শিল্প সবসময় প্রেমের কথা বলে। ভালোবাসা, মানবতা, দায়িত্ববোধ শেখায়। খুলে দেয় চিন্তার বন্ধ দুয়ার। কুসংস্কারকে মাটিচাপা দেয়। মানুষকে পায়ের শিকল ভেঙ্গে সামনে এগোতে শেখায়। আর শিল্পের সাতটি শাখার সবকটির সমন্বয়ে চলে চলচ্চিত্র। তাই তো চলচ্চিত্রকে বলা হয় সবচেয়ে বড় গণমাধ্যম। অথচ দেশের এ মাধ্যমটি আজ অনেকটাই পথভ্রষ্ট। পথহারা পথিকের মতো গেলো দুই দশক ধরে দিশা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কেউ নেই তাকে হাত ধরে টেনে নেওয়ার।
এ দেশের চলচ্চিত্র গেল কয়েক বছর ধরে ব্যস্ত ছিলো নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ খেলায়। আর ২০২২ জুড়ে ছিলো শিল্পী সমিতির নির্বাচনের সাধারণ সম্পাদক পদে জায়েদ খান নাকি নিপুণ কে আসল দাবিদার তা দিয়ে। একের পর এক অভিযোগে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আইন আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে এ দাবি। নায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে প্রযোজক জেনিফার ফেরদৌসের বাকবিতন্ডা ও শাকিব-বুবলি সন্তান-বিয়ে নিয়ে লুকোচুরি মুখরোচক আলোচনার বস্তু হয়েছে। সাধারণ মানুষের ভাষ্যে, এখন চলচ্চিত্রে শিল্পের চেয়ে অপশিল্পের চর্চা হয় বেশি।
করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ চলচ্চিত্রের ভয়াবহ করুণ অবস্থা গিয়েছে। রুগ্ন শিল্প আইসিইউতে স্থানান্তরের অবস্থা হয়েছিলো। আইসিইউতে প্রবেশের ঠিক আগ মুহূর্তে মৃদু স্বরে চলচ্চিত্র বলেছে, না আমার প্রাণশক্তি এখনও নিঃশ্বেষ হয়নি। শুধু একটু অক্সিজেন দাও। নিঃশ্বাসটা ঠিকঠাক নিতে দাও। আমার এখনো তোমাদের দেওয়ার অনেক কিছু বাকি রয়েছে।
১৯৫৬ সালের ৩ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাত ধরে দেশের যে শিল্পের আনুষ্ঠানিক যাত্রা, সেটি ২০১২ সালের একই তারিখে ‘শিল্পে’র স্বীকৃতি পায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। এখনও ‘মুমুর্ষে এ শিল্পে’র পালে ‘পরান’ ও ‘হাওয়া’ আসে সঞ্জীবনী হিসেবে। এ দেশের হল মালিকরা যেখানে ভুলে গিয়েছিলো ব্যবসা কী জিনিস, সেখানে তাদেরকে ছবিগুলোর পরিবেশকদের দুয়ারে ধর্ণা দিতে হয়েছে পাশের হলটির আগে যেনো তাকে আগে ছবিগুলো দেওয়া হয়। ঈদুল আযহায় মুক্তি পাওয়া ছবি দুটি অনেক বছর পর দেশের চলচ্চিত্রের সত্যিকারের ‘হিট ছবি’।
এর মধ্যে তো ‘হাওয়া’ বিদেশে বাংলাদেশি ছবির মধ্যে বিশাল রেকর্ড করে ফেলে। বিদেশে ছবিটির পরিবেশক সংস্থার দেওয়া তথ্যে প্রথম বাংলাদেশি ছবি হিসেবে এটি একসঙ্গে শতাধিক হলে দেশের বাইরে মুক্তি পায়। একই সঙ্গে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ডলারের মতো আয় করে। যা কিনা এ দেশের ছবির জন্য সুখবর। ‘আদিম’-এর মস্কো জয় কিংবা ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’-র কলকাতা জয়ের খবরও চলচ্চিত্রপ্রেমীদেরকে স্বপ্নকে বড় করতে সাহস জোগায়।
বিদেশি ছবির অনুকরণ অনুসরণ ছাড়া এ দেশে ছবি হিট বা আলোচিত হয় না—এমন ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছেন রায়হান রাফি, এস এ হক অলিক, মেসবাউর রহমান সুমন, মোস্তাফিজুর রহমান মানিক, মাহমুদ দিদার, মুহাম্মদ কাইয়ুম কিংবা আশুতোষ সুজনরা। এদের মধ্যে রাফি, সুমন ও অলিক ব্যতীত অন্যদের ছবিগুলো ব্যবসায়িক সফলতা না পেলেও পেয়েছে সমালোচকদের ভালো মন্তব্য।
বাণিজ্যিক সিনেমার ভাষাও পরিবর্তন হয়েছে বলা যায়। ‘শান’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’, ‘গলুই’, ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’, ‘দামাল’ এক্ষেত্রে অগ্রণী। আরেকটি চোখে পরার মতো পরিবর্তন এক নায়ক নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসা। এ বছর শরিফুল রাজ একচেটিয়া রাজত্ব করেছেন বলা যায়। সে তুলনায় শাকিব বা সিয়াম আহমেদরা অনেকটাই মলিন ছিলেন। তবে ভয়াবহ সংকটের একটি জায়গা তৈরি হয়েছে, তা হলো মীম ব্যতীত অন্য নিয়মিত নায়িকারা চলচ্চিত্রে অনিয়মিত হয়ে পরা— কেউ রাজনীতিতে, কেউ সংসার নিয়ে, কেউবা পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত!
দেশে একের পর মাল্টিপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে এ বছর। স্টার সিনেপ্লেক্সই তাদের ষষ্ঠ শাখার উদ্বোধন করেছে। সবমিলিয়ে দেশে মাল্টিপ্লেক্স সংখ্যা ১৪টি। এ সংখ্যা ২০২৩ এ ৪০-এর কোঠায় গিয়ে ঠেকবে। হয়তো পুরানো সব মুছে দিয়ে নতুন করে শুরুর আভাস হিসেবে এ নবজাগরণ। হয়তো চলচ্চিত্র আবার ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠতে যাচ্ছে। কিন্তু গেল কয়েক বছর ধরে আশা জাগিয়ে আবার পরের বছর লজ্জায় লাল হয়ে যেতে হয়। ২০২৩-এ হয়তো আর মুখ লুকাতে হবে না। আশা করতে তো দোষ নেই।