বাংলাদেশে #মি টু আন্দোলন ও এর ভবিষ্যত
১৪ নভেম্বর ২০১৮ ১৭:১১
মি টু ঝড় বাংলাদেশেও। আঘাত ততটা শক্তিশালী নয়, যতটা হলে ঝাঁকি খায় সমাজ ও রাষ্ট্র। তবে মি টু ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করছে। শক্তিশালী ঘুর্ণিঝড়ের আগাম সংকেত দিচ্ছে। যার প্রভাবে প্রতিষ্ঠিত বহু মানুষ সামাজিকভাবে নগ্ন হয়ে যেতে পারে। সবে নিপীড়নের শিকার এক দুজন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। অর্থাৎ বোতলে বন্দী বেদনার ছিপি খুলে দিয়েছেন। বিষয়টি কোথায় গিয়ে থামবে, বলা মুশকিল। তবে, বাংলাদেশের মত সমাজে কথা বলা যে শুরু হয়েছে এটাই মি টু’র বড় অর্জন।
বহু বছর আগে লেখিকা তসলিমা নাসরীন মুখ খুলেছিলেন। টান দিয়েছিলেন সমাজের শেকড় ধরে। ফলাফল, ফেরার হয়ে দেশে দেশে ভেসে বেড়াচ্ছেন। অনেক দ্বিমত সত্ত্বেও, মানতেই হবে, এ দেশে নারীর পক্ষে তার মত সরব হয়নি কেউ। এই মাটি প্রতিবাদী নারীদের জন্য কতটা রুক্ষ সেটা তসলিমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।
হ্যাশট্যাগ মি টু হলিউডের আন্দোলন। নারী নির্যাতন বিরোধী হওয়ায় দুনিয়াজোড়া মেয়েদের কাছে মি টু সমাদৃত আন্দোলন। যদিও, প্রতিষ্ঠিত পুরুষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বাংলাদেশে কোন মেয়ের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাওয়া কঠিন। কারণ, এখানে সব ধরণের প্রতিষ্ঠান পুরুষতন্ত্রের সেবক। যারা শুধুই নারীর সেবা কামনা করে। প্রতিবাদ নয়। এরপরও কেউ (মেয়েরা) দাঁড়িয়ে গেলে, পাল্টা আঘাত শুরু হবে মেয়ের নিজের পরিবার বা সমাজ থেকেই।
বিশ্বজুড়ে নিপীড়কদের নোংরা চেহারা উন্মোচন করছে মি টু। এই ঝড়ে ইতিমধ্যেই লেখক, অভিনেতা, প্রযোজক, সাংবাদিক, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী রাঘব বোয়ালরা ধরাশায়ী। সাধারণ মানুষ জানতে পারছে, ভদ্রতার মুখোশে ঢাকা সব দেশের নিপীড়কদের চেহারা একই। ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত কতভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে নারী, সেই বয়ানই বারবার উঠে আসছে মি টুতে।
যৌথ সম্মতি ছাড়া সম্পর্ক হয় না। হওয়া উচিত না। তাই নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্কের চেষ্টা শুধু ফৌজদারী নয়, মানবতাবিরোধী অপরাধও বটে। এমন ঘটনায় কোন শাস্তিই যথেষ্ট নয়। কেননা নিপীড়নের ক্ষত শুকোলেও এর পীড়ন ভয়াবহ, যা একজীবনেও কাটে না। নারী লজ্জায়, ভয়ে মুখ খোলে না। অথচ পীড়ন-অপমান নিয়ে জীবন পার করে।
এ শুধুই লজ্জা বা ভয়ের বিষয় নয়। এর সাথে নারীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, পারিবারিক ও সামাজিক মান মর্যাদা, হয়রানি, কুসংষ্কারসহ নানা বিষয় জড়িত। অর্থাৎ নারীর সামনে পুরো পৃথিবী প্রতিকূলতা নিয়ে হাজির হয়। তখন বিচার চাওয়া তো দূরের কথা, নিজের কষ্ট আর অপমানের কথা শোনার জন্যও কেউ অবশিষ্ট থাকে না। এতো বাধা পেরিয়েও যারা কথা বলছেন, তাদের টুপি খোলা অভিবাদন।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৫/৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। এদের মধ্যে আছেন সাংবাদিক, প্রকাশক, সংস্কৃতিকর্মী। নিপীড়ক অনেকেই আশেপাশেই আছেন। যারা নিজেদের পদ-পদবী, ক্ষমতার জোরে যৌন হয়রানি করেন। নিঃসন্দেহে মি টু তাদের মধ্যে ভীতি তৈরি করেছে। এমনও শোনা যাচ্ছে, অনেকেই তসবিহ গুনতে শুরু করেছেন, যেন সৃষ্টিকর্তা তাদের রক্ষা করেন!
অভিযোগ উঠলেই সত্য ধরে নেবার কোন কারণ নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ অপরাধ স্বীকার করছে বা ঘটনা আদালতে প্রমাণিত। অবশ্য এটাও বিবেচ্য, এই সমাজে কোন মেয়ে ফেসবুকে, যৌন হয়রানির গল্প বানিয়ে বলবে না। তবে অভিযোগ ওঠা মাত্রই সামাজিক গণমাধ্যমে যে ট্রায়াল হচ্ছে সেটা অনুচিত। মনে রাখতে হবে, সবার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকা উচিত।
নারী মাত্রই নিপীড়ন ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকেন। সেটা ঘর থেকে শুরু করে কর্মস্থল পর্যন্ত। নিজে পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্রের সুবিধাভোগী হিসেবে জানি, যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে কোন শ্রেনী বিচার নেই। নিপীড়কের চেহারাটা মূলত ‘পুরুষতান্ত্রিক’। নারী-পুরুষ উভয়েই এর শিকার। তবে নারীই সর্বাধিক অপরাধের শিকার।
বাংলাদেশের পরিবারে ও সমাজে যৌনতা নিয়ে যে ট্যাবু, ভীতি ও কুসংস্কার চালু আছে, তারও প্রধান শিকার মূলত নারী। কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষও। যৌনতা, কাম, ক্রোধ, লোভ, লালসা নিয়ন্ত্রণের মতো গুনাবলীর অভাবেই মানুষ নিপীড়ক হয়ে ওঠে। যৌনতা হচ্ছে পাপ, ভয় আর ভীষন গোপন বিষয়- জেনে বেড়ে উঠেছি। ফলে, যৌবনপ্রাপ্ত হবার সন্ধিক্ষনে ছেলে বা মেয়েটি পরিবারের ভেতরেই ‘নিষিদ্ধ’ ফলের স্বাদ নেবার সুযোগ খোঁজে অন্ধকারে। এর রেশ থেকে যায় বাকী জীবন। দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির ক্ষেত্রেও বিশাল ভূমিকা রাখে এসব ঘটনা। যার জন্য প্রধানত দায়ী পরিবার।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বেড়ে ওঠার সময়কালে মেয়েদের প্রতি বন্ধুদের অনেকের আচরণ যথাযথ ছিলো না। কৈশোরের সেই সব ভগ্নি, বন্ধুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা। পরিবারগুলো সচেতন হলে এ ধরণের দুর্ঘটনা বা অপরাধ অনেক কমে আসবে। যথাযথ আচরণ, যৌথ সম্মতি, যৌনতায় পছন্দ-অপছন্দ, ব্যক্তি স্বাধীনতার শিক্ষা সকলের পরিবারেই পাওয়া উচিত।
বাংলাদেশে যাদের নাম এসেছে তারা পরিচিত কিন্তু সেই অর্থে প্রভাবশালী বা ব্যাপক ক্ষমতাবান কেউ নন। যদিও, তারা সত্যিই হয়রানি করেছেন কি না তা প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু বহু প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য যৌন হয়রানির অভিযোগ আছে। তাদের বিরুদ্ধে হ্যাশট্যাগ শুরু হলে, মি টু প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়বে। অভিযোগকারিনীকে নানা উটকো হয়রানির শিকার হতে হবে। এমনকি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে পারে অনেক নারী। অভিযোগকারী উল্টো দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন। এসব সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়াটা বোকামী হবে।
খুব নির্মোহভাবে দেখলে, বাংলাদেশে মি টু’র ভবিষ্যত নেই। এখানে পুরুষতন্ত্র প্রবল প্রতিপত্তিশালী এবং ক্ষমতাধর। গায়ে এক দুইটা আচর পড়লে সে নারীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে। প্রশংসা করবে। কিন্তু কামড়ে দিলে বা বিপদ দেখলে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। নিজেদের রক্ষায় যা যা করার তাই করবে। দিন শেষে রাষ্ট্র সমাজ, পরিবার সব নারী বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে। তাই বলে হতাশ হলে চলবে না। গুটি গুটি পায়ে অনেক এগিয়েছে নারী। আরো এগোবে নিশ্চয়ই।
কিন্তু অভিযোগ তোলার সময় অবশ্যই ভাবতে হবে, কেউ যেন মিথ্যে অভিযোগে অন্যায়ের শিকার না হয়।
দিন শেষে প্রার্থনা, বন্ধ হোক পদ-পদবী ব্যবহার করে যৌন হয়রানি।
ঝড় উঠুক। খুলে যাক মুখোশ। যারা নিপীড়নের শিকার তাদের প্রতি সমবেদনা।
পাশেই আছি আপনাদের।
সারাবাংলা/ এসএস