Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নারীকে মা-বোন নয়, যাত্রী হিসেবে দেখার আহ্বান


২৩ নভেম্বর ২০১৯ ২০:০১

গণপরিবহনে নারী যাত্রীর হয়রানির চিত্র নতুন কিছু নয়। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো স্থানে গণপরিবহনে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।

এমন বাস্তবতায় রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে রাজধানীতে হয়ে গেল ‘গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। গণপরিবহণে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও হয়রানি বন্ধে নারীর প্রতি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর প্রতি জোর দেন বক্তারা। গণপরিবহনের একজন নারী যাত্রীকে মা-বোন হিসেবে না দেখে বরং একজন যাত্রী হিসেবে দেখার অভ্যাস গড়ে তুললে নারীর প্রতি হয়রানিমূলক আচরণ বন্ধ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

শনিবার (২৩ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে এই গোলটেবিলের আয়োজন করা হয়।

গোলটেবিলে বক্তারা একমত হন যে, রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক হওয়ায় এই দেশে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি তেমন সম্মানজনক নয়। তারা বলেন, রাষ্ট্র নারীকে একজন পুরুষের সমান পূর্ণ অধিকার দিতে ব্যর্থ বলেই আজ গণপরিবহণসহ সব ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি হয়রানি বেড়েছে। একজন মানুষ হিসেবে একজন নারীর নিরাপদে ও বৈষম্যহীন পরিবেশে বাইরে বের হওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু তাকে একজন মানুষের সম্মান না দেওয়ার কারণেই বেড়ে চলেছে, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, অযাচিতভাবে গায় হাত দেওয়া, ইভ টিজিং, বাসে উঠতে না দেওয়া, নারীদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসতে না দেওয়াসহ নানা ধরনের হয়রানিমূলক আচরণ।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘প্রতিদিন সারা দেশে প্রতিদিন ৬০ লাখ সিট ট্রিপ হয় যাদের ২০ শতাংশই নারী যাত্রী। এই হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ সিটে বিভিন্ন বয়সী নারীরা শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরিসহ নানা কাজে বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করেন। খোদ ঢাকাতেই নারীদের বাসে উঠতে বাধা দেওয়াসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। টাউন সার্ভিস নামের বাসের সামনের দিকে নারীদের জন্য নয়টি সংরক্ষিত আসন থাকলেও সেখানে ও বাসের অন্যান্য সিটে নারীদের বসতে বাধা দেওয়া হয় অনেকসময়। অনেক পুরুষ যাত্রীই মনে করেন, এই নয়টি আসনের বাইরে অন্য সিটে নারীদের বসার অধিকার নেই।’

বিজ্ঞাপন

নারীকে মানুষ হিসেবে

সাইদুর রহমান জানান, দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার ৫০ শতাংশ মহাসড়কে, ২৫ শতাংশ আঞ্চলিক সড়কে ও ২৫ শতাংশ রাজধানীর অভ্যন্তরীণ সড়কে ঘটে। মাঝারি পাল্লার বাসে ঘটে ২৫ শতাংশ, আন্তঃশহর বাসে ৩০ শতাংশ, স্বল্পদূরত্বের বাসে ২০ শতাংশ এবং দূর পাল্লার সিটিং বাসে ১৫ শতাংশ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও ২১ জন ভিকটিমের ওপর করা কেস স্টাডি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৩ জনকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, পাঁচজনকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণচেষ্টা ও তিনজনকে এককভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৩ শতাংশকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ৫০ শতাংশ নারীকে ধর্ষণের পর চলন্ত বাস থেকে ফেলে গুরুতর আহত করা হয়েছে। অধিকাংশ ঘটনার সঙ্গে পারিবহনের চালক, হেলপার ও সুপারভাইজার জড়িত যাদের বয়স ৪০ বছরের মধ্যে। পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী টহল পুলিশ কম, এমন সব জায়গাতেই নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে।

এক গবেষণার বরাত দিয়ে সাইদুর রহমান বলেন, দেশের শতকরা ৮৩ জন নারী রাস্তায় গণপরিবহনের শ্রমিকদের দ্বারা হয়রানিমূলক মন্তব্যের শিকার হন। শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টা সামনে আসলেও মানসিক নির্যাতনের দিকটা আমলে নেওয়া হয়না। এইসব হয়রানি বন্ধে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় ভুক্তোভোগী নারীরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননা।

এই ধরনের সভা-সেমিনার কোনো আবদ্ধ স্থানে বা মিলনায়তনে না করে খোলা স্থানে শ্রমিকদের উপস্থিতিতে করার ওপর জোর দেন বিপ্লবী সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আলী রেজা। তিনি বলেন, ‘নারী নির্যাতনের ঘটনা শুধু পরিবহণ শ্রমিকদের দ্বারাই ঘটছে তা নয়, সমাজের শিক্ষিত শ্রেণিতেও এটা বিদ্যমান।’

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর প্রতি সমঅধিকারের দৃষ্টিভঙ্গী, নীতি ও আইন করতে না পারা সমাজের সব স্তরে নারীর চলাচল সীমিত করে ফেলেছে। সেটার প্রভাবেই গণপরিবহনে নারীর প্রতি হয়রানি বেড়েছে। এর কারণ সামাজিক, ব্যক্তিগত নয়।’

শুধু নারী যাত্রীরাই নন, হোসনে আরা বলেন, ‘হয়রানির শিকার হতে হয় বিভিন্ন যানবাহনের নারী চালকদেরও। নারী গাড়ি চালাবে এই বিষয়টায় এখনও ট্যাবু বিদ্যমান। তাই দেখা যায় নারী চালককে গাড়ি বা স্কুটি চালাতে দেখলে তার প্রতি অসম্মানজনক মন্তব্য করা হয়, কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়। আজ সমাজে নারীরাই শুধু নয়, শিশুরাও নিরাপদ নয়।  কোথাও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে দেখা যায় কয়েকটি সংগঠন বা সমাজের একটা শ্রেণিই কেবল প্রতিবাদ করছে। রাজনৈতিক, ধর্মীয় কিংবা পরিবহণ শ্রমিকদের কোন সংঠনকে তখন এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। রাস্তাঘাটে ও গণপরিবহনে নারীর প্রতি হয়রানি বন্ধে পরিবহণ শ্রমিকদের মধ্যে সংবেদনশীল মানসিকতা তৈরি করতে হবে।’ এজন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসার ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।

নারীকে মানুষ হিসেবে

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, তিনি প্রায় তিন দশক ধরে ঢাকায় মোটরসাইকেল চালান। তাই শুধু গণপরিবহনেই নয়, রাস্তাঘাটেও নারীর প্রতি হয়রানির নানা চিত্র চোখে পড়ে তার। তিনি বলেন, সবাই ভুল করলে স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হলেও নারীর ভুলকে যেন ক্ষমার অযোগ্য মনে করা হয়। নারী চালক বা যাত্রী একটা ছোট ভুল করলেও অন্যরা তাকে রাস্তায় কেন বেরিয়েছে ধরনের মন্তব্যের মাধ্যমে হয়রানি করে আনন্দ পায়।

তিনি বলেন, `গণপরিবহন আসলে বাণিজ্যিক পরিবহণ। এখানে মানসম্মত, বাস, বাসের সিট, যাত্রী ছাউনি, নির্দিষ্ট ভাড়া, বাসের গেটের অবস্থান ইত্যাদি ঠিক থাকতে হবে। যারা এই পরিবহণ ব্যবহার করছেন তারা টাকার মাধ্যমেই সেবা গ্রহণ করছেন তাই এখানে সঠিক ব্যবস্থাপনা পাওয়া তাদের অধিকার। এই সমস্যা নিরসনে পরিবহণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলা ও সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে।’

রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, বিআরটিসি বাদে অন্যান্য বাসগুলোতে ওঠার দরজা একটা যেটা বাসের সামনের দিকে থাকে। সেই দরজাও এতটাই অপ্রশস্ত যে একজন যাত্রীকে হেলপারের গা ঘেঁষে উঠতে হয়। অনেকসময় হেলপাররা নারীদের গায়ে ও পিঠে হাত দেন। কেউ সাহায্য করতে দেন, কেউ ইচ্ছা করে। এই ধরনের হয়রানি প্রতিদিনই ঘটে চলছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআরটিসি) পরিকল্পনা বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, বিআরটিসির বাসে সামনে ও পেছনে গেট থাকে। পেছনের গেট দিয়ে ওঠা এবং সামনের গেট দিয়ে নামার ব্যবস্থা। এছাড়াও নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ১৫ টি সিট বরাদ্দ আছে। এছাড়াও তারা নিরাপত্তার জন্য বাসগুলোতে সিসিক্যামেরা লাগানো হয়েছে।

তবে এসব সিসি ক্যামেরায় পাওয়া ফুটেজ দেখে পরে কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় কিনা তা জানাতে পারেননি তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জোবেদা খাতুন বলেন, যেসব চালকদের হাতে চল্লিশ বা পঞ্চাশ জন যাত্রী দায়িত্ব তার শুধু ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকলেই হবে না, তিনি মানসিকভাবে কতটা উপযোগী সেটিও দেখা দরকার। তিনি বলেন, আমাদের সমাজের সব ক্ষেত্রেই মানুষের মধ্যে সহানুভবতা ও সহনশীলতা কমে যাচ্ছে, মানুষ অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। ফলে কমছে সংবেদনশীলতা। সেই অসংবেদনশীল আচরণের শিকার হচ্ছেন প্রতিদিন গণপরিবহনে যাতায়াত করা হাজার হাজার নারী। অনেক মেয়েই বাসে ও রাস্তায় নানা মাত্রার যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে রাস্তায় বের হতে বা বাসে উঠতে ভয় পান। এর থেকে রক্ষা পেতে আইনগত সহয়তার পাশাপাশি নারীদেরও প্রতিবাদ করতে শিখতে হবে, বলেন তিনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সড়ক নিরাপত্তা প্রোগ্রামের প্রধান ডা. কামরান উল বাসেত বলেন, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও মানুষের মানসিকতার উন্নয়ন হয়নি তেমন। সব ক্ষেত্রেই একটা অসহিষ্ণুতা দেখা যাচ্ছে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতেও তাই ইতিবাচকতার পরিবর্তে নেতিবাচকতা বেড়েছে। তিনি বলেন, কয়েক দশক আগে তার সরকারি চাকরিজীবী মা বাসে করেই চাকরিতে যেতেন। কিন্তু এখন তিনি তার মেয়েকে একা বাসে উঠতে দিতে ভরসা করতে পারেন না। পরিবহন শ্রমিকদের মানসিক অবস্থাও পরীক্ষা করার আহ্বান জানান তিনি।

নারীকে মানুষ হিসেবে

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও লিগ্যাল ইকোনমিস্ট মোহাম্মদ শাহজাহান সিদ্দিকী বলেন, শুধু বাংলাদেশেই নয়, নারীর প্রতি সমঅধিকারের চিন্তা থেকে সরে আসার প্রবণতা বহু উন্নত দেশেও দেখা যাচ্ছে। উদাহরন হিসেবে তিনি বলেন, ইংল্যান্ডে ১৮৭৪ সালে নারীদের জন্য ট্রেনে আলাদা বগির ব্যবস্থা ছিল যা ১৯৭৭ সালে বাদ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন নারীর প্রতি যৌন হয়রানি দূর করতে আবারও নারীদের জন্য আলাদা বগি করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, যেকোন সভ্য দেশে নারীর প্রতি হয়রানি হলে নারীর বক্তব্যকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তার প্রতি হওয়া হয়রানি প্রমাণ করতে নারীকে আবারও নতুন করে যৌন নির্যাতন বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তিনি বলেন, গণ পরিবহনে নারীর প্রতি হয়রানির ব্যাপারে আমাদের দেশে কখনোই কোন নীতিমালা ছিল না, এখনও নাই। সেই কারণেই হয়রানি দিন দিন বাড়ছে।

অনুষ্ঠানটি সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি সামগ্রিকভাবে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সব মহলেই সচেতনতা তৈরির ওপর জোর দেন।

 

https://www.youtube.com/watch?v=PqOqjsgxlyg

গণপরিবহন চালক নারী যাত্রী বাসের হেলপার হেলপার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর