নারীর শীর্ষ ক্ষমতা কী পুরুষতন্ত্রকে খর্ব করে?
১১ অক্টোবর ২০১৯ ১০:৪৫
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কিছু শীর্ষপদে নারী আছেন বলেই কিছু কোটা, সংসদে কিছু সংরক্ষিত আসন, বাসে কটা ‘নারী-শিশু-প্রতিবন্ধী’ সিট বা কিছু পুরুষতান্ত্রিক আইন প্রণয়ন করেই যারা নারীবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বা রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে বা পুরুষতন্ত্র দুর্বল হয়েছে ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন বা ‘নারীবাদীরা আর কী কী চায়’ বলে বিরক্ত হচ্ছেন, তাদের জন্যই এই আলোচনা।
মূলত ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের রসায়নই একমাত্র ও চুড়ান্ত সত্য। সে রাষ্ট্রক্ষমতাই হোক বা নারী পুরুষের ব্যক্তি হিসেবে সম্পর্কের ক্ষমতা। আর রাষ্ট্রক্ষমতার রাজনীতির মাঠ বিশ্বব্যাপীই পুরুষতন্ত্রের এবং রাজনীতিকে পুরুষের বিশ্ব হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। সেই বিশ্বে ক্ষমতা চর্চা কখনো পুরুষের হাত ধরে করা হয়, কখনো বা নারীর। সেই ক্ষমতার চর্চা নারীর স্বার্থ রক্ষার জন্য যতুটুকু করা হয় তার চাইতে অনেক বেশী করা হয় পুরুষের এবং পুরুষতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য।
ইতিহাস সাক্ষী, বিশ্বের ক্ষমতাবান কোন নারীই ক্ষমতাকেন্দ্রে বসে পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করেননি, বরং ক্ষমতালোভী পুরুষের মতোই আচরন করেছেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডলিৎসা রাইস। তিনি একই সঙ্গে একজন নারী এবং একজন কালো মানুষ হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন এবং বর্ণবাদী নিপীড়নেরও প্রতিনিধি। কিন্তু ক্ষমতাসীন হয়ে মার্কিন সাম্রাজের একজন শীর্ষ আগ্রাসী পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কিছু করেননি রাইস। যুক্তরাজ্যের লৌহমানবী খ্যাত প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ক্ষমতায় থাকার জন্য কীভাবে নারীবাদীদের বিরুদ্ধাচরন করেছেন সেই প্রমাণও ইতিহাসে রয়েছে।
তেমনি নিকট অতীতেই আমরা দেখেছি, হিলারী ক্লিনটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য পুরুষতন্ত্রের সুবিধাভোগী হিসেবে কর্পোরেট নারীবাদকে প্রকাশ্যে কীভাবে ব্যবহার করেছেন। ম্যানহাটনের শিক্ষক স্যাম মিলার ‘জ্যাকোবিন’ সাময়িকীতে ‘ট্রাম্প অ্যান্ড উইমেন: অ্যা মার্ক্সিস্ট ক্রিটিক’ এ বলেছেন, ‘রাজনীতির বাজারে ট্রাম্প ও হিলারীরা চিরদিনই বন্ধু। উভয়েই ব্যবসায় ও রাজনীতিতে উপরে ওঠার জন্য ভেতরের পাশবিক রূপটি ঢেকে রাখতে নারীকে এবং নারীত্বকে ব্যবহার করেন। যেমন, ট্রাম্পের মেয়ে ইভাঙ্কা ও তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক বন্ধু হিলারি—উভয়েই করপোরেট নারীবাদের হাতে নারীর প্রকৃত স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে মুনাফা অর্জনের বা ক্ষমতা লাভের জন্য নারীকে কাজে লাগান। তাই ক্লিনটনের লাম্পট্যের প্রতিবাদ না করে তার রাজনৈতিক বিপদের দিনে হিলারি তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন যেমনটি আজকে ইভাঙ্কা তার বাবার রাজনৈতিক বিপদের দিনে চারিত্রিক সনদপত্র দিচ্ছেন সব লাম্পট্যকে সমর্থন করে।’
ইতিহাস বিশ্লেষনেও আমরা দেখি, বিশ্বব্যাপী নারী নেতৃত্বের ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং সার্বিকভাবে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন একেবারেই ভিন্ন বিষয়। শ্রীলঙ্কায় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের হাত ধরে বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রিয় নেতৃত্বে নারীর আগমন ঘটেছে। তারপর ইসরায়েলের গোল্ডামেয়ার, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, যুক্তরাজ্যের মার্গারেট থ্যাচার, ফিলিপিনের কোরাজন আকিনো, পাকিস্থানের বেনজির ভুট্টো, বাংলাদেশে খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছানো নতুন রাজনৈতিক ধারনার জন্ম দিলেও সময়ের সাঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়েছে যে, ক্ষমতার চেয়ারের বসা নারী এবং সেই নারীকে চালানো পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি আসলে পরস্পরের স্বার্থরক্ষাকারী বন্ধু।
সেজন্যই এই প্রভাবশালী নারীরা তাদের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম ও ক্ষমতাবলয়কে চ্যালেঞ্জ করেননি। বরং সর্বোতভাবেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামো, রীতিনীতি ও মনস্তাত্বিক প্রক্রিয়ার অধীনেই তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চা করেছেন। আপোস করেছেন, শক্তিশালী করেছেন পুরুষতন্ত্রের হাতকে। পুরুষালি রাজনীতিবিদদের মতো যুদ্ধবাজি,অস্ত্রবাজি করেছেন এবং সাম্প্রদায়িকতা পুষে রেখেছেন।
এবার আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। গত দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে বাংলাদেশে নারীরা রাজনীতি এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে থাকলেও নারী নীতি, সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন কিংবা অভিবাবকত্ব আইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কোন মিমাংসা হয়নি। দৃশ্যমান হয়নি ধর্ষণের মতো নারীর প্রতি পুরুষের যৌন সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও অগ্রগতি, রাজনৈতিক এজেন্ডায় প্রাধান্য পায়নি সর্বস্তরে নারীর সর্বোত্তম স্বার্থ সুরক্ষা।
নারীর হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকা স্বত্তেও যদি নারী-পুরুষের সমাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হয়, যদি নারীর জন্য সন্তানের অভিবাবকত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হয়, যদি সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যমুলক আইনের পরিবর্তন না হয়, যদি এখনো ধর্ষিতাকেই ধর্ষন প্রমাণ করতে হয়, যদি পুরুষের বৈষম্যমুলক নিয়ম আইন প্রণেতাদের মধ্যে ক্ষোভের উদ্রেক না করে, তবে নারী যতোই শীর্ষক্ষমতায় বসুক না কেন, সে ক্ষমতা পুরুষতন্ত্রের নারীরূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। যেমনটা বলেছেন হুমায়ুন আজাদ, ‘বিশ্বের নারী নেতারা নারীদের প্রতিনিধি নয়; তারা সবাই রুগ্ন পিতৃতন্ত্রের প্রিয় সেবাদাসী’।
বিশ্বব্যপী ক্ষমতাশীন এই নারীরা পুরুষতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষা করে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ বোধহয় এটাই যে, এদের অধিকাংশই প্রভাবশালী, ধনাঢ্য, ক্ষমতাবান, কিংবা খ্যাতিমান পরিবার থেকে এসেছেন যার কারণে পারিবারিক প্রভাব বা ক্ষমতাবলয়ে বেড়ে ওঠা এই নারীদের সমাজে চলমান বৈষম্য বা প্রথাগত অত্যাচার তেমন সহ্য করতে হয়নি। যা অন্য সাধারন নারীকে করতে হয়েছে। বরং সমসাময়িক প্রতিকূলতায়ও পরিবার তাঁদের পদ ও ক্ষমতাকে সুরক্ষা ও সুবিধা দিয়েছে যার অবদান তাঁরা অস্বীকার করতে পারেননি।
যেমন আমরা দেখি, আরবে যে যুগে কন্যা সন্তানদের জীবিত কবর দেওয়া হত, সে যুগেই বিবি খাদিজা বড় ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ইউরোপে যে সময় ডাকিনী হবার মিথ্যা অভিযোগে নারীদের জীবিত আগুনে পোড়ানো হত, সেই সময়ে ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ কিংবা স্পেনের রাণী ইসাবেলা ‘উইচ হান্ট’ যুগে দাপটের সাথে রাজ্য শাসন করেছেন।
নারী স্বাধীনতার সূচকে তলানিতে থাকা পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টোর মত জাঁদরেল নারী নেত্রী বা বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খাঁ এবং স্পিকার ডঃ ফাহমিদা মির্জা, তাঁরা প্রত্যেকই অনেক প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য। কাঠ মোল্লারা তাদের নিয়ে মন্তব্য করার সাহস করেনা, যেমন বাংলাদেশে ধর্ম ভিত্তিক দলগুলো পর্দা নিয়ে বিভিন্ন দাবী দাওয়া তুললেও বিএনপি এবং আওয়ামীলীগ এর মতো নারীপ্রধান দল নিয়ে কিছু বলেনা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূরণ কারণ হলো, যে রাজনৈতিক দল প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিরোধীনেতার ক্ষমতার উৎস, সেই দল রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহনকে নিষ্কণ্টক করেনা, উৎসাহিত করেনা। বরং একজন নারীকে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ বা শীর্ষপদে আসতে হয় সেটি পুরুষ নিয়ন্ত্রিত এবং নারীর প্রতি বৈষম্যমুলক। তাই প্রধানমন্ত্রী নারী হলেও পুরুষতান্ত্রিক এই সিস্টেম এর বাইরে যেতে পারেননা।
এই বাস্তবতায় পুরুষতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে, পরিবারের প্রভাব ও নিরাপত্তাবলয়ে থেকে রাজনীতি করে নারীরা শীর্ষপদে পৌঁছতে পারলেও নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন তাতে হবেনা। বরং দেশের সাধারন বৈষম্যপিড়িত নারীরা, নিজের অভিজ্ঞতাকে নিজ যোগ্যতায় রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে নিয়ে যেতে পারলেই নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্ভব ।
সেই নারীরা, যারা সন্ধ্যার অন্ধকারে ধর্ষনের ভয় নিয়ে ফুটপাতে একা হাঁটে বা রাতের বাসে ঘরে ফেরে, যে নারী তার প্রাত্যহিক জীবনে টিকে থাকার সংগ্রাম করেছে, আর ডানে-বামে-উত্তরে-দক্ষিণে নিষধের কাঁটাতার পেরিয়ে রাজপথে এসেছে, যে নারী রাজনীতিতে পুরুষ সহকর্মীর হাতে সহিংসতার শিকার হয়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছে, পুরুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, টাকার জোর ,পেশীর জোর, আগ্রাসন ইত্যাদিকে পদে পদে মোকাবেলা করে রাজনীতি চর্চা করেছেন তাদের হাতে ক্ষমতা এলেই নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যাবে। তখনই সমাজে নারীদের নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।