর নেই, তখন কোথাও না কোথাও হাহাকার উঠে যে ভালোবাসার জন্য “ক’ফোঁটা চোখের জল’ ফেলছি আমরা? মান্না এমন এক সুরের জাদুকর, যিনি আফসোস রেখে বলেন- ‘আবার হবে তো দেখা’? কিংবা ‘যদি কাগজে’ লেখা নাম ছিড়ে যায়, তবে হৃদয়ে লিখতে বলে তিনি দেখাতে পারেন বিহারের গয়ায় মাটির নিচে নীরব অভিশপ্ত ফল্গু নদীর যাতনা। কারো কাছে কি ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে’ ফেসবুকের ব্লক লিস্ট থেকে কাউকে মুক্তি দিয়ে- ‘তুমি কি সেই আগের মতো আছো?’
প্রিয় মান্না দে, তুমি আমার কৈশোর পরিপূর্ণ করেছিলে। তুমি বলেছিলে হৃদয়ে কারো নাম লিখে রাখতে। কিন্তু হৃদয়ে দেখি, লেখা আছে আজো তোমারই নাম। সে নাম থেকে যাবে আজীবন। বিহারের ফলগু নদীর তীরে গিয়ে শুধু ভেবেছি তোমারই কথা। নীরবে বয়ে যাওয়া ফলগু স্রোতের সাথে মানুষের মনের এমন বিচিত্র উপমা, তোমার পক্ষেই সম্ভব। নানাবিধ বিবেচনায় তোমার শ্রেষ্ঠ গান আমার কাছে ‘জীবনে কী পাবো না’। এরপর ‘কফি হাউস’। কিন্তু, যখন শুনি প্রেমের সেই ঐতিহাসিক গাণিতিক হাহাকার, “ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ?” তখন, ক্যালকুলেটরে ফোঁটা গুণতে বসে যাই। ডিজিট ধরে না ওই ক্যালকুলেটর মেশিনে! আমি তো নিজের মুখে স্বীকার করেই একজনের শিকার হয়েছিলাম, তাই তোমার মতো গাইতে হয়েছিলো ‘দুঃখ পেলেও খুশি হলাম জেনে’।
পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা আনন্দবাজার পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক অনমিত্র চট্টোপাধ্যায় দাদা বছর দুয়েক আগের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা থেকে প্রখ্যাত সাংবাদিক রূপায়ন ভট্টাচার্যের ‘হৃদয়ে লেখো নাম’ নামে একটি বইয়ের খোঁজ দেন। অনমিত্র দা’র খোঁজে বইটি হাতে না উঠলে এই মান্না আমার কাছে থাকতো অচেনা, অজানা। রূপায়ণ ভট্টাচার্য’র এক-একটি লাইন কেমন যেন বুকের মধ্যে গেঁথে যায়। রূপায়ন বাবু বলছেন- মান্নার রোমান্টিক বাংলা গান তিনটি সিংহদরজা খুলে দিয়েছেন। স্মার্টনেস, নাটকীয়তা ও বৈচিত্র্যে। তিনি লিখেছে, মান্নার স্বরক্ষেপন এক নতুন দিগন্ত তৈরি করেছে বাংলা গানে৷ যে কারণে নব্বইয়ের দরজায় পৌঁছেও মান্না রোমান্টিক গান করেছেন৷ ঘনিষ্ঠরা কেউ বলেছেন, এত বেশি বয়সে প্রেমের গান মানায়? মান্না উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘প্রেমের কোনও বয়স হয় নাকি? শরীরের বয়স বাড়লেও মনের বয়স বাড়ে না৷’ তার পরে স্বচ্ছন্দে গেয়েছেন, ‘তুমি চিঠি লিখে ভুলে গেলে, জুড়ে দিতে খাম৷ আমার হলো না সে চিঠি পড়া, শুধু হলো বদনাম৷’
পরিশেষে বলি, নিজে বাঙালি তরুণ বলেই মনে হয়- ‘শুধু তুমি’ থাকে না বলেই আলো জ্বলে না? হয়তো ‘তোমার প্রেমের যোগ্য আমি’ নই বলেই কি অযোগ্যের ভিড়ে হারিয়ে ফেলো আমাকে? এসব জটিল রসায়নের উত্তরের খোঁজে আবার যেতে হবে বিহারের গয়ায় ফলগু নদীর কাছে। কিন্তু আমি সুর, স্বর, অন্তরা, সঞ্চারী কিছু বুঝি না। বুঝি শুধু কালো ঝর্ণাধারার মতো তোমার উন্মুক্ত চিবুকের উপর নেমে আসা খোলা-চুলের ভালোবাসা। সুরের ঝড় তোলা পাখিটি আমাকে কিচিরমিচির করে বলে, মান্না দে’র গাওয়া ‘আমি যে জলসা ঘরে’, ‘আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে’- এতো রাগ নয় গো- গানগুলি যতই শুনি ততই মনে দাগ কাটে। আর আমি, বনশ্রীর তুফান দেখে বারবার স্বাদ হয় মহাভারতের হলধর বলরামের মতো নাঙল কাঁধে ছুটে যাই তোমারই তৃষিত জমিতে। জানি না, কী জিতবো না হারবো। কারণ, ভালোবেসে রাজা বা ফকির দুই-ই হওয়া যায়। সবাই পারে না। কেবল ‘হৃদয় আছে যার, সেই তো ভালোবাসে’! তাই তোমারই ভালোবাসায় জেগে থাকি চিরকাল- ‘হয়তো তোমারই জন্য’! পারদের মতো মেজাজ উঠে নামে বলে পারদশ্বেরী। পারদের কোণে বিদায়বেলায় চির-জিজ্ঞাসা রয়ে যায়- ‘আবার হবে তো দেখা’?
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সারাবাংলা/এজেডএস