Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যুবরাজ প্রস্থানের চার বছর


২০ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৪:১২

খায়রুল বাসার নির্ঝর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

যুবরাজের সঙ্গে শেষ দেখা ২০১৩ সালে, জুনের এক তপ্ত দুপুরে। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের ধানমন্ডি শাখার তিন তলায় বসে ছিলেন চুপচাপ। এ প্রতিষ্ঠানের ফাইন্যান্স ডিরেক্টর হিসেবে চাকরি করতেন খালেদ খান। পাশাপাশি নাটকের ওপর একটি কোর্সও পড়াতেন। খালেদ খানের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন দিনের সূর্য প্রায় মাথার ওপর। বাইরের রাস্তায় প্রচণ্ড কোলাহল, অসহ্য রোদ। কিন্তু তার অফিস কক্ষটা ছিলো অদ্ভুত রকমের নীরব। যেন পৃথিবীর সব নীরবতা এসে পরম সুখে ঘুমাতো ওখানে! শান্তশিষ্ট এ জায়গাটিকে বড় আপন করে নিয়েছিলেন খালেদ খান। দিনের প্রায় ১২ ঘণ্টা ওখানেই কাটাতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওটাই ছিলো তার সেকেন্ড হোম।

বিজ্ঞাপন

রুমে ঢুকতেই, চোখে চোখ পড়তেই সেই চেনা মিষ্টি হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘শরীর বেশি ভালো না। এখন আর ইন্টারভিউ দিতে মন সায় দেয় না। তবু তুমি এসেছ, কী কী জানার আছে বলো।’ তার হাত দু’টো ছিলো নিস্তেজ। বয়স বাইশ-পঁচিশের এক তরুণ থাকতো আশপাশে। খালেদ খানের মোবাইলে কল এলেই সে ছুটে আসতো। কানে এয়ারফোন পরিয়ে দিয়ে, ফোন রিসিভ করিয়ে দিলেই তবে কথা বলতে পারতেন যুবরাজ। তার ভাবলেশহীন শান্ত কণ্ঠ শুনে বড্ড খারাপ লাগছিলো। বলেছিলাম, ‘ইন্টারভিউ নিতে না, যুবদা। আপনাকে দেখতে এসেছি।’ যুবদা হয়তো খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমার অবস্থা তো দেখছো। চলাফেরা করতে পারি না, সারাদিন নিজের মতো থাকি।’

এক ভক্তের গল্প শুনিয়েছিলেন খালেদ খান। শারীরিক চেকআপের জন্য তিনি ডাক্তারের চেম্বারে গিয়েছিলেন এর কিছুদিন আগে। চলাফেরা করতেন তো হুইল চেয়ারে। তাকে চেয়ারবন্দি দেখে প্রায় ২৫ ছুঁই ছুঁই বয়সের এক মেয়ে বারবার তাকাচ্ছিলো। হয়তো মনে করার চেষ্টা করছিলো মানুষটির সঙ্গে ঠিক কোথায় দেখা হয়েছে আগে! বেশ কিছুক্ষণের তীব্র চেষ্টায় নিজের স্মৃতিশক্তির ওপর আস্থা হারানোর পর মেয়েটি শরণাপন্ন হলো ডাক্তারের। ডাক্তার মেয়েটাকে নিশ্চিত করলেন- জ্বি, উনিই খালেদ খান। বাংলা নাটকের যুবরাজ।

বিজ্ঞাপন

তারপর মেয়েটি খালেদ খানের পায়ের কাছে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো সেদিন। প্রিয় অভিনেতাকে এভাবে হুইল চেয়ারে প্রায় নিথর অবস্থায় দেখে মোটেই ভালো লাগেনি তার। ভালো লাগেনি খালেদ খানের নিজেরও। তার অসুস্থতায় কষ্ট পাচ্ছেন ভক্তরা; শারীরিক অসুস্থতার চেয়েও এ কষ্ট অনেক বড়! ওই বয়সেও চোখ ফেটে কান্না বের হয়ে আসতো যেন! তিনি তাই জনসমক্ষে যেতে চাইতেন না খুব একটা। যতটা সম্ভব নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা ছিলো সব সময়, ভেতরে ভেতরে।

অসুস্থ হওয়ার পর খালেদ খানের জীবনের চিরাচরিত অনেক কিছুই বদলে গিয়েছিলো। চোখ বন্ধ করে সুরের তালে একটু একটু করে তলিয়ে যাওয়ার আগ্রহটা কমে গিয়েছিলো। অথচ একটা সময় কী ভালোবাসাটাই না ছিল গানের প্রতি! পরিবারের দুটি মানুষ- স্ত্রী মিতা হক ও মেয়ে জয়িতা দেশের সংগীত জগতে পরিচিত মুখ হওয়া সত্ত্বেও গানের প্রতি হঠাৎ এই অনাগ্রহে মাঝেমধ্যে অবাক হতেন খালেদ খান নিজেও। বই পড়ার অভ্যাসটাও ছেড়ে দিয়েছিলেন। অথচ অসুস্থ হওয়ার আগে রাত-দিনের অনেকটা সময় চোখ লেগে থাকত বইয়ের পাতায়। ছেড়েছিলেন টিভি দেখাও। হয়তো খারাপ লাগতো, কষ্ট হতো নিজের অক্ষমতায়! দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলেছিলেন, ‘এখন আগের মতো শরীর পেরে ওঠে না আর। যতই দিন যাচ্ছে, ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। অনেক কিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছি। এ এক দুরারোগ্য ব্যাধি। ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যত দিন বেঁচে আছি এভাবে প্যারালাইজড হয়েই জীবনটা কাটাতে হবে।’ খালেদ খান কথা বলতেন আস্তে ধীরে, ছোট ছোট শব্দে।

এই যে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, একা করে দেয়া নিজেকে- এর আড়ালে ছিলো গভীর বেদনা। পুরনো দিনের যন্ত্রণা। সেই আলো-আঁধারের মঞ্চ, রিহার্সেল, ক্যামেরা, লাইট- হয়তো হাতছানি দিয়ে যেতো বারবার। স্বপ্নে খালেদ খান হয়ে উঠতেন রূপনগরের হেলাল অথবা রক্তকরবীর বিশু। অবচেতনে আওড়ে যেতেন জনপ্রিয় সেই সংলাপ, ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ তুমি এত খারাপ!’

তাই আর মাত্র একটিবারের জন্য হলেও মঞ্চে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। নাগরিক নাট্যদলের দর্শকপ্রিয় অসংখ্য নাটকের যেকোনো চরিত্র নিয়ে মঞ্চে ওঠার ইচ্ছা ছিলো তার। এই স্বপ্নের কথা বলে তক্ষুণি আবার চুপসে গিয়েছিলেন, সামলে নিয়েছিলেন নিজেকে- ‘কিন্তু শরীরের যা অবস্থা! এতোটা ধকল তো নিতে পারবো না!’

সেদিন আধঘণ্টার সেই আলাপ শেষে, বিদায় দেওয়ার মুহূর্তে বলেছিলেন, ‘অবশ্য আমার কোনো আফসোস নেই!’

জুনের এই সাক্ষাতের মাস কয়েক পর খালেদ খানের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর ২০, আজকের দিনে, পৃথিবী থেকে বিদায় নেন বাংলা নাটকের যুবরাজ! শেষ হয় একটি অধ্যায়।

সারাবাংলা/কেবিএন/পিএম

খালেদ খান