Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

একটি আত্মহত্যা ও পুরুষতন্ত্রের নির্মম প্রতিশোধ


২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১২:৫৮

একজন তরুণ চিকিৎসক আত্মহত্যা করেছেন। নাম মোস্তফা মোরশেদ আকাশ। আপাততথ্যে জানা যায় স্ত্রীর বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্ক ও দাম্পত্য কলহের কারণে আত্মহত্যা করেছেন আকাশ। যারা এই আত্মহত্যার পেছনে ‘অভিমানী প্রেমিক’ ‘অবুঝ ভালোবাসা’ টাইপ বিশেষন ব্যবহার করে স্নেহসুলভ প্রশ্রয় জোগাচ্ছেন এবং এই আত্মহত্যার কারণ হিসেবে আকশের স্ত্রীর অবিশ্বস্ততার যায়গায় ফুলস্টপ টেনে দিয়ে তার বিরুদ্ধে  ‘আত্মহত্যার প্ররোচনা’র মতো একটি ফৌজদারি অভিযোগ আনছেন, তারা কিন্তু সমস্যার অনেক দূরে বসে টোটকা সমাধান দিচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

পুরো বিষয়টির নির্মোহ বিশ্লেষন করতে পারলে কিন্তু আপনিও বুঝতে পারবেন আকাশের আত্মহত্যা আসলে পুরুষতন্ত্রের নির্মম প্রতিশোধ। প্রথমেই আসি আকাশের মানসিক বিপর্যয় নিয়ে।

আকাশের লেখা বর্ণনাতেই বুঝা যায়, কি রকম ভয়ংকর মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন আকাশ। এই বিপর্যয়ের শুরু কিন্তু আজকে নয়। দশ বছরের পরিচয়ের পর দু’বছর আগে বিয়ে করেন দু’জন। বিয়ের আগেই আকাশ জানতে পেরেছিলেন অতীতে তার স্ত্রীর অন্য একজনের সাথে সম্পর্ক ছিল। এই ঘটনাটা আকাশ মেনে নিতে পারেননি। পারেননি তাঁর ভেতরে জেঁকে বসা পুরুষতান্ত্রিক সংস্কার ও বিশ্বাসের কারণে। যে সংস্কার তার অবচেতনে বিশ্বাস করিয়েছিল যে, তিনি বিয়ে করবেন একজন অনাঘ্রাতা, অক্ষুন্ন যোনীর অধিকারী নারীকে। একজন পূর্ণবয়ষ্ক নারী, যিনি নিজেও একজন ডাক্তার, তার বিয়ের আগে অন্য একটি বা বহু সম্পর্ক থাকতে পারে এই স্বাভাবিক বিষয়টি আকাশের শিক্ষার মধ্যে ছিল না। ছিল না বলেই তিনি এই তুচ্ছ কারণে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার কথা ভেবেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা করতে পারেননি বিয়ের দাওয়াত দেয়া হয়ে গেছে বলে। যে বিয়েটার যাত্রাই শুরু হয়েছে অবিশ্বাস আর অসম্মান থেকে সেই বিয়ের পরের প্রতিটা মুহুর্তে দুজনেই যে সন্দেহবাতিকতার বিষে নীল হয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য। তবে আকাশের মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের পরিস্থিতি বিশ্লেষন করলে ধারণা করা যায় তিনি নিজের প্রতি অনাস্থায় ভুগছিলেন। বিভিন্ন কারণে এটা হতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ কারণ হতে পারে তাদের দাম্পত্য জীবনের যৌন সম্পর্ক। অবশ্য সেটা জানার আর কোন সুযোগ নেই। তবে তার স্ত্রীর উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়া, আকাশের ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স বা নিজের যোগ্যতা বা সম্পর্কে তীব্র সন্দেহ ও অনিশ্চয়তায় ভোগা, ইনঅ্যাডিকোয়েট ফিলিং বা নিজেকে অপর্যাপ্ত মনে করার গ্রহনযোগ্য কারণ। ফলে প্রতিটা মুহুর্তেই সে স্ত্রীকে সন্দেহ করেছে, স্ত্রী আরো বেপরোয়া হয়েছে আর মানসিক সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে সাইকোপ্যাথিক ডিসঅর্ডার ঘটিয়েছে। সময়মত মনোস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাউন্সেলিং নিলে, থেরাপি নিলে এই ডিসঅর্ডার হতোনা।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু পুরুষতন্ত্র তো শৈশব থেকেই পুরুষকে শিখিয়েছে- দুঃখকে স্বীকার করোনা, হার স্বীকার করোনা, কোমলতা পুরুষকে মানায়না, চোখের জল ফেলোনা, ভয় পেওনা, দুর্বলতা প্রকাশ করোনা। এইসব শিক্ষাকে অতিক্রম করে নিজের নাজুকতাকে স্বীকার করতে পারেননি আকাশ চিকিৎসক হয়েও। তবুও এই সংকটের মধ্যে যে দু’দুটো বছর এই বিয়ে টিকে গেছে তার কারণ আর যাই হোক, অন্তত ভালোবাসা নয়। ভালোবাসা আর যাই করুক স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতনের মুখে জোর করে অনৈতিক (?) সম্পর্কের স্বীকারোক্তি নিয়ে ভিডিও ভাইরাল করার শিক্ষা দেয়না। স্ত্রীর ইনবক্স চ্যাট ফেইসবুকে ভাইরাল করতে শেখায়না। যে শিক্ষা এইসব অসভ্য আচরণ করতে বাধ্য করে তা হলো পুরুষতন্ত্রের পেলে পুষে বড় করা পৌরুষের ইগো আর অহম। যে ইগো স্ত্রীর স্বাতন্ত্র্য মেনে নিতে দেয়না। যে ইগো উপেক্ষা মেনে নিতে পারেনা। পরিণামে জন্ম নেয় এটেনশন সিকিং এর মতো আপাত হাস্যকর কিন্তু ভয়ংকর অসুখের। যার জন্য স্ত্রীর ঘাড়ে বন্দুক রেখে আত্মহত্যা করার মতো সস্তা হিরোইজমের কাছে আত্মহত্যা করেন একজন চিকিৎসক।

তবে এসব কিন্তু হওয়ার ছিলো। কেন? কারন, আবার সেই পুরুষতন্ত্র।

যে আইন বানিয়ে, কানুন বানিয়ে নির্ধারন করেছে পুরুষকেই বিয়ের মতো একটি সম্পর্কে যাওয়ার জন্য আর্থিক সক্ষমতা প্রমাণ করতে চড়া অঙ্কের দেনমোহর দিয়ে বৈবাহিক জীবন জামানত রাখতে হবে। আকাশ রেখেছিলো ৩৫ লাখ টাকা। তো, দাম্পত্য সংকটে মুক্তির রাস্তায় চাবুক শাবল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৩৫ লাখ টাকার আর্থিক দণ্ড, আইনি বাধ্যবাধকতা, সমাজের রক্তচক্ষু আর যৌতুকের মিথ্যা মামলার ভয়।

নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নারীকে আর্থিক নিরাপত্তার লোভ দেখিয়ে একদা পুরুষ তৈরি করেছিল এই দেনমোহর আর যৌতুকের মতো মানুষ কেনা বেচার কল, সেই কল নারীকে যতোটা না কেটেছে, পুরুষকেও কেটেছে বহুগুণে। তাছাড়া, পুরুষতান্ত্রিক সংস্কারে ডিভোর্স শুধু নারীর জন্য ট্যাবু নয়, পুরুষের জন্যও। এই সমাজে ‘স্বামী পরিত্যক্ত’ স্ত্রীর জন্য গঞ্জনা থাকে, অপবাদ থাকে, কিছু সমবেদনাও বরাদ্দ থাকে। কিন্তু পুরুষের জন্য থাকে শুধু গ্লানি। নারীর ভিক্টিমহুড পুরুষতন্ত্র যতোটা স্নেহের চোখে দেখে ততোটাই ঘৃণার চোখে দেখে পুরুষের ভিক্টিমহুড। ‘স্ত্রী পরিত্যাক্ত’ স্বামীকে নিতে হয় অক্ষমতার অপবাদ। “বউ ধরে রাখতে না পারা” পুরুষ মানুষ সবার চোখে অ-পুরুষ হয়ে ওঠে। প্রশ্ন ওঠে পুরুষত্ব নিয়ে।

পুরুষত্ব পুরুষের কাছে যৌন সক্ষমতার সমার্থক। কারন, পুরুষতন্ত্র মেয়েদের যোনীতে যেমন পুরে দিয়েছে সতীত্বের বোধ তেমনি পুরুষের শিশ্নে ভরে দিয়েছে সক্ষমতার চ্যালেঞ্জ। পুরুষের কাছে তাই যৌন সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াটা মৃত্যুসম। সুতরাং পুরুষ ধরে রাখতে চায় নারীকে যে কোন প্রকারে। হয় প্রেমে, নয় শাসনে, নয় নির্যাতনে। আকাশও তাই চেয়েছিলো। যার ফলে তার স্ত্রী একসময় “ভুল বুঝে পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নতুন করে জীবন শুরুর আশ্বাস”ও নাকি দিয়েছিলেন। তাই বলে কি আকাশের আত্মহত্যার ঘটনায় কি তার স্ত্রীর কি কোন দায় নেই? খুব অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, একজন পূর্ণবয়ষ্ক মানুষ, একজন চিকিৎসক, যিনি মানুষের আবেগের মেডিক্যাল ডায়গোনোসিস জানেন, তিনি যখন স্ত্রীর অবৈবাহিক সম্পর্কের কারণে আত্মহত্যা করেন, আমি সত্যিই তার জন্য স্ত্রীকে ‘প্ররোচনার’ দায় দিতে পারিনা। সেটা নারী বলে নয়, ঘটনাটা উল্টো হলেও আমি একই অবস্থানে থাকতাম। কারন, দায় আর দায়িত্বের মতো নৈতিক অবস্থানে থেকে মানব সম্পর্কের মতো মনস্তাত্ত্বিক একটি বিষয়ে নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্তে আসাটা আমার পক্ষে সম্ভব না।

নৈতিক পাহারা বসিয়ে বিয়ের মতো নৈতিক প্রতিষ্ঠান হয়তো টিকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু সম্পর্কের সততা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি কোন চুক্তি বা আইন দিয়ে রক্ষা করা সম্ভব না। এটা নির্ভর করে পারস্পরিক কমিটিমেন্ট আর বিশ্বস্ততার উপর। এখন সম্পর্কের মধ্যে থেকে কেউ একজন যদি সেই কমিটমেন্ট ভংগ করেন, অন্য একজন চাইলে আলাদা হয়ে যেতে পারেন। আবার নাও যেতে পারেন। কারণ, বিয়ের মতো সামজিক প্রতিষ্ঠানের আইনি বাধ্যবাধকতা দিয়ে “ডিভোর্স দিয়ে দাও” এর মতো সরল টোটকা চিকিৎসা গ্রহণ করাটা সার্বিক বিবেচনায় সবার জন্য সহজ নাও হতে পারে। কিন্তু এসব বাধ্যবাধকতার ভয়ে একজন মানুষ সারাজীবন প্রতি মুহুর্তে সচেতন থেকে, পা টিপে টিপে চলে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে যেতে পারবে, বা যাবে এমনটা নাও হতে পারে।

মানুষের মনস্তত্ব খুব জটিল একটা জিনিস। বিয়ের আগে যেমন স্বাভাবিক কারণে প্রেম আসে, বিয়ের পরেও ঠিক একই মানবিক কারণেই মানুষের জীবনে প্রেম আসতে পারে। এখন কেউ সেই প্রেমকে গ্রহণ করবেন কি করবেন না, সেটা নিতান্তই তার জীবনের বাস্তবতার উপর নির্ভর করে। এখানে ‘অবৈধ’ ‘অনৈতিক’ বলে ফুলস্টপ দিয়ে দেয়ার আমি আপনি কেউ না। সব শেষে নির্মোহ বিশ্লেষন করলে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে, ‘পরকীয়া’র সাথে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির সম্পর্ক চিরকালই ঋণাত্মক। মূলতঃ বিয়ের মতো একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার জন্যই পরকীয়ার মতো অনৈতিক(?) সম্পর্কটি জিইয়ে রেখেছে পুরুষতন্ত্র।

যতদিন বিয়ে নামক সামজিক প্রতিষ্ঠানটি ধর্মের রক্তচক্ষু দিয়ে প্রেমের মতো মানুষের স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বকে ‘বৈধ-অবৈধ’ বলে নিয়ন্ত্রণ করবে, যতোদিন রাষ্ট্র তার আইন দিয়ে ‘প্রেম’ কে শুধু স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে নির্দিষ্ট করে দিয়ে বাকি সব সম্পর্ককে ‘অবৈধ’ বলে সিদ্ধান্ত দেবে, যতদিন সমাজ নারীর গর্ভ ও গর্ভজাত সন্তানের উত্তরাধিকার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বৈবাহিক সম্পর্ককে ইলাস্টিকের মতো টানতে শেখাবে, ততোদিন পরকীয়ার মতো অসৎ সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য হবে মানুষ। জেনে রাখুন, পুরুষতন্ত্রের স্নেহে বাৎসল্যে তাজা হওয়া বহুগামী সমাজে বসে পরকীয়াকে গালি দিয়ে মূল সমস্যাকে অস্বীকার করতে থাকলে আকাশদের প্রতি সুবিচার তো করা হবেইনা, বরং অসংখ্য আকাশ তৈরি হতে থাকবে “চিরশান্তির পথ” বেছে নেয়ার জন্য। এই বাস্তবতা স্বীকার করা বা না করা আপনার স্বাধীন ইচ্ছা।

 

সারাবাংলা/এসএস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর