Friday 21 Feb 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হুমায়ূন ফরীদির অভাব কি পূরণ হয়েছে?

সুমন বৈদ্য
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৩৩ | আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১২:২২

ফিরিবার পথ নাহি; দূর হতে যদি দেখ চাহি; পারিবে না চিনিতে আমায়; হে বন্ধু বিদায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষের কবিতার এই লাইনগুলো কষ্ট, তীব্র বেদনার কথা মনে করিয়ে দেয়। ঠিক তেমনি ২০১২ সালের (১৩ ফ্রেব্রুয়ারি)এমন সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতার মতোই সবাইকে তীব্র কষ্ট, বেদনায় নিমজ্জিত করে বিদায় নেন এক কিংবদন্তি। বেঁচে থাকলে হয়তো ৭৩ বৎসরে পা দিতেন। সেই সাথে বিশ্ববাসী পেতো আরও বৈচিত্র্যময় চরিত্র। সেই কিংবদন্তিটি আর কেউ নন, তিনি হুমায়ূন ফরীদি। যাকে অভিনয়ের বিশ্ববিদ্যালয় বললেও যে কোনো অংশে ভুল হবার নয়।

বিজ্ঞাপন

‘হুমায়ূন ফরীদি’ নামটার সাথে অনেক অভিনয়ের চরিত্র সংমিশ্রণ হয়ে মিশে আছে। অভিনয়ে নিজেকে সবসময় রেখেছেন অনন্য, করেছেন নিজেকে আলাদা সবার থেকে। এদেশে তার মতো মেধাবী অভিনেতা কমই এসেছেন। যিনি অভিনয়কে বাস্তব জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িয়ে ফেলছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন তার অভিনয়ের বড়ত্ব কোথায়! কেনো তার মতো করে অভিনেতা এখনো তৈরি করতে পারলো না ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। তা নিয়ে থাকছে তার শাহাদাতবার্ষিকীতে থাকছে সুলুক সন্ধান।

কোনো অভিনেতার সম্পর্ক জানতে হলে প্রথমেই আসে তার অভিনীত কোন সিনেমা নাম এবং সেই অভিনয়ের উক্ত আলোকপাত বা সমালোচনা। কিন্তু হুমায়ূন ফরীদিকে যদি জানতে চাওয়া হয় তাহলে তার অভিনীত কালজয়ী সিনেমা চোখের সামনে উঠে আসবে না। যদিও বিষয়টি অনেক দুঃখ ব্যতিত হতে পারে। তবে হুমায়ূন ফরীদি অভিনয়ের তালিম বা জন্ম কিংবা এককথায় পরিচয় জানতে চাওয়া হয় তাহলে আসবে টেলিভিশন নাটকের কথা। যা দিয়ে তিনি সবার কাছে পরিচিতি পান।

বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবে সুনিশ্চিত। তার ফাঁসির খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মুনা। তিনি তখন সাদা শার্ট, হাতে কায়দা করে ধরা সিগারেট নিয়ে বসে থাকা এক উকিলের সামনে। যার কথা বলার ধরণ কখনো গম্ভীর আবার কখনো চাপা। সেই উকিলটিই হলেন হুমায়ূন ফরীদি। অভিনয়ের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং চরিত্রের শিল্পায়ন করা ব্যক্তি হুমায়ূন ফরীদিকে চিনলাম।

মঞ্চনাটকের মাধ্যমেই অভিনয়ের হাতেখড়ি হয় হুমায়ূন ফরীদির। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো তার এই মঞ্চনাটকের অভিনয় উপভোগ করার সৌভাগ্য আমার যেমন হয়নি, ঠিক তেমনি এই প্রজন্মের কারোরই হয়নি তা নিঃসন্দেহে বলা যেতেই পারে। জসীম কিংবা মান্না অভিনীত চলচ্চিত্রে নেতিবাচক চরিত্রে এবং জীবনধর্মী ধারার গল্প নিয়ে টেলিভিশন নাটকে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে চিনি।

বিজ্ঞাপন

অভিনয় করা চরিত্রের প্রতি ভালোবাসায় হল চরিত্রের প্রতি শিল্পায়ন‌। এই কাজটি হুমায়ূন ফরীদি খুবই সংবেদনশীলতার সাথে করতেন। এই কথাটি বলার কারণ হলো, পর্দায় অভিনয় আর নাটকের অভিনয় যে আকাশ পাতাল তফাৎ সেই ব্যাকরণটি হুমায়ূন বুঝিয়ে ছিলেন। বুঝিয়েছেন চরিত্রকে কেনো ভাঙ্গতে হয়। নিজের মৌলিকত্ব ভুলে গিয়ে সিনেমার চরিত্রকে আপন করা কতোটা জরুরি তিনি সেটা বুঝিয়েছেন। বাংলাদেশের অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে খুব কমজনের ভেতরেই বিষয়টি আছে, অর্থাৎ দুই পর্দায় দুই রকমভাবে নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ার বিষয়টা।

হুমায়ুন ফরীদির অভিনীত অনেক সিনেমায় রয়েছে। তার অভিনয়ের যে একটা সাবলীলতা এবং একটা যে সহজাত ব্যাপার, তা অনেক ক্ষেত্রেই প্রকাশ পায়। তার সিনেমার প্রসঙ্গে যদি কথা বলতে বলা হয় তাহলে আসবে ‘আনন্দ অশ্রু’ সিনেমায় অভিনীত দেওয়ান শরীফের চরিত্র। আগেই বলেছি হুমায়ূন ফরীদির বিশেষ গুণ তা হলো চরিত্রের সাথে শিল্পায়ন করা। তারেই একটি প্রমাণ হলো দেওয়ান শরীফ চরিত্র।

নেতিবাচক চরিত্র বলতে আমরা শুধু মনে করি একজন খারাপ মানুষ, যে কি না সবকিছু ধ্বংস করতে চায়। কিন্তু নেতিবাচক চরিত্র যে নায়কের একটা অংশ তা হয়তো একটু নতুনভাবে বুঝিয়েছিলেন হুমায়ূন ফরীদি। খলনায়ক হয়েও পুরো সিনেমাতেই নিজের সহজাত অভিনয় দিয়ে স্ক্রিন ধরে রেখেছিলেন এই অভিনেতা । একজন নির্মম পাষাণ সম্পত্তির লোভে যে কতোটা নৃশংস হতে পারে সেই দৃশ্য তিনি পর্দায় এঁকেছিলেন।

তাই হুমায়ুন ফরীদি সবসময় সবার থেকে এগিয়ে ছিলেন অনেকখানি—সেটা অভিনয়ে হোক কিংবা ব্যক্তিত্বে।

হুমায়ূন আহমেদের অভিনয় প্রসঙ্গে কথা যখন হচ্ছে তাহলে ফুটে আসবে ‘পালাবি কোথায়’ চলচ্চিত্রের কথা। বর্তমান সিনেমাগুলোতে একটা বিষয় খুব লক্ষ্য করা যায় তা হলো নেতিবাচক চরিত্রে অভিনেতার অভাব। যার ফলে অনেক সময় এই চরিত্রে সবাই নিজেকে মেলে ধরতে পারে না, তাই বর্তমান সময়ে হালের অনেক নায়কের চরিত্রে অভিনীত ব্যক্তিদের ভিলেনের চরিত্রেও অভিনয় করতে দেখা যায়। সেই সাথে দেখা যায় পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে অভিনেতাদের ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করতে।

কিন্তু ৯০ দশকের সময় ভিলেন চরিত্রে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলতো। রাজীব, নাসির খান, ডিপজল, আহমেদ শরীফ অভিনেতাদের মাঝে নিজের ম্যাজিক্যাল অভিনয় দিয়ে তিনি সবার শীর্ষে ছিলেন‌।

‘পালাবি কোথায়’ এই গল্প আবর্তিত হয় মিড লাইফ ক্রাইসিসে ভোগা একজন গার্মেন্টস ম্যানেজার হাওলাদারের গল্প, যার একজন সুন্দরী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও নারীদের প্রতি ছিল তার তীব্র আকর্ষণ। মাত্রাটা এতোই তীব্র হয়ে উঠে তাকে রুখে দেওয়ার জন্য তিনজন নারী প্রতিবাদের আওয়াজ তোলে। গল্পে ম্যানেজার হাওলাদার প্রতিবাদী সেই তিন নারীর কাছে পরাজিত হয়। পরাজিত হয় শোষিত পুরুষ সমাজের।

অসংখ্য নেতিবাচক চরিত্রের মাঝেও নিজেকে হাস্যকরধর্মী নেতিবাচক চরিত্রে উপস্থাপন করা চারটে খানে কথা নয়। নারীর প্রতি তীব্র লালসা সেই সাথে কমিক টাইম মিলিয়ে হাস্যকর সংলাপ উপস্থাপনের সাথে জানান দেয় অভিনয়টা শুধু একটা চরিত্র নয়, ধরে নিতে হয় নিজের মৌলিক জীবন।

একজন অভিনেতার অভিনয় পাকাপোক্ত করতে হলে তাকে ম্যাজিশিয়ান হতে হয়। সেটি যেই চরিত্রেই হোক না কেন, অভিনয় দক্ষতা গুণে তা সবার কাছে নজির হয়ে উঠে। তেমনি আরো একটি মিড লাইফ ক্রাইসিসে ভোগা চরিত্রে করেছিলেন ‘ব্যাচেলর’ সিনেমায়। চরিত্রটি স্বল্প খানিকের হলেও তখনকার সময়ে দাঁড়ানো তরুণ নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ফরীদিকে উপস্থাপন করেন নতুন এক ফরীদিকে।

আবরার ভাই, চিরকুমার সংঘের সভাপতি। নারী ঘেঁষা তার দুচোখের বিষ। তিনি নিজে তো ব্যাচেলর, সেই সাথে আবার ব্যাচেলরদের ফ্ল্যাট ভাড়া দেন। কিন্তু তার একটাই দূর্বলতা, তা হলো সিনেমার আকর্ষণ‌‌। কিন্তু নারী বর্জিত আবরার ভাই সিনেমার সংলাপ বুঝাতে গিয়ে একদিন একজন নারীকে জড়িয়ে ধরলেন, সেই থেকে শুরু হয় তার বিচলিত পথহাঁটা। অনুভব করছেন মহাপাপ করে ফেলেছেন, জ্বর চলে আসে তার।

এই চরিত্রে হুমায়ূন ফরীদি নিজের কমফোর্টজনের বাইরে গিয়ে নিজেকে যেইভাবে তুলে ধরেছেন তা তরুণ বয়সে প্রেমে পড়ার কথা মনে করিয়ে দেয়।

শুধু কি ব্যাচেলর, আনন্দ অশ্রু, পালাবি কোথায় সিনেমা? দহন, একাত্তরের যীশু, জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়ার এইরকম হাজারো সিনেমায় ভিন্নরকম চরিত্রের উপস্থিতি দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কেনো তিনি অভিনয়ের বিশ্ববিদ্যালয়।

হুমায়ূন ফরীদি চলে যাওয়ার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনো হুমায়ূন ফরীদির শূন্যতা বিরাজমান চলচ্চিত্র আর টেলিভিশন নাটকে। চঞ্চল থেকে শুরু হালের অনেক জনপ্রিয় কিছু অভিনেতা ছাড়া আজকাল অভিনয়টা বড্ড কর্মাশিয়াল ভাবে দেখানো হয় পর্দায়। যার অভাবটা এখনো পূরণ করতে সক্ষম হয়নি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। তার মতো অভিনেতা তৈরি না হওয়ার অনেক বিষয় সন্নিবেশিত করা যায়‌।

শুরুতেই যে বিষয়টি সামনে আসবে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা না থাকা। ফরীদির অভিনয়ে যে তীব্রতা ও বাস্তবতা ছিল, তা অর্জনের জন্য গভীর পর্যবেক্ষণ, অধ্যবসায় ও চরিত্র বিশ্লেষণের দরকার হয়। বর্তমান প্রজন্মের অনেক অভিনেতা দ্রুত জনপ্রিয়তার পেছনে ছোটেন, ফলে অভিনয়শৈলীর গভীরতা কম দেখা যায়।

তাছাড়া ফরীদির সময়ে নাটক ও সিনেমার কনটেন্ট অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। বিশেষ করে তার সময়ে ভিলেনের চরিত্রে যেভাবে লেখা হতো এখন সেইভাবে স্মরণীয় কোনো ভিলেন চরিত্র বেরিয়ে আসতে পারছে না। হালের অনেক জনপ্রিয় অভিনেতায় ভিলেন এবং নায়ক দুই ভূমিকাতেই অভিনয় করছেন কিন্তু তার চরিত্রের সম্পূর্ণ গভীরতা সবার সামনে ফুটে আসছে না।

আজকের নাটক ও সিনেমার গল্পগুলোতে সেই গভীরতা ও শক্তিশালী চরিত্র নির্মাণের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম। ফলে অভিনেতাদের নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ কমে গেছে।

অন্যদিকে মঞ্চ ও টেলিভিশন ছিল প্রধান মাধ্যম, যেখানে অভিনয়ের দক্ষতা বিকাশের সুযোগ ছিল। এখন ইউটিউব ট্রেন্ডিং ভিউ, শর্ট ফর্ম কনটেন্ট এবং টাকার পিছনে ছুটা, অভিনয়ের চেয়ে ক্যামেরার সামনে ভালো দেখানো বা জনপ্রিয় সংলাপ বলা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এই কারণেই পেশাগত অভিনেতা সৃষ্টি হচ্ছে না।

বর্তমান সময়ে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও দর্শকদের রুচির পরিবর্তনের ফলে দর্শকরা এখন সহজলভ্য বিনোদনের দিকে বেশি ঝুঁকছেন। জটিল চরিত্র বিশ্লেষণ বা শক্তিশালী সংলাপ ভিত্তিক চরিত্রের চাহিদা কমেছে, ফলে তেমন চরিত্র গড়ে ওঠার সুযোগ কমে গেছে।

অদূর ভবিষ্যতে হুমায়ূন ফরীদির মতো অভিনেতা তৈরি করতে হলে তরুণদের নতুন ও ভিন্নধর্মী চরিত্রে কাজ করতে উৎসাহিত করতে হবে। হুমায়ূন ফরীদি মূলত থিয়েটার থেকেই উঠে এসেছিলেন। তাই তরুণদের জন্য মঞ্চনাটক, শর্ট ফিল্ম, থিয়েটার বাধ্যতামূলক করতে হবে, যা তাদের অভিনয়ের গভীরতা বাড়াবে।

নতুন প্রতিভাদের সুযোগ দেওয়ার জন্য ওপেন ক্যাস্টিং কল এবং প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। সেইসাথে তারকাখচিত সিনেমার পাশাপাশি বাস্তববাদী ও গল্পনির্ভর চলচ্চিত্রে তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

আসলে হুমায়ূন ফরীদি ছিলেন বহুমুখী চরিত্রের অধিকারী।তবে ফরীদির মতো বহুমুখী চরিত্রে তীব্রতা দেখাতে পারাটাই যেনো এখনো বিরল। তাই বর্তমান সময়ের কিছু উঠতি তারকা শরীফুল রাজ, ইয়াশ রোশান, সিয়াম আহমেদ, নাসির উদ্দিন খান নিজেদের অভিনয়গুণে নিজেদের আলাদা জায়গা তৈরি করলেও তাদের একঘেয়ে বা টাইপকাস্ট চরিত্রে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন ঘরানার চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দিতে হবে।

দিন যায়, মাস যায়, পেরোয় বছর, এখনো টেলিভিশন, মঞ্চ নাটক, চলচ্চিত্র হুমায়ূন ফরীদিকে খুঁজে বেড়ায় । লাইট, ক্যামেরা, পরিচালক সবকিছুই আছে, কিন্তু যিনি এসে পর্দায় আবারো দর্শকদের ভিন্ন ধারার ফোয়ারা দেখাবেন শুধু তিনিই নেই। চরিত্রের সাথে নিজের ব্যক্তিসত্তার সুনিবিড় গভীর সম্পর্ক থাকতে পারে সেই হুমায়ূন ফরীদির অভাব আজো ভোগায় সিনেমাপ্রেমী থেকে শুরু নির্মাতাদের। যে অভাব কখনোই পূরণ হওয়ার নয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি

সারাবাংলা/এএসজি

সুমন বৈদ্য হুমায়ূন ফরীদি

বিজ্ঞাপন

কড়াইল বস্তির আগুন নিয়ন্ত্রণে
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৩:১৩

আরো

সম্পর্কিত খবর