নাজমা-আবিরন: দেশপ্রেম, পুণ্যচিন্তা ও বন্ধুত্বের মূল্য
৩১ অক্টোবর ২০১৯ ১৭:০৪
কোন রাষ্ট্রের নাগরিকের কাছ থেকে যে কোন ধরণের শ্রম কেনার উদ্দেশ্যে তাকে অন্য রাষ্ট্রে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করাটা পক্ষান্তরে সেই রাষ্ট্র বা ভূখণ্ডকেই নির্যাতন করার সামিল। সেদিক দিয়ে সৌদি আরবকে ধর্ষক ও বাংলাদেশকে ধর্ষণের শিকার রাষ্ট্র বললেও কিছুমাত্র ভুল হবে না। আর নির্যাতিত রাষ্ট্র তার নাগরিকের নির্যাতন অগ্রাহ্য করে টাকা-পয়সা কামানোর চিন্তায় মাটি কামড়ে সব সয়ে নেয়াকে আত্মসম্মান ও মেরুদণ্ডহীনতা বলে।
ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন, শ্রীলঙ্কা যখন নির্যাতনের প্রমাণ পেয়ে সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয়, ঠিক তখনই দৌড় দিয়ে বাংলাদেশ গৃহকর্মী পাঠানোর চুক্তিপত্রে সই করাকে অপরিণামদর্শী বললে কম বলা হবে। কোন দেশে শ্রমিক পাঠানোর আগে ন্যূনতম অনুসন্ধান করা কি যেত না? দেশের অভ্যন্তরে যে বাহিনীরা সাধারণ নাগরিকের নাড়ি-নক্ষত্র, পাতিলের মাছ-শাকের খবর পর্যন্ত বের করে ফেলতে পারে; বললেই তারা ভিন্ন রাষ্ট্রে শ্রমিকের সাথে কীরূপ আচরণ করা হয় তা খুঁজে পেত না এমনটা বিশ্বাস করা যায় না। আর, সৌদি আরবের ঘরে ঘরে নারীদের সাথে কী কী ঘটে তা তো সর্বজন বিদিত। যারা নিজের পরিবারের নারীকে যৌনবস্তুর বাইরে কিছু ভাবতে পারে না, তাদের কাছে চালচুলোহীন হাওয়ায় ভেসে আসা অচেনা নারী কী ‘ট্রিটমেন্ট’ পাবে, তা না বোঝার মতো অবোধ কি আদৌ কেউ আছে।
স্যাটেলাইট-স্পেসশিপ পাঠিয়ে মঙ্গল-বুধ-বৃহস্পতি ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলার কালে সৌদি আরবে নারীদের গেরস্থালীর কাজ করতে পাঠানোকে তাই জেনেবুঝেই নির্যাতনের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। তো জেনেবুঝে যখন কেউ কিছু করে, তাকে নতুন করে জানানোর কিছু থাকে না। বরং ধরে নেয়া যায়, এই নির্যাতনের ঘটনাকে অতিরঞ্জন বলা বা চেপে যাওয়া বা বড়জোর ‘আমরা বিষয়টা দেখব’ বলে বিমানবন্দরে আসা লাশ স্বজনের কাছে পৌঁছে দেয়ায় সহায়তার বেশি যে আর কিছু করবে না তা পাগলেও জানে।
দীর্ঘদিন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চোখ-কান বন্ধ ছিল। নারী শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশ অন্য দেশে তার দূতাবাসে নিজের নাগরিকের জন্য সর্বোচ্চ পরিমান নিরাপত্তা ও সহায়তার ব্যবস্থা রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে তার চিত্র পুরোপুরি উল্টো। সহায়তা করা তো দূরের কথা, ন্যূনতম ভাল ব্যবহার পর্যন্ত প্রবাসী নাগরিকের সাথে করা হয় না। আর সে নাগরিক যদি হয় শ্রমিক; রাজমিস্ত্রী, গৃহকর্মী বা ক্লিনার তাহলে তো পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়।
ফেরত আসা নারী শ্রমিকদের ধর্ষণসহ নানাভাবে নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগে বিবিসির রিপোর্টে ‘সরকারি কর্মকর্তারাও বলছেন, এসব অভিযোগের কিছুটা সত্যতা আছে’ পড়ে সে ধারণা আরো পোক্ত হয়। যা প্রমাণিত সত্য, যা এ দেশের আপামর জনগণের ফোনে-কম্পিউটারে, তার সত্যতা সরকারি কর্মকর্তার কাছে ‘কিছুটা’ হওয়া এবং এতগুলো বছর ধরে চলে আসা নির্যাতনের খবর, ভিডিও, ছবি চাপে পড়ে গত ২৬ সেপ্টেম্বর স্বীকার করা প্রমাণ করে শ্রমিকদের জন্য রাষ্ট্রের বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা বা দায়িত্ববোধের কোনটাই নাই।
আবিরন-নাজমার খুনের চাকুতে রাষ্ট্র এতদিন ধরে শান দিয়ে এসে এখন কোনভাবেই দায় এড়াতে পারে না। দায় এড়াতে পারে না সমাজও। ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হয়ে আসা নারীকে যে সমাজ নিগৃহীত করে , সে সমাজের মানুষ কী করে লাখ লাখ টাকা খরচ করে হজ্ব পালন করতে যান! যে নির্যাতক রাষ্ট্রের হাতে, যে রাষ্ট্রের পুরুষের হাতে দেশের লাখ লাখ নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, খুনের শিকার হচ্ছে তাদের বয়কট না করে নির্যাতিত নারীকেই একঘরে, বঞ্চিত করে রাষ্ট্রীয় খরচে বা ভর্তুকিতে হজ্ব পালন করা স্পষ্টত: ভণ্ডামি। জেনেশুনে লাখ লাখ নারীর চিৎকার-আহাজারির ওপর দাঁড়িয়ে পূণ্যলাভ কি আদৌ সম্ভব।
ভণ্ডামির আরেক সারিতে আছেন আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের কর্পোরেট প্রোজেক্টের অন্তর্গত জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক-বাহকেরা। যে মা, মাটি-জল, হাওয়া নিয়ে দেশপ্রেমের ফ্যান্টাসি করতে করতে, ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ’ রচনা লিখতে লিখতে বড় হয়েছে; সে মা, মাটি, জল, হাওয়াকে কখনো কিছু রেমিট্যান্স, কখনো বা বন্ধুত্বের নামে অন্য রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়াকে আর যাই হোক জাতীয়তাবাদ বলে না। এমনকি দেশপ্রেমও বলে না।
জাতীয়তাবাদী বা দেশপ্রেমিক হবারও অনেক আগে বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হওয়া জরুরী। নির্যাতনকে উন্নয়ন আর আত্মসম্মানবোধ বিকানোকে বন্ধুত্বের হাস্যকর মোড়ক থেকে মুক্ত করা জরুরী। মেরুদণ্ড সোজা করে এখনই শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে, অন্যের হাতে নিজের সর্বস্ব তুলে দেয়ার স্বার্থবিরোধী চুক্তি থেকে সরে আসা জরুরী। মনে রাখা ভাল যে দেশপ্রেম, পূণ্যচিন্তা বা বন্ধুত্বের জন্য মানবিক বিবেচনা লোপ পায়, তা থাকার চেয়ে না থাকাই বরং পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতির জন্য মঙ্গল।