সীমন্তি আমার বন্ধু
৩ নভেম্বর ২০১৮ ১৮:৫৮
গতকাল একটি বই পড়ছিলাম । বইটির নাম, কন্যাকাহন। লেখিকা সোনালী সেন পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা । নারীর মনে লুকিয়ে থাকা না বলা নানা কথা তুলে এনেছেন লেখিকা তার এক একটি ছোট গল্পে। কাকতালীয় ভাবে কন্যাকাহন-এ একটি গল্প সীমন্তি নামের সদ্য কিশোরী মেয়ের, যে কিনা জীবনের অর্থ খুঁজে না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। বইয়ের আরেক চরিত্র ইন্সপেক্টর হূমায়ুনের মতে, এটি ‘অ্যা ক্লিন অ্যান্ড স্পটলেস সুইসাইড’।
আচ্ছা, সুইসাইড কি কখনো ক্লিন এন্ড স্পটলেস হতে পারে? এই মেকি সামাজিক আবহাওয়ার চাদরেই একটা হিংস্রতার বীজ কোথাও না কোথাও ঠিকই ছড়িয়ে আছে। আমরা সাদা চোখে সুইসাইড বলতে যা বুঝি তা আসলে মার্ডার, কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার। আমরা হত্যা করি আমাদের সন্তানদের শৈশবকে, আমরা হত্যা করি সহজ, স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্কগুলোকে, আমরা হত্যা করি নিত্যদিনের ছোট ছোট ভাবনাগুলোকে…কথাগুলো আমার নয়। লেখিকার নিজের। চাকুরীর ক্ষেত্রে এমন বহু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত তার দিন কাটে। হয়ত তেমন কোন একখানে তার পরিচয় হয়েছে কোন এক সীমন্তি সাথে। আমাকে খুব ভাবিয়েছে সোনালী সেনের এই গল্প ।
যখন আমার বন্ধু সীমন্তির জন্য আমার হৃদয় কাঁদছে ঠিক তখন কন্যাকাহনের সীমন্তির উপর ভীষণ রাগ, ভীষণ অভিমান জমেছে। বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, কেন হার মানলে মেয়ে ? কেন ? কেন হেরে গেলে? আজ তুমি না হারলে আমি তোমাকে আমার বন্ধু সীমন্তির হাতটা শক্ত করে ধরতে বলতাম।
শুচিস্মিতা সীমন্তি আমার বন্ধু। ওর সাথে আমার পরিচয় শ্রীলংকার একটি সম্মেলনে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে কীভাবে শান্তি ফিরিয়ে আনা যায়, তাতে তরুণেরা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে এসব কিছু নিয়ে আমরা দিনের পর দিন একসাথে ভেবেছি, কাজ করেছি সহযোদ্ধা হয়ে। আমার আর সীমন্তির মধ্যে সবচেয়ে বড় মিলটি হল, আমরা দুজনেই নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই। নিজেদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে ভালবেসে পাশে দাঁড়াই অসহায় মানুষ, সুবিধাহীন মানুষদের পাশে। সেটা কলমে, মাঠে-ঘাটে, বন-বাদরে সকল ক্ষেত্রে ।
সীমন্তির সাথে আমার যেদিন প্রথম পরিচয় হয় সেই দিনের দুটি বিষয় আমি কখনো ভুলব না। প্রথমত, সীমন্তির সরল হাসি, যে হাসিতে একেবারে অপরিচিতকেও প্রথম দেখায় চির আপন লাগে। আর দ্বিতীয়ত, সীমন্তির পুরো নাম, বিশেষত ওর নামের প্রথম অংশ। শুচিস্মিতা- যার মানে হল, যে নারীর হাসি পবিত্র। বন্ধুত্বের প্রথম দিনেই সীমন্তির হাসি যে আমার খুব ভাল লেগেছিল সে কথা ওকে কোন দিন বলা হয়নি । এমনকি গত পরশু অনেক সময় ধরে ওর সাথে গল্প হয়েছে । তবু ওকে বলা হয়নি। বলতে পারিনি আমি। কী করে আমি ওকে জিজ্ঞেস করি কীভাবে এত বেদনা লুকিয়ে রেখে সে এত নিস্পাপ করে হাসতে পারে?
আজ আমার এই লেখা পড়ে হয়ত সে আবার হাসবে সেই পবিত্র হাসি। আমরা কাল এটা সেটা নানা কিছু নিয়ে গল্প করেছি। পড়াশুনা, প্রবাস জীবন, সামনের বড়দিনের ছুটিতে ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা অনেক কিছু নিয়ে। গতকাল ও জীবনে প্রথম কোন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তার গবেষণাকর্ম উপস্থাপন করেছে। আমার কাছে তার আগের রাতে পরামর্শ চেয়েছিল। আমি জানতাম ও শুধু শুধু ঘাবড়াচ্ছে । আমি জানতাম সীমন্তি চমৎকার উপস্থাপনা করবে। ওকে শুধু আমি বলেছি সীমন্তি, তুমি শুধু সময়ের দিকে খেয়াল রেখ।
জীবনে সময়ের কথা সময়ে বলতে পারা খুব দরকার। আমার বন্ধু সীমন্তি সময়ের কথা সময়ে বলতে পারেনি । এতগুলো বছর তার হৃদয়ে কষ্টকে লালন করেছে হাসি মাখা মুখে। এই বেদনা বোঝার ক্ষমতা হয়ত আমার নেই। হয়ত সীমন্তিদেরই শুধু আছে। আজ যারা মুখে সুশীল বুলি নিয়ে বলছেন যে, এতদিন কেন বলেনি সে? এতদিন পরে এসে কেন সে আজ হঠাৎ বলল তার নীরবে সয়ে যাওয়া নির্যাতনের কথা? এতদিন পর কী তার উদ্দেশ্য ? কে তাকে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে ?
আমি আর নিতে পারলাম না এই সুশীল বানী । আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি কোন নারীবাদীকে চিনি না, আমি কোন পুরুষবাদের দাসও নই। এমন কী কে সুপ্রীতি ধর ? তার সাথে আমার বন্ধুর কী রক্তের সম্পর্ক? সুপ্রীতি ধরের সাথে ক, খ , গ বা প্রণব সাহার কী তথাকথিত সামাজিক সম্পর্ক ছিল বা নেই তাতে আমার কিছু আসে যায়না । আমার শুধু আসে যায় আমার বন্ধু সীমন্তিকে নিয়ে। যে সুন্দর শৈশব, যে সুন্দর কৈশোর থেকে আমার বন্ধু বঞ্চিত হয়েছে । তার শাস্তি অপরাধীকে পেতেই হবে। সীমন্তির হৃদয় গহীনের কষ্ট তার কষ্টে উচ্চারিত মিটু দেরীতে হলেও সীমন্তির জয়। সমাজের নোংরা মানুষগুলোর বিরুদ্ধে হাজার হাজার সীমন্তির জয়।
আমার বন্ধু সীমন্তি সোনালী সেনের হেরে যাওয়া, জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া, আত্মহননের পথ বেছে নেয়া সীমন্তি নয়। আমার বন্ধু সাহসী সীমন্তি, আমার বন্ধু সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে আজ দেখিয়ে দিয়েছে আজকের সীমন্তিরা হারতে শেখে না। আজকের সীমন্তিরা ক্ষমতার দাপটকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে জানে। আজকের সীমন্তিরা সমাজের সুশীল মানুষদের ভেতরের কদর্য রূপ এক লহমায় টেনে বের করে নিয়ে আসার শক্তি রাখে।
তাই আজকের সীমন্তিরা জয়ী সীমন্তি।
সারাবাংলা/ এসএস