ফান্ড না থাকায় গেল ঈদের আগেও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিলো। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ফান্ড আসার পরে বেতন বোনাস হয়েছে। গেল কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি এভাবে অর্থ ধার করে চলতে হচ্ছে। অথচ এক সময় প্রতিষ্ঠানটি চলতো নিজেদের আয়ে।
এক সময়ের স্বাবলম্বী প্রতিষ্ঠান আজ রুগ্ন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সূতিকাগার প্রতিষ্ঠানটির প্রযোজকদের কাছে পাওনা রয়েছে ২১ কোটি ৩৯ লাখ ৩২ হাজার ৩০৪ টাকা। কিন্তু এ অর্থ আদায়ে প্রযোজকদের চিঠি দিয়েও আদায় করতে পারছে না এফডিসি। কারণ অধিকাংশ ঠিকানায় ভুল বলে জানিয়েছে এফডিসি কর্তৃপক্ষ।
এফডিসি কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, ডিজিটাল যুগে প্রবেশের আগে অধিকাংশ ছবির শুটিং হতো এখানে। শুধু শুটিং না, ছবি নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত ফিল্মের নেগেটিভ, পজেটিভ সবই এখান থেকে নিতে হতো। নির্মাণ পরবর্তী সকল সুযোগ সুবিধাও এখানে পাওয়া যেত। ফলে এফডিসির আয়ের কোনো কমতি ছিল না। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা প্রযোজকদের তিন পদ্ধতিতে শুটিং সুবিধা দিতেন। এগুলো হচ্ছে পি-ফিল্ম, সেমি পি-ফিল্ম ও জেনারেল।
পি-ফিল্ম পদ্ধতিতে একজন প্রযোজককে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা জমা দিয়ে এফডিসির তালিকাভুক্ত হতে হতো। এতে করে তিনি ছবির নেগেটিভ থেকে শুরু করে অন্যান্য জিনিস ও সার্ভিস বাকিতে নিতে পারতেন প্রযোজক। যা কিনা ছবি মুক্তির আগে পরিশোধ করে দিতে হত। দু-একটা ব্যতিক্রম ব্যতীত সকল ছবির ফাইনাল প্রিন্ট হত এফডিসির ল্যাবে। ফলে বকেয়া পরিশোধ না করে প্রযোজক কোনো প্রিন্ট নিতে পারতেন না।
সেমি পি-ফিল্ম পদ্ধতিতে প্রযোজক ২ লাখ ৩০ হাজার জমা দিয়েছে এফডিসির তালিকাভুক্ত হতেন। তিনি শুটিং ফিল্মের নেগেটিভ বা পজেটিভ কোনটাই পেতেন না। তবে বাকিতে ফ্লোর ভাড়া পেতেন। অন্যদিকে জেনারেল ক্যাটাগরিতে একজন প্রযোজক সমস্ত কাজই নগদ অর্থে করতেন।
প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট বিভাগ সারাবাংলাকে জানাচ্ছে, ডিজিটাল হওয়ার পর থেকে প্রযোজকদের এফডিসিকে ওই অর্থে কোনো বাকি দিতে হয়নি। যার কারণে টুকটাক কোন পাওনা থাকলেও তা ওইভাবে আলাদা করে ফাইল করা হয়নি। যে ২১ কোটির অধিক অর্থ পাওনার কথা বলা হচ্ছে তা মূলত ৩৫ মি.মি. ফিল্মের যুগের প্রযোজকদের কাছে পাওনা।
বকেয়া পরিশোধ না করতে পারলে তো ছবির প্রিন্ট পাওয়ার কথা না। তাহলে ৯৮টি ছবি মুক্তি এবং ৪০টি ছবি সেন্সরে জমা পড়লো কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে এফডিসির হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. হেমায়েত হোসেন বলেন, দেখা যেত একই প্রযোজকের একাধিক ছবি তখন আমাদের এখানে কাজ হতো। তখন তিনি তার বাকি ছবিগুলো জামানত রেখে একটি ছবির মুক্তির জন্য প্রিন্ট নিয়ে যেতেন। পরবর্তীতে ওই ছবিগুলো হয়তো মুক্তি পায়নি কিংবা সেন্সরে আটকে গেছে। তখন প্রযোজকরা আর ওই বকেয়া পরিশোধ করেননি।
আপনারা কি তাদের নোটিশ দেননি? মো. হেমায়েত হোসেন জানান, তারা অসংখ্যবার আইনি নোটিশ দিয়েছেন। কোনো কাজ হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক কর্মকর্তা জানান, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশ সমিতির কাছে এ ব্যাপারে সহায়তা চেয়ে বেশ কয়েকবার চিঠি দিয়েছে এফডিসি। কিন্তু তারা এর কোনো উত্তর দেননি। তিনি জানান, অধিকাংশ প্রযোজক যে ঠিকানা কাগজপত্রে দিয়েছেন সেখানে তাদেরকে পাওয়া যায় না।
তবে এ অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন প্রযোজক নেতারা। সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম খসরু ও সামসুল আলম দুজনেই জানালেন তারা চিঠির জবাব দিয়েছেন।
খোরশেদ আলম খসরু বলেন, ‘এফডিসি পর্ষদের মিটিংয়ে কয়েক বছরে আগে আমরা বলেছিলাম, যে ছবিগুলো বকেয়া হয়েছে তার বেশির ভাগই আটকে গেছে ৩৫ মি.মি. থেকে ডিজিটালে হুট করে রূপান্তরের কারণে। ছবিগুলো শেষ করতে না পারায় মুক্তি দেওয়া যায় নি। আবার তখন মুক্তি দিতে পারলে প্রযোজকরা ভালো টাকা পেতেন। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব না। তাই আমাদের প্রস্তাব ছিলো এফডিসি তাদের কাছে সার্ভিস চার্জ বাবদ যে টাকা পায়, তা মওকুফ করে দিয়ে শুধু র মেটারিয়ালের বিলটা নেওয়ার। তখন সেটি ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে পাশ করে আমাদেরকে জানানোর কথা ছিল। ’
সামসুল আলম বলেন, ‘এফডিসি যদি আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী পাওনা টাকার একটা অংশ মওকুফ করে দিত তাহলে প্রযোজকরা টাকা ফেরত দিতে পারতো। কারণ তারাও তো ক্ষতিগ্রস্থ। আবার অনেক প্রযোজক মারাও গেছেন। জীবিত প্রযোজকদের অধিকাংশই চান টাকাটা ফেরত দিতে। কিন্তু তার আগে তো একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।’
খালি চিঠি ও মামলার হুমকি দিয়ে এ টাকা আদায় হবে না বলে দাবি করেন খোরশেদ আলম খসরু। তিনি বলেন, টাকা আদায়ে কিন্তু উদ্যোগ নিতে হবে এফডিসিরই। আমরা শুধু সহায়তা করতে পারবো।
সারাবাংলার কাছে আসা নথিপথ থেকে দেখা গেছে, সর্বমোট ৩১৯ টি ছবির প্রযোজকের কাছে এফডিসির এ পাওনা। এ ছবিগুলোর মধ্যে ৯৮টি ছবি মুক্তি পেয়ে গেছে। যাদের কাছে পাওনা ৪ কোটি ৩৪ লাখ ১৪ হাজার ৫৪৭ টাকা। সেন্সর হয়ে গেছে বা জমা পড়েছে কিন্তু মুক্তি পায়নি এমন ছবির সংখ্যা ৪০টি। যাদের কাছে পাওনা ৫ কোটি ৪০ লাখ ৮২ হাজার ১৬৬ টাকা। পি-ফিল্ম ক্যাটাগরির ৪০টি ছবির কাছে পাওনা ৪ কোটি ৯৪ লাখ ১ হাজার ৮৭৮ টাকা। সেমি পি-ফিল্ম ক্যাটাগরির ৩৯টি ছবির মধ্যে ৩৬টি ছবির কাছে পাওনা ৩ কোটি ৫৭ লাখ ৭ হাজার ২৮৪ টাকা। বাকি টাকা জেনারেল ক্যাটাগরির ১০২টি ছবির কাছে পাওনা।
সর্বোচ্চ পাওনা পি-ক্যাটাগরিতে অপূর্ব কথাচিত্রের ‘ভয়ংকর ডেঙ্গু’ ছবির প্রযোজকের কাছে ২৭ লাখ ১৭ হাজার ৪৫৩ টাকা। সর্বনিম্ন পাওনা ২৫ আগস্ট ১৯৮৭ সালে মুক্তি প্রাপ্ত রবিন ফিল্মসের ‘অসহায়’ ছবির প্রযোজক এম এ মান্নানের কাছের ১১ হাজার ৯৫২টাকা। এছাড়া এ তালিকায় প্রখ্যাত সাংবাদিক, চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজক আহমেদ জামান চৌধুরীরও নাম রয়েছে। তার প্রযোজিত ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘যাদুর বাঁশী’ ছবির কাছে পাওনা ৫৬ হাজার ১১৫ টাকা। গড়ে প্রতি প্রযোজকের এফডিসির পাওনা সাড়ে ৬ লাখ টাকার অধিক।