নারী জাগরণ ও কলসিন্দুরের কিশোরীদের লড়াই-বাস্তবতা
৭ জানুয়ারি ২০১৮ ১৩:৫২
বাংলাদেশের কিশোরী ফুটবল দল দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ফুটবল দলের মুকুট ছিনিয়ে নেয়ার মাঝে দেশে নারী জাগরণের উজ্জ্বল চিহ্ন চোখে পড়ে। এরা সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির সাফল্যের ফাঁপা ফ্যাশান প্যারেডের অংশ নয়। বাংলাদেশের প্রত্যন্তের খেটে খাওয়া পরিবারের সন্তান।
বাংলাদেশের কিশোরী ফুটবল দলের এই সাফল্যের সরণিটি গিয়ে থামে গারো পাহাড়ের ধারে কলসিন্দুর নামের এক বিজন গ্রামে। গ্রামের ছোট্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মিনতি রাণী আর ক্রীড়া শিক্ষক মফিজ স্যার এই সাফল্যের ছোট্ট পিদিমটি জ্বালেন। গ্রামের মেয়ে ফুটবল খেলবে- এই অবিশ্বাস্য চিন্তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন তারা।
ফুটবল খেলার জন্য শরীরে যে শক্তির দরকার সেরকম ক্যালরিযুক্ত খাবার যোগানের সামর্থ্য এই কিশোরী ফুটবলারদের অভিভাবকদের ছিলো না। কারণ ক্যালরি ফুরিয়ে যায় সর্বগ্রাসী মেট্রোপলিটানের ‘সফল’ মানুষদের গোরুড়ের ক্ষিদে মেটাতে। তবুও থেমে থাকেনি কলসিন্দুরের কিশোরীদের বিজয় যাত্রা। ইচ্ছাশক্তি যে কোন পরাভব মানে না। কলসিন্দুর গ্রামের এই কন্যাশিশুদের সাফল্যের কিংবদন্তী গোটা বাংলাদেশের অগমে-দুর্গমে ছড়িয়ে থাকা কন্যাশিশুদের জীবন জয়ের স্বপ্নদায়ী।
বাংলাদেশের ফুটবল কতৃপক্ষ রাজসিক খেলা ক্রিকেটের দাপট আর স্পন্সর আদিখ্যেতার মাঝে প্রায় কোণঠাসা অবস্থায় প্রত্যন্তের এই ফুটবল ট্যালেন্টের সঠিক ব্যবহার করেছে। আলোর অলক্ষ্যে ফুটবল কোচ গোলাম রব্বানী এদের পরিচর্যা করেন বিশ্বমানের ফুটবল খেলায় শ্রেষ্ঠত্ব ছিনিয়ে আনার মতো করে। আলোর অলক্ষ্যে মিনতি রাণী, মফিজ স্যার কিংবা গোলাম রব্বানীর মতো মানুষেরাই তো স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্নের অনুসন্ধান করেন, স্বপ্নকে ভূমি বাস্তবতায় নামিয়ে আনেন। নইলে অমন গ্রামের কিশোরী ফুটবলারেরা এমন জাদু-বাস্তব ফুটবল শেখে কীভাবে যেখানে কোন প্রতিপক্ষই তাদের জালে বল জড়াতে পারে না। মাঝ মাঠেই আটকে যায় প্রতিপক্ষের আক্রমণ! অথচ কী অনায়াসে বার বার বাংলাদেশের কিশোরীরা হানা দেয় প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে।
কলসিন্দুরের সমাজ মেয়েদের ফুটবল খেলাকে প্রথমে বাঁকা চোখেই দেখে; কিন্তু সাহস করে যখন কিশোরীরা স্কুলের খেলার মাঠে উপস্থিত হয়, ঢাকায় দেশ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ছিনিয়ে আনে, তখন কলসিন্দুরের সমাজ নিজের গ্রামের মেয়েদের নিয়ে গর্ব করতে শুরু করে। এটাই জগতের নিয়ম, বাধাকে জয় না করে কেউ কোথাও কোন দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য অর্জন করতে পারে না। সাফল্যকে কেউ পেস্ট্রির মতো প্লেটে তুলে দেয় না।
তাই বাংলাদেশের নারী ফুটবল যখন দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব অর্জন করেছে, গোটা বাংলাদেশই তখন আনন্দ নয়ন জলে ভেসেছে। টেলিভিশনে ফাইনাল খেলাটি দেখে দারিদ্র্যে মলিন প্রত্যন্তের চা-খানার শীর্ণ দেহের জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া মানুষেরা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে।
‘সাহেব’দের মেয়েদের জন্মদিনের কেক কাটার সেলফি, জিপিএ ফাইভ পাবার গর্বের সেলফি দেখে দেখে, টেলিভিশনে হেঁচকি দিয়ে দিয়ে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলা ফ্যাশানেবল ফেমিনিস্টদের দেখে যে কিশোরীরা ভেবেছে জীবনের সমস্ত অধিকার ওদেরই, তারা ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পেয়েছে তাদের মতোই মেয়েদের এই আত্মবিশ্বাস আর জয়গাথা দেখে।
নারীমুক্তি কোন ফ্যাশান প্যারেড নয়, মিডিয়া শো ডাউন নয়, সোশ্যাল মিডিয়ার লাইকের আহাজারি নয়; নারী মুক্তি হচ্ছে মিনতি রাণী, মফিজ স্যার, রব্বানীদের মতো নিভৃতচারী কেজো মানুষদের নিঃসঙ্গ শেরপার লড়াই। মেট্রোপলিটানেও এমন কর্মী রয়েছেন যারা নারী মুক্তির জন্য অনেক বাধাবিঘ্ন ঠেলে যুগের পর যুগ কাজ করছেন। মেট্রোপলিটানের ফ্যাশান প্যারেডের বৈপরীত্যের কথা বলা এজন্য যে তারুণ্য এগিয়ে যাবার পথে বাতিঘর খোঁজে। কিন্তু মেট্রোপলিটানে এই বাতিঘর বা আইকন হবার ইঁদুর দৌড়ে যারা সাধারণত শামিল হন তারা তাদের সর্বব্যপী মিডিয়াবাজি আর স্টারডমে ভুল দৃষ্টান্ত তৈরি করেন। আলোর অলক্ষ্যে কাজ করা মানুষেরা থেকে যান অনাবিষ্কৃত। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে থেমে যায় তাদের অনেকেরই স্বপ্নযাত্রা।
কলসিন্দুরের মতো হাজারো গ্রামে ছড়িয়ে থাকা যেসব ছোটখাটো মানুষেরা স্বপ্নকে ভূমিবাস্তবতায় নামিয়ে আনার লড়াই করছেন, তাদের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে আমাদের। ফুটবলে কিশোরীদের এই সাফল্য কোন হঠাত আলোর ঝলকানি নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি বর্গমাইলেই সম্ভাবনার আলো টিমটিম করে জ্বলছে; সে আলোর খোঁজ করতে হবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিকূলতায় সেসব আলো যেন নিভে না যায়, সে ব্যাপারে সক্রিয় হতে হবে সরকার, মিডিয়া, সোশাল মিডিয়া সর্বোপরি জনমানুষকে। আমরা যেন মেট্রোপলিটানের অন্তঃসারশূণ্য সার্কাসে বিস্মৃত না হই তহুরা-মারিয়া-আঁখিদের, যারা ফুটবলে বাংলাদেশের গর্বের পতাকা উড়িয়েছে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায়। এ পতাকা বাংলাদেশের নারী জাগরণের প্রতীক নারীর সম্ভাবনা অনুসন্ধানের আহ্বান।
[রোকেয়া সরণি কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত]
সারাবাংলা/এসএস