নারীর যৌনতা, পুরুষের আতঙ্ক
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১২:০৬
“পুরুষের কামানুভূতি তীরের মতো জেগে ওঠে, যখন এটা পৌঁছে বিশেষ উচ্চতায় বা সীমায়, এটা পূর্ণতা লাভ করে এবং হঠাৎ মারা যায়। তার রমণকর্মের ধরণ সসীম ও ধারাবাহিকতাহীন। নারীর সুখ বিকিরিত হয় সারা শরীর জুড়ে; এটা সবসময় যৌন প্রত্যাঙ্গগুলোতে কেন্দ্রীভূত হয় না।”
সিমোন দ্য ব্যোভোয়ার নারী ও পুরুষের যৌনতার প্রসঙ্গে তার ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ এভাবেই লেখ্য রূপ দিয়েছেন নারী ও পুরুষের যৌনতার।
মানব সম্প্রদায়ের যৌনতার ইতিহাসে জৈবিক তেমন কোন পরিবর্তন না আসলেও সামাজিক প্রতিবেশ যৌনতার ইতিহাসকে ক্রমশ পরিবর্তিত ফরমে নিয়ে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও নিয়ে যাবে। বানর, শিম্পাঞ্জি বা একই পর্বের অন্যান্য প্রাণিদের যৌন-আচরণ পুরোপুরি জৈবিক ও একই রকম থাকলেও শুধুমাত্র মানুষের ক্ষেত্রে কয়েক লক্ষ বছরে কয়েক লক্ষ রকমের পরিবর্তন এসেছে। যদিও সমগ্র মানব-জাতির ইতিহাস পাঁচ হাজার বছরের, এর আগের প্রাগৈতিহাসিক শতাব্দীর কোন দলিল-প্রমাণাদি সেরকম পাওয়া যায়নি বলে গবেষকরা জানান। মানুষের যেহেতু ভাষা আছে, সংস্কৃতি আছে এবং নিজে শিখে অপরের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল আছে তাই যে কোন পরিবর্তনে মানুষ অপেক্ষাকৃত বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
বর্তমান সমাজে যৌনতার প্রসঙ্গে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা মোটেই প্রাকৃতিক নয়, বরং পুরোটাই আরোপিত। এই পরিবর্তিত কাঠামোয় বিরাজমান প্রতিবন্ধকতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ দেয় স্বয়ং সমাজ। নারীর যৌনতা নারীর কাছে দাবি করে তার সর্বস্ব। যৌন সম্পর্ক নারীর কাছে কেবলমাত্র যোনীয় নয়। শৈশব থেকে শারীরিক পূর্ণতার ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ নারী হয়ে ওঠার পর যৌন সম্পর্কের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর সমষ্টিই হচ্ছে নারীর যৌনতা। কিন্তু অন্যান্য বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত হবার পাশাপাশি নারীরা বঞ্চিত হয়ে থাকে যৌন অধিকার থেকেও। পথ প্রদর্শকের ভূমিকায় থাকা গতানুগতিক ধর্ম সমাজে ও রাষ্ট্রে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখানোর পাশাপাশি যৌনতায় নারীকে কেবলমাত্র একটি নিয়ামক হিসেবেই গণ্য করে থাকে। ঋতুচক্রের সাথে সংশ্লিষ্ট নারীদের যে তিনটি আলাদা আলাদা চক্র থাকে (ফলিকুলার, লুটিয়াল ও মধ্যপর্যায়) তা কখনোই গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয় না। যৌনতায় নারী কেবলই ভোগ্য, অসক্রিয় এবং মতামতহীন। এমনকি ঋতুস্রাবের প্রচণ্ড যন্ত্রণার সময়ও পুরুষ তার সঙ্গীর নাজেহাল অবস্থাকে ছাপিয়ে তার যৌনেচ্ছা পূরণের জন্য উপর্যুপরি নির্যাতন ও অত্যাচার করার খবরও চোখ-কান খোলা থাকলে পাওয়া যায়। এই অমানবিক যৌনতা বা যৌনশিক্ষা পুরুষতন্ত্র বেশিরভাগ পুরুষের রক্তে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। সঙ্গীর দু:খ-কষ্ট, মানসিক যাতনা, শারীরিক সীমাবদ্ধতা ছাপিয়ে বড় করে রাখে পুরুষ অহম।
বিশ্বের যেকোন দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রই এখনও নারীরা যৌনতায় পুরুষের পাশাপাশি সমান অংশগ্রহণ করে না। সমাজও নারীকে ছোটবেলা থেকে যৌনতার ভয়ে সন্ত্রস্ত করে রাখে। নারীকে কখনো নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পুলক-যন্ত্রণার কথা মুখে ফুটে বলতে হয় না। যেসব নারীরা আগ বাড়িয়ে স্বামীর সাহচর্য পেতে চায়, তাদের পুরুষরাও তৎক্ষণাৎ দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নারী যৌনতার ইঙ্গিত দেওয়া মানেই নারী যৌনাভিজ্ঞ, অভিজ্ঞ মানেই পূর্ববর্তী কোন ঘটনা এর সঙ্গে উপস্থিত ভূমিকা পালন করছে। ধর্ম শিক্ষায়ও বলা হয় পুরুষ যখন চাইবে তখনই নারীকে তার স্বামীর জন্য তৈরি থাকতে হবে। যেহেতু উপমহাদেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় স্বশিক্ষিত না হলে নারীকে মানুষ হিসেবে গণ্য করার সংস্কৃতি নজিরবিহীন এবং ধর্মই এখানে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। তাই যারা নারীর কথা ভাবতে চায়, নারীকেও যৌন সম্পর্কের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে পেতে চায় তারাও কিছুটা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।
প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় উপমহাদেশীয় নারীরা শৈশব থেকেই কোন না কোনভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়, শারীরিকভাবে অপদস্থ বা ধর্ষনের মতো ঘটনাও উল্লেখযোগ্য; নারীরা তাই যৌনতাকে একরকম বাজে অভিজ্ঞতা জ্ঞান করে থাকে। যৌনতা নিয়ে নারীদের খুব একটা ফ্যান্টাসি থাকে না বললেও চলে। যদিও পর্ণোগ্রাফিকে তুলোধুনো করলেও এ ক্ষেত্রে পর্ণোগ্রাফিকে ধন্যবাদ দেওয়া কর্তব্যপ্রায়। পর্ণোগ্রাফির দৃশ্যায়ন ও অংশগ্রহণ তরুণদের মধ্যে এক ধরণের প্রত্যাশা তৈরি করে যা নারীকেও একইরকম সম্পৃক্তকরণ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে। তথাপি এর ভাল দিকের সহাবস্থানে খারাপ দিকও অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নারী শরীর ও নারীর স্থুল অংশগ্রহণ ব্যক্তি জীবনকে বিষিয়ে তুলছে বলা চলে। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মাঝখানে পিষ্ট হচ্ছে সম্পর্ক আর স্বাভাবিক যৌন জীবন।
পুরুষতন্ত্র নারীকে এমনই ভোগ্য বানিয়েছে যে পৃথিবীর বেশকিছু দেশে যৌনতা থেকে নারীকে বঞ্চিত করতে ও তাকে গৌণ রাখতে খৎনার মাধ্যমে ভগাঙ্কুর ছেদন পর্যন্ত করা হয়। পুরুষের কাম ও সন্তান উৎপাদন ছাড়া নারীর যোনি যেন আর কোন কাজেই লাগে না। অনেক সমাজ-বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পুরুষের আধিপত্যের কারণ জৈবিক না হলেও সন্তান উৎপাদনে পুরুষের নির্ধারকের ভূমিকাই মূলত সমাজে পুরুষকে একচ্ছত্র আধিপত্যের সুযোগ করে দিয়েছে। যদিও সন্তান উৎপাদনের পুরো সিস্টেমে নারীর এত বেশি সংশ্লিষ্টতা যে পুরুষকে শারীরিক-মানসিকভাবে প্রত্যক্ষ কোন পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হয় না। কিন্তু নির্ধারকের ভূমিকা ও যৌনতায় শারীরিকভাবে পুরুষের পরিবর্তন অধিক দৃশ্যমান হওয়ায় নারীকে পুরুষের বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছে। নারীকে শাসন ও শোষন করে, তার একগামিতাকে পুনঃ পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য তার অবদমনকে মহান ঘোষণা করে নারীর যৌনতাকেই অস্বীকার করা হয়েছে।
ব্যতিক্রম ছাড়া, অনেক বছর বিবাহিত নারীদের তাই যৌনতায় আগ্রহী হতে দেখা যায় না। সুন্দর অনুভূতির সাথে পরিচিত হতে না পারা বঞ্চিত বিশাল নারীজাতি সারাজীবন যৌনতাকে ভীতিকর অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখে।
সারাবাংলা/এসএস