নির্বাচনী গান কারা গায়, কারা বানান
৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৯:০৬
নির্বাচন মানে এদেশে উত্তেজনা, উৎসব, অন্যরকম উন্মাদনা। প্রার্থীরা ভোটাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য বেছে নেন পোস্টারিং, মাইকিং, সরাসরি ভোট চাওয়াসহ আধুনিক প্রযুক্তির। সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্ত হয়েছে গান। যা প্রচারণায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ‘জয় বাংলা, জিতবে আবার নৌকা’ গানটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই সবাই তাদের নির্বাচনী প্রচারনায় গানের ব্যবহার শুরু করেন। এ কাজগুলো কারা করেন, জাতীয় নির্বাচনে কেমন তাদের ব্যস্ততা? জানার চেষ্টা করেছে সারাবাংলা।
মিরপুরে অবস্থিত স্টুডিও মাইকওলার কর্ণধার এ আর তারিক কথা বলেন সারাবাংলার সঙ্গে। তিনি ২০১৬ থেকে রেকর্ডিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তিনি জানান, এবারের জাতীয় নির্বাচনে এখন পর্যন্ত ৭০টির বেশি গান তার স্টুডিও থেকে রেকর্ডিং হয়েছে। তিনি বলেন, ‘অর্ডার পাওয়ার একদিনের মধ্যে আমরা গানগুলো ডেলিভারি দিই। আমরা সাধারণ সময়ে ৩ জন কাজ করি। যখন কাজ বেশি থাকে তখন ৫-৭ জন কাজ করি। কাজ বেশি আসলে অন্য স্টুডিওকে সাব কন্ট্রাকে দিয়ে দিতে হয়।’
২৪ ঘণ্টার মধ্যে গান লিখে, সুর করে, ট্র্যাক বানিয়ে, রেকর্ডিংসহ ফাইনাল আউটপুট কীভাবে সম্ভব? রহস্যের উন্মোচন করলেন তারিক। তিনি বলেন, ‘মূলত গানগুলো প্রচলিত বিভিন্ন জনপ্রিয় গানের ট্র্যাকের উপর গাওয়া হয়। ফলে সুর ও ট্র্যাক প্রস্তুতের ব্যাপার থাকে না। তাছাড়া গানের কথাও আগে থেকে আমাদের প্রস্তুত করা থাকে। আমরা প্রার্থীর নাম ও মার্কা নতুন করে শিল্পীকে যুক্ত করে রেকর্ডিং করি।’
একদিনে তারা ৫-১০টি পর্যন্ত গানের রেকর্ডিং করে বলে জানালেন। গান প্রতি বাজেট ৩ থেকে ৫ হাজার থাকে বলে জানালেন তারিক। তবে পল্টনের আরেকটি রেকর্ডিং স্টুডিং জানালো তারা দেড় হাজার থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে কাজ করেন।
এত কম বাজেটে কীভাবে পোষাণ তারা? ‘মূলত ব্যবসাটি সিজনাল। আর যখন আসে একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ আসে। এজেন্টের মাধ্যে প্রতিদিন ৫-১০টা করে কাজ আসে। তাতে করে পুষিয়ে যায়। তবে জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমাদের লাভটা বেশি হয়’,─বলেন তারিক।
জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে ইউনিয়ন নির্বাচনে লাভ বেশির কারণের ব্যাখ্যায় তারিক বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী কতজন? সব মিলিয়ে দেড় হাজার। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদই তো সারাদেশে ৫ হাজারের উপরে। প্রতিটিতে ওয়ার্ড কয়টা। তাহলে কী পরিমাণ প্রার্থী হয়। তখন আমরা অতিরিক্ত লোক নিয়োগ দিয়ে কাজ করাই।’
তিনি আরও জানান জাতীয় নির্বাচনে গানের কাজ কম হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, গানগুলো সাধারণত প্রার্থীদের কাছের ব্যক্তিরা তাদেরকে উপহার দেয়। অন্যদিকে ইউনিয়ন কিংবা পৌরসভা বা সিটি নির্বাচনে প্রার্থী নিজেই গানই করাতে আগ্রহী হন। বিশেষ করে গেল ইউনিয়ন নির্বাচনে এটি প্রার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর আগে এ প্রবণতা ছিল না।
পুরো দেশে শতাধিক রেকর্ডিং স্টুডিও রয়েছে এ ধরনের নির্বাচনী গানের কাজ করে থাকে। যার বেশির ভাগের অবস্থান ঢাকার পুরানো পল্টন এলাকায়। বাকিগুলো মিরপুর ও গাজীপুরে। এদের কাছে কাজগুলো আসে এজেন্টদের মাধ্যমে। দেশের বিভিন্ন মাইকিং ও অডিও সিডির দোকানদাররা তাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। সাধারণত গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে তারা ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গানগুলো ডেলিভারি দিয়ে থাকেন।
এ গানের শিল্পী কারা? তাদের পারিশ্রমিক কেমন?
হবিগঞ্জের শিল্পী কৃপেশ এখন পর্যন্ত ৪ শতাধিক নির্বাচনী গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তিনি জানান, যখন টিভিতে বা মঞ্চে কাজ থাকে না তখন মূলত নির্বাচনী গানে কণ্ঠ দেন। নির্বাচনি একটি গানে তিনি ২ হাজার করে পারিশ্রমিক পান।
পল্টনের স্টুডিও মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা গান প্রতি শিল্পীদের ৩০০-৫০০ এর বেশি দিই না। একদিনে একজন শিল্পী ৫-১০টি গানে কণ্ঠ দেন। তবে মৌলিক গান হলে সেক্ষেত্রে তো বাজেট ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠে। তখন স্বাভাবিকভাবে শিল্পীদের পারিশ্রমিকও সমানুপাতিক হারে বাড়ে।
কৃপেশের কাছে প্রশ্ন ছিল এধরনের গান করাতে কি শিল্পী হিসেবে কোন প্রকার সমালোচনার সম্মুখীন হন কিনা? ‘না, তা হই না। আর তাছাড়া গানগুলো তো নির্বাচনের পরে আর কোথাও বাজে না। তাই সমস্যা হয় না’,─বলেন কৃপেশ।
দেশের বিয়েবাড়ি বা নানান সামাজিক অনুষ্ঠানে হিন্দি গানের প্রধান্য দেখা যায়। তবে এখানে তার উল্টো। দেশি লোকগানের প্রচুর চাহিদা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য─গ্রামের নও জওয়ান, বুক চিন চিন করছে হায়, আগে কী সুন্দর কাটাইতাম, কী দিয়া মন কারিলা, মরার কৌকিলা, খাইরুন লো। ভারতীয় গানের মধ্যে ‘খেলা হবে’ বেশি ব্যবহৃত হবে। এছাড়া গজল, জারী গানের সুরেও অনেক প্রার্থী গান চান।
নারী কণ্ঠে মমতাজের কণ্ঠের বেশি চাহিদা। মজার ব্যাপার হচ্ছে মাঠে ময়দানে তার গলায় যত নির্বাচনী গান বাজে একটিও তার গাওয়া নয়। এগুলো গেয়েছেন নাজমীন নাজু নামক একজন শিল্পী। এ শিল্পী জানান, তিনি এখন পর্যন্ত ২০ হাজারের মত নির্বাচনী গান গেয়েছেন।
তবে গান করাতে গিয়ে অনেক প্রার্থী প্রতারণারও শিকার হয়েছেন─এমন অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি স্বীকার করে নেন স্টুডিও মাইকওলার তারিক। তিনি বলেন, মূলত কিছু অনলাইন ভিত্তিক ফেসবুক পেইজ এধরনের প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত। আমরা যারা পুরাতন তারা এ ধরনের প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত নই। তাই সবাইকে বলবো বুঝে শুনে লেনদেন করতে।
যখন নির্বাচন থাকে না, তখন কী করে এ স্টুডিওগুলো? তারেক জানান, তারা তখন নানা ধরণের ডকুমেন্টারির ভয়েস ওভার, বিজ্ঞাপনের ভয়েস ওভার, মাইকিং, ডাবিং, গান রেকর্ডিং ইত্যাদির কাজ করে থাকেন।
সারাবাংলা/এজেডএস