ডিভোর্সী নারী মানেই কেন সমাজের বাঁকা চোখ?
৬ জানুয়ারি ২০১৮ ১৪:৫৩
মারজিয়া প্রভা
শান্তা (ছদ্মনাম) প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ফার্মেসিতে পড়ে। বছর দুয়েক আগে পরিবারের পছন্দেই বিয়ে হয় অনীকের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। বিয়ের পরেই বুঝতে পারল তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসলে এই বিয়ে দিতে রাজি ছিল না। তাদের আশা ছিল বড় টাকার যৌতুক আসবে এই বিয়েতে।
যৌতুক না পেয়ে শান্তার উপর নেমে এলো অকথ্য অত্যাচার। প্রবল ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন শান্তা ছয় মাসের মাথায় ফিরে আসে ওই সংসার থেকে। ডিভোর্স ফাইল করে স্বামীর বিরুদ্ধে। আর তখনই সুর বদলায় স্বামী। শান্তার পরিবারও চায় শান্তা ফিরে যাক স্বামীর কাছে। “হাজার হোক মেয়েমানুষ ডিভোর্স হলেই কলঙ্ক” – এই যুক্তিতে তারাও শান্তাকে প্রভাবিত করে ফিরে যাবার জন্য।
শান্তা ফিরে গিয়েছিল স্বামীর কাছে। কিন্তু মাসদুয়েক পরে আবার শুরু হয় নির্যাতন। শান্তা নিজ সিদ্ধান্তে ডিভোর্স দেয় এরপর। এখন শান্তা মাস্টার্স করছে। ডিভোর্সের পরে শান্তার পরিবার শান্তার কোন পড়ার খরচ তো দেয়ই না উপরন্তু অন্য কারো সামনে শান্তার পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত বোধ করে। শান্তার মতে, ডিভোর্সের পর সে বাবা মায়ের বোঝা হয়ে গেছে।
চার বছর প্রেম করে মেডিকেলের ছাত্রী ইলা (ছদ্মনাম) বিয়ে করেছিল কম্পিউটার প্রকৌশলী আসাদকে (ছদ্মনাম)। বিয়ের ১০ দিনের মাথায় অস্বাভাবিক যৌন নির্যাতন শুরু হয় ইলার উপর। গায়ে হাত তোলা, রেগে গেলে কফ থুতু খাইয়ে দেওয়া, চাকু দিয়ে পিঠে দাগ দেওয়াসহ আরও অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয় ইলা। প্রেমের বিয়ের এই পরিণতির কথা কাউকে না জানিয়ে একা একা কষ্ট ভোগ করছিল ইলা।
মেজ ভাই এসে বাঁচায় ইলাকে। নিয়ে যায় তাঁর কাছে। বিয়ের তিন মাসের মাথায় ইলা ডিভোর্স দেন। এরপর থেকে ভাইয়ের কাছেই আছেন তিনি। পাশাপাশি নিজেও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী। কিন্তু সমাজে এখনো তাকে শুনতে হয় যে সে সংসার করার উপযোগী না, বেশি স্বাধীনচেতা, মেয়েরা এরকম হলে সংসারে টেকা যায় না – ইত্যাদি।
পাঁচ মাস হয়েছে নীলার ডিভোর্স হয়েছে। নীলা কাজ করছে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। বিয়ের আগে থেকেই সে এই অফিসে চাকরি করে। ডিভোর্সের পর সে দেখছে অফিসে ঢুকলেই তাকে নিয়ে শুরু হচ্ছে ফিসফাস। তার সাথে নারী সহকর্মীদের আচরণ বদলে গেছে। সুযোগ পেলেই “ডিভোর্স কেন হল? কে দিয়েছে?” এসব কথা জিজ্ঞেস করে। নীলা সবচেয়ে অবাক হয় তার একজন পুরুষ সহকর্মীর ব্যাপারে। প্রায়ই সে নীলাকে দেখলেই বলে ওঠে, “কচি বয়সে ডিভোর্স সহ্য করা যায়?”
নীলা পাত্তা দিত না। কিন্তু একদিন সেই পুরুষ সহকর্মী তাকে সরাসরি শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়ে বসে। পুরুষ সহকর্মীর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে সে উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করে। সেই পুরুষ সহকর্মীটিকে পরে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে সে নির্লিপ্তভাবে উত্তর দেয়, “আমি ভেবেছিলাম নীলা ম্যাডামের কষ্ট হচ্ছে!”
ডিভোর্সি মেয়েদের নিয়ে সমাজের চিন্তার রূপটি এখনো এরকম। একটা মেয়ে সে যতোই নির্যাতনের শিকার হোক না কেন! সে যদি সব মুখ বুজে সয়ে স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে পারে তাহলেই সে সমাজের কাছে “লক্ষ্মীমন্ত” মেয়ে। আর সে যদি প্রতিবাদ করে ওই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চায় তখন তাকে শুনতে হয় যে সে “খারাপ মেয়ে”।
এই প্রসঙ্গে নারী উদ্যোক্তা এবং Women Dressy Dale এর কর্ণাধার হোসনে আরা শীলা বলেন, “ একজন মেয়ে কোন কারণে যদি ডিভোর্সি বা সেপারেটেড হয় তবে সমাজের চোখে সে কীট বা নর্দমা থেকে উঠে আসা একটা পচনশীল বস্তু। হোক সে মেয়েটি যতোই আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী!”
একজন ডিভোর্সি নারীকে আমাদের সমাজ ভীষণভাবে সহজলভ্য মনে করে। যেসব ডিভোর্সি নারী চাকরি করেন তাদেরকে কর্মক্ষেত্রে নানা কারণে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। সহকর্মী থেকে বস সবাই খুব সহজেই “শারীরিক সম্পর্ক” কিংবা “বিবাহের প্রস্তাব” দিয়ে বসে। একটা মেয়ে ডিভোর্সি হওয়া মানেই সে এখন যে কোন মুহুর্তে বিয়ের জন্য প্রস্তুত এমনটাই মনে করে আমাদের সমাজ।
একটা বিয়ে অনেক তিক্ততার পরেই ভেঙ্গে যায়। সেই তিক্ত সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে নতুন জীবন শুরু করা যেকোনো মানুষের জন্যই কষ্টের। কিন্তু মানুষটি যদি লিঙ্গে “নারী” হন, তাহলে এই সমাজ তার পাশে দাঁড়িয়ে সমব্যাথী হবার চাইতে তাকে ছিঃ ছিঃ করতেই বেশি ব্যস্ত থাকে।
২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত কেবলমাত্র ঢাকার উত্তর এবং দক্ষিণ কর্পোরেশনে প্রায় ৩৩,১৬৬টি ডিভোর্স মামলা ফাইল হয়েছে। এরমধ্যে ১৮,২১১টি ডিভোর্স মামলা করেছে নারী। নারীদের করা বেশিরভাগ ডিভোর্স মামলার কারণ হিসেবে দেখা গেছে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি দ্বারা নির্যাতন নিপীড়ন, সঙ্গীর বিবাহবহির্ভুত সম্পর্ক, বহুদিন ধরে সম্পর্ক না রাখা, মতের মিল না হওয়া প্রভৃতি।
মাত্র ১০ বছর আগেও নারীরা এইসব যন্ত্রণা ভোগ করে হলেও সংসারে টিকে থাকার চেষ্টা করত। ডিভোর্স দেওয়ার কথা চিন্তা করত না। ব্রিটিশ আইনে একজন নারীর নিজের থেকে ডিভোর্স দেবার ক্ষমতা ছিল না। বিয়ের সময় স্বামী সে ক্ষমতা দিলেই কেবল নারী ডিভোর্স দিতে পারতেন।
এখন আইন সহজলভ্য হয়ে গেছে। নারীও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। তাই খুব সহজেই নারীরা তিক্ত বৈবাহিক জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন। কিন্তু এখানে বাধ সাধছে পরিবার এবং সমাজ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর মুক্তি এবং আনন্দের জীবনকে বারবার রক্তাক্ত করে যাচ্ছে তাদের নিজস্ব তৈরি করা কিছু নিয়ম-কানুন দিয়ে। তাই এই সমাজ বাঁকা চোখে দেখছে ডিভোর্সি নারীদের।
তবে উদ্যোক্তা হোসনে আরা শীলা একটু অন্যরকমভাবে বলছেন, “আমি আসলে সমাজকে দায়ী মনে করি না কারণ সমাজের আগে একজন মেয়ের প্রথম এবং প্রধান ভরসার জায়গা হচ্ছে তার নিজের পরিবার। পরিবার পাশে থাকে না বলেই হাজারো ডিভোর্সি মেয়ে প্রতিদিন একবার করে নিজেকে মেরে ফেলে পরিবার আর সমাজের ভয়ে”।
নিজের ব্যক্তিগত জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শীলা জানান, আমি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও আট বছর লেগে গেছে আমার নিজেকে মুক্ত করতে। আর এই ক্ষেত্রে আমার পরিবারই আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে। আরও আট বছর আগে এই সিদ্ধান্ত নিলে বা পরিবারকে জানালে আমার জীবন থেকে আটটি বছর নষ্ট হয়ে যেত না। যদি প্রতিটি পরিবার ডিভোর্সের পরে তার নিজেদের আদরের মেয়েটির কথা ভেবে তার পাশে দাঁড়ায় তাহলে সমাজ কোন মেয়েকে এইভাবে আঙ্গুল তুলে কথা বলতে পারবে না, বাঁকা চোখে তাকাতে পারবে না। পরিবার আছে বলেই আজ আমার নিজের একটি পরিচয় আছে। আমি সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছি।
তবে মেয়েদের সেলফ ডেভেলপমেন্ট বা আত্মউন্নয়নের কোন বিকল্প নেই বলে মনে করেন রিলেশনশিপ এবং ডিপ্রেশন স্পেশালিষ্ট হাফসা ঝুমুর। তিনি মনে করেন, সমাজ একজন ডিভোর্সি মেয়েকে বাঁকা চোখে দেখে তার কারণ সমাজ মেয়েটিকে দুর্বল বলে মনে করে। আর একজন মেয়ে যখন নিজের দক্ষতা এবং গুণকে কাজে লাগিয়ে আত্মউন্নয়ন করতে পারবে তখন সমাজ কখনোই সেই মেয়েকে নিয়ে বাঁকা কথা বলার সুযোগ পাবে না। এজন্য একজন মেয়েকে অবশ্যই নিজের পরিচয় গড়ে তুলতেই হবে।
দুইজন নরনারী একসঙ্গে থাকার স্বপ্ন নিয়েই ঘর বাঁধে। কিন্তু সম্পর্ক যখন তেতো হয়ে যায় তখনই কেবল সেই সম্পর্ক ডিভোর্সে রূপ নেয়। অথচ ডিভোর্স শেষে একচেটিয়া নারীর উপরই ‘সংসার করতে না পারার’ দোষ দেয় এই সমাজ। নারীকে দুর্বল ভেবে এই বাঁকা চোখে তাকানো কেবলমাত্র সেদিনই বন্ধ হবে, যেদিন প্রতিটি নারী নিজেরাই নিজেদের পরিচয় গড়ে তুলতে পারবে।
অলঙ্করণ- আবু হাসান
সারাবাংলা/ এসএস