মা হওয়া মানে কি স্বপ্ন বিসর্জন দেয়া?
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৪:৩২
আমার মা প্রায়ই একটা কথা বলেন-‘যাই কর, স্বপ্ন বেচো না।‘
কেন বলতেন ছোটবেলায় বুঝতাম না। এরপর যত বড় হতে থাকি তত বুঝতে থাকি তাঁর গহীনের কষ্টগুলো। একদম ছোটবোনটি যখন জন্মায় তখন আমার বয়স সাত। মোটামুটি সব বুঝি। ছোটটি হবার পর মায়ের সাথে সাথে থাকতাম। ঘরের কাজে সাহায্য করতাম, বাজার করে দিতাম। তিনি মুখ বুজে কাজ করতেন সারাদিন। বাচ্চা হবার পর তাকে কেউ বলেনি তাঁর কি খাওয়া উচিত, তাঁরও যত্নের দরকার আছে, তাঁরও একটু অবসরের দরকার আছে। তিনি বিরক্ত হলেই আমাকে বলতেন-‘পড়ালেখা কর ভালো করে যেন আমার মত এরকম থাকতে না হয়’।
আম্মা কখনো মুখ ফুটে বলেননি তাঁর পছন্দের রঙ কী, কী খেতে ভালোবাসেন, কী পরতে ভালোবাসেন, কী করতে ভালোবাসেন। অথচ বড় হতে হতে জেনেছি আম্মার পছন্দের রঙ লাল, তিনি পাড়হীন শাড়ি পরতে ভালোবাসেন, আম্মার ভেতরে একটা বাউন্ডুলে মন আছে, আম্মা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তাঁর প্রেমিককে। তাদের অজস্র দুষ্টামী, হাসাহাসিকেই ভালোবাসার সংজ্ঞা জেনেছিলাম।
আচ্ছা, মায়েদের কি বাউন্ডুলে মন থাকতে নেই? বাবাকে দেখেছি অফিস সেরে পছন্দের কাজ তাস খেলে রাত করে বাড়ি ফিরতেন, পছন্দের কাজ টিভি দেখতেন। আমার মায়ের কি একবেলা একা কোথাও বসে থাকতেও ইচ্ছে করেনি কোনদিন? মাঝেমাঝে চুপচাপ কি যেনো ভাবতেন। কথা বলতে গেলে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিতেন। আম্মা কি তখন নিজের শৈশবের কথা ভাবতেন? নাকি মরে যাওয়া স্বপ্নের কথা ভাবতেন? যে স্বপ্ন বেচে দিতে হয়েছিলো সামাজিক নিয়মের বাজারে!
আম্মার কৈশোরের ছবি দেখেছি। কাজলচোখে হালকা হাসিতে এক কিশোরী। আমি এখন জানি, আম্মা সাজতে ভালোবাসতেন, ঘুরতে ভালোবাসতেন, পড়তে ভালোবাসতেন। বইমেলার মৌসুমে আমাদের সাথে সাথে আম্মারও উৎসব পড়ে যেত। বইমেলার স্টলে স্টলে ঘুরে বই নেড়েচেড়ে দেখতেন। ফুচকা ঝালমুড়ি খাওয়া আমার মায়ের দিকে কেউ তাকালেই তখন বুঝতো আজো তাঁর ভেতরে এক কিশোরীর বাস।
একজন নারী সন্তান ধারনের পরে আমূল বদলে যান। তাঁর শারীরিক পরিবর্তন, মানসিক পরিবর্তন, দৈনন্দিন রুটিনের পরিবর্তন তাকে সম্পূর্ন নতুন জগতে এনে ফেলে। আর সেখানে তাঁর নিজেকে বদলে নিতে হয় দ্রুত। কিন্তু মা হবার পর একজন নারীকে কেনো তাঁর সকল স্বপ্ন, সকল চাহিদা বিসর্জন দিতে হবে?
ডেলিভারির পর মানসিক অবসাদে কাটান অনেক নারী। মানসিক সমস্যাও দেখা দেয় অনেকের, তারা শরণাপন্ন হন ডাক্তারের। তাঁর এ সময়ের কাজের সঙ্গী যদিবা পাওয়া যায় মানসিক সঙ্গী পাওয়া দুষ্কর। অথচ মা হয়ে যাওয়া নারীটি হয়তো ঘুরতে ভালোবাসতেন, সাজতে ভালোবাসতেন, পড়তে ভালোবাসতেন, খেতে ভালোবাসতেন। যেগুলো এক লহমায় বন্ধ হয়ে যাওয়াতে তাঁর মানসিক পীড়ন কাজ করে। সে হয়তো তাঁর এ পরিবর্তিত জীবনের কথাগুলো বলবার মানুষও পায় না। মা হবার পর নারীর পরিচয় শুধু ‘মা’তে আটকে দিয়ে তাকে ‘ভালো মা’ হবার একশ একটি উপায় দেখিয়ে দেয়া হয় যেখানে বাচ্চার কাঁথা বদলানো থেকে কিভাবে বাচ্চার চুল আঁচড়াতে হয় সব থাকে। ভালো মা হতে গেলে তাকে যুদ্ধে নামতে হয় যে যুদ্ধে ঠিকমত ঘুমানো যাবে না, আলস্য থাকবে না, তাঁর কোন স্বপ্ন থাকবে না, শখ আহ্লাদ থাকবে না, ক্যারিয়ার থাকবে না। যদিবা কিছু থাকে তো সে ভালো মা হতে পারবে না। যা কিছু থাকবে সব সংসার ও সন্তানকেন্দ্রিক। অথচ মা হবার আগে ও পরেও নারীটির ভেতরে একটি মানুষের বাস আছে। যে মানুষটির সন্তান সংসার বাদেও একটা জগত আছে। যে জগতের আকাশে তাঁর ওড়বার কথা, যে জগতের মাটিতে ফুল ফুটবার কথা। কিন্তু ভালো মা ভালো বৌ হবার চব্বিশঘন্টার কায়দাকানুনের অতল খাদে হারিয়ে যায় তাঁর সবকিছু।
আমার বন্ধুরা সম্প্রতি মা হয়েছেন। তাদের কারো কারো শুরু হয়েছে মানসিক অবসাদ। নিয়মিত রুটিনে চলা নারীটি এখন তাঁর শারীরিক পরিবর্তন, মানসিক পরিবর্তন, রুটিনের পরিবর্তনে হাঁসফাঁস করছেন। তাঁর একটু ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করে, পছন্দের খাবার খেতে ইচ্ছে করে, একটু নিজের মত সময় কাটাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তাঁর কিছুই করা হয়ে ওঠে না, মুখ ফুটেও বলেন না। হয়তো ভয়ে থাকেন নিজেকে সময় দিলে আশপাশের মানুষ কি বলবে। এ সমাজে মা হলে তো আত্মত্যাগে বলিয়ান হওয়া জরুরী! অথচ একজন নারীর সন্তান জন্ম থেকে লালনপালনের আত্মত্যাগের মুল্য কয়েকটি মহানুভব বাক্যেই সীমাবদ্ধ।
সদ্য মা হওয়া আমার বন্ধুকে বলেছিলাম-‘ধর, একবেলা কয়েকঘন্টার জন্য বাচ্চাকে যদি বাবা দেখাশোনা করে আর তুই যদি একটু ঘুরতে যাস তাহলে বাচ্চার কি ক্ষতি হচ্ছে? কিংবা শপিং করতে গেলে, বন্ধুদের সাথে ঘন্টাখানেক আড্ডা দিতে গেলে কি কোন ক্ষতি আছে? নেই। কিন্তু মায়েরা এমন ভাবতেই পারে না। মায়েদের এমন ভাবাটা এ সমাজে গর্হিত অপরাধ! বাবাদের অবশ্য এমন ভাবাভাবির ব্যাপার নেই। আমি বাবাদের ছোট করছি না, তাদেরও জীবনভর আত্মত্যাগ আছে। কিন্তু একজন নারীর মত আছে কি না সেটা ভাববার বিষয়। আর একজন নারীর নিজেকে নিয়ে সকল চিন্তা জলাঞ্জলি দিয়ে আত্মত্যাগে ভাস্বর হবার কোন দরকার আছে? ইতিহাসে সেই আত্মত্যাগে বলিয়ান নারীদের নাম কই?
আমার মা’কে দেখেছি, আরো অনেক মা’কে দেখেছি, সদ্য মা’দের দেখছি। আমি চাইনা আমার মায়ের মত স্বপ্ন বিসর্জন দেয়া মা হোক সবাই। মায়েদের চোখে স্বপ্ন থাকুক। মায়েরা কাজ করুক, মায়েরা ঘুরুক ফিরুক। সন্তান সংসারের শেকলে বাধা পড়ে সকলকিছু বিসর্জন না দিক। মায়েরা যে শুধু মা সত্তা নিয়ে বসবাস করে না, তাঁর ভেতরে যে একটা নারীসত্তা আছে সেটা আমরা ভুলে না যাই। একটু অন্যভাবে ভাবলে সমাজের কোন ক্ষতি হবে না। আর যে সমাজে একজন নারীর স্বপ্ন দেখা মানেই সমাজের বিরাট ক্ষতি সে সমাজ নিয়ে ভাববার সময় নিশ্চয়ই এসেছে।
সারাবাংলা/এসএস