দুর্গা পূজায় নারীশক্তি: প্রাচীন ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
৮ অক্টোবর ২০১৯ ১১:৪০
– সিলেটের মাহজাবিন হক। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (নাসা)।
– আনুচিং মগিনি। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল দলের স্ট্রাইকার। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের এক রাতে ভুটানের জালে বাইসাইকেল কিকে করলেন এক নান্দনিক গোল।
– ডা. নীলিমা ইয়াসমিন। চিকিৎসকদের জন্য ৩৯তম বিশেষ বিসিএস পরীক্ষায় ৪ হাজার ৭৯২ জনের মাঝে প্রথম হয়ে দেশসেরা হলেন তিনি।
এসবই এখন সাধারণ, স্বাভাবিক ঘটনা। শিক্ষা ক্ষেত্রে, কর্ম ক্ষেত্রে, খেলাধূলায় বাংলাদেশের নারীরা এখন শুধু পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলছেন না, প্রায়ই পেছনেও ফেলছেন তাদের। সুযোগ ও চর্চার পরিবেশ পেলে লিঙ্গবিভেদ যে কোনো বাধাই হতে পারে না, তার প্রমাণ আমরা প্রতিনিয়ত পেয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু এর বিপরীত চিত্রও কম নেই। দেখা যাক তেমন কয়েকটি ঘটনা—
– নুসরাত জাহান রাফি। ফেনীর সোনাগাজীর এক মাদারাসাছাত্রী। অধ্যক্ষ সিরাজৌদ্দলার যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করার কারণে জীবন্ত দগ্ধ করে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল তাকে।
– ফারজানা আক্তার। যৌতুক না পেয়ে কাফরুলের এই গৃহবধূকে তার স্বামী পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল।
বাংলাদেশের আধুনিক সমাজে নারীর সামনে যেমন একে একে খুলে যাচ্ছে সুযোগ ও সমতার দুয়ার, তেমনি অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনাও থেমে নেই। সবক’টি ক্ষেত্রেই দায়ী পুরুষতান্ত্রিকতা। নারীর অগ্রগামিতায় বাধা দেওয়া থেকে শুরু করে প্রাণ নিয়ে নেওয়া পর্যন্ত অপরাধের বিচিত্র রূপ।
আজ শুভ বিজয়ার দিনে নারীশক্তির কথায় আলোচনা করা যাক প্রাচীন ভারতবর্ষে নারীর মর্যাদা ও সেই মর্যাদার অবমাননার সূচনার ইতিহাস।
হিন্দু শাস্ত্রে দুর্গা পূজাকে বলা হয়ে থাকে নারীশক্তির আরাধনা। এর রয়েছে কৌতূহলোদ্দীপক ইতিহাস, যেটি সামাজিক প্রথা ও আচারের পথ বেয়ে হয়ে উঠেছে শাস্ত্রের অনুষঙ্গ।
আদি ভারতবর্ষে প্রাচীন সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। অর্থাৎ পরিবার ও সমাজে নারীই প্রধান। দেবী পূজার প্রচলন তখন থেকেই। সংসার, সমাজ ও সংগ্রামে যে নারী বাস্তব পৃথিবীতে প্রধান, সেই শক্তির আরাধনাই দেবী পূজার সূচনা করেছিল। নানা দেবীর পূজা নানাভাবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছিল, দেবী দুর্গার পূজা তার মধ্যে অন্যতম। দেবী দুর্গা যুগে যুগে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে দেবতা ও মানবসমাজকে রক্ষা করেছেন— এই বিশ্বাসই লালন করেন আজকের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও। দেবী দুর্গার মাহাত্ম্য কতটা বেশি, তা বোঝা যায় যখন হিন্দু পুরাণে উল্লেখ পাই দেবতা কৃষ্ণ, ব্রহ্মা ও মহাদেবও দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন।
প্রাচীন বৈদিক ভারতে নারীদের সম্মান ও অবস্থান ছিলো সুদৃঢ়। মৈত্রেয়ী, গার্গী, লোপামুদ্রার মতো নারীদের উপাখ্যানে বর্ণিত রয়েছে— শাস্ত্রের আলোচনায় বিদুষী নারীরা সমানভাবে পুরুষের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন, তাদের সাথে তর্ক করেছেন। বৈদিক সমাজে নারীরা পারতেন নিজের রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী পুরুষসঙ্গী নির্বাচন করতে, বিধবাদেরও ছিল পুনর্বিবাহের অধিকার।
বৈদিক সমাজ ও মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অবসানে সামাজিক ন্যায়-অন্যায়ের অধিকার যখন পূর্ণভাবে পুরুষের হাতে চলে গেল, তখন থেকেই মূলত নারীদের অবমাননার কাল শুরু। ‘মনুসংহিতা’ নামের একটি নারীবিদ্বেষী, পুরুষতান্ত্রিক শাস্ত্র দিয়ে নারীদের মর্যাদা নামিয়ে আনা হয় একেবারে মাটিতে। এ শাস্ত্রে এমন স্তোত্রের কথাও উল্লেখ আছে, যাতে বলা হয়েছে— ‘নারীকে বাল্যকালে পিতা, যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্র রক্ষা করবে; নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয়।’ নারীর মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করে তাকে ভোগ্যবস্তুর স্তরে নামিয়ে আনতে এ গ্রন্থটি হিন্দু সমাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। যার ফলাফল আমরা ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্যন্ত দেখতে পাই। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো নমস্য ব্যক্তিদের জীবনব্যাপী প্রচেষ্টায় সতীদাহ প্রথা রোধ করা থেকে শুরু করে বিধবা বিবাহ প্রচলন করা গেছে ঠিকই, হিন্দু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনও নারীবিদ্বেষী প্রথা ও আচরণ প্রবহমান, যার ব্যাখ্যায় ধর্মীয় নেতারা শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে নিপীড়ক পুরুষতান্ত্রিকতারই জয়গান করে থাকেন।
বাংলাদেশে হিন্দু পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইন নামে যেটি প্রচলিত আছে, তাতে সুস্পষ্টভাবে নারীকে বঞ্চিত করা হয়েছে। পিতার মৃত্যুর পর পুত্রই সম্পত্তির অধিকারী হয়, কন্যার এতে বিন্দুমাত্র অধিকার থাকে না। হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইনও বাংলাদেশে কার্যকর নেই। বাংলাদেশে প্রচলিত রয়েছে হিন্দু দায়ভাগ আইন, অর্থাৎ হিন্দু বিবাহিত নারী নিপীড়নের শিকার হলেও বাংলাদেশের হিন্দু পারিবারিক আইন তাকে বিচ্ছেদের অধিকার দেয় না। বিচ্ছেদের জন্য এমন কঠিন কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে, যেন একজন নারী এ আইনের অধীনে সহজে বিচ্ছেদ না পান। যেসব ধর্মীয় নেতা শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে এসব আইন পরিবর্তনের ঘোর বিরোধিতা করেন, তারা প্রত্যেকেই সমাজে জিইয়ে রাখতে চান পুরুষতান্ত্রিকতা।
প্রতিবছর দুর্গা পূজার প্রাক্কালে শুনতে পাওয়া যায় নারীশক্তির মাহাত্ম্যের কথা। মূলত মাতৃরূপে দেবী দুর্গার পূজাতেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের ভক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন। বাস্তব পৃথিবীতেও আমরা এর প্রতিফলন দেখতে চাই। দেখতে চাই উত্তরাধিকার আইনে সমতা, দেখতে চাই বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদের বৈষম্যহীন সরল আইন। না হলে দেবী দুর্গার আরাধনায় নারীশক্তির জয়গান কেবল লোক দেখানো ফাঁপা বুলিই মনে হবে।