নারী ও শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতন প্রতিরোধে প্রতিবাদ সমাবেশ
২৭ নভেম্বর ২০১৯ ২২:৪৯
ঢাকা: আর একজন নারীকেও ধর্ষণের শিকার হতে দেব না, আর একজন পুরুষকেও ধর্ষক হতে দেব না— এই অঙ্গীকারে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিন করা হয় নারীর প্রতি সব ধরনের নির্যাতনবিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশ।
বুধবার (২৭ নভেম্বর) নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস উপলক্ষে ২২টি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনের মিলিত উদ্যোগে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সমাবেশে বক্তারা নারী ও শিশুর ওপর ধর্ষণসহ সবধরনের অত্যাচার বন্ধের আহ্বান জানান। সেখানে আয়োজক সংস্থার প্রতিনিধিরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নানা শ্রেণি ও সংগঠনের কর্মী, সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, যৌন কর্মী, অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার, ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর পরিবারের সদস্যরাসহ অনেকেই।
নানা শ্রেণি-পেশা ও বয়সের ব্যক্তিরা এসময় প্রতিবাদী ব্যানার ও প্লাকার্ড প্রদর্শনের পাশাপাশি নির্যাতনবিরোধী স্লোগান দেন। প্রতিবাদ সমাবেশের পাশাপাশি ছিল প্রতিবাদী গান, আবৃত্তি, বিবৃতি ও ফ্লাশ মবের আয়োজন।
সমাবেশে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন, বিভিন্ন সময়ে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুর পরিবারে সদস্য। তারা বিভিন্ন ব্যানার ও প্লাকার্ড প্রদর্শনের পাশাপাশি প্রতিবাদী স্লোগান দেয়। এসব শ্লোগানের মধ্যে ছিল ‘সইবো নাকো আমরা আর, নারীর দেহে অত্যাচার’, ‘মাঠে ঘাটে বাসে ট্রেনে, নারীর স্থান সবখানে, ‘ধর্ষণকারী তুমি যেই হও, বিচার তোমার হবেই হবে’, ‘লজ্জা ভয় সংশয়, আর না আর না’, সবাই মিলে এগিয়ে চলি, নারী নির্যাতন বন্ধ করি’, পথে ঘাটে দিনে রাতে, চলতে চাই নিরাপদে,’ ধর্ষণের লজ্জা নারীর না, ধর্ষণ, নিপীড়ন, গোপন রাখা আর না আর না’, বিচার তোমার সঠিক হলে, নারী সমাজ স্বস্তি পাবে’-সহ নানারকম স্লোগানে মাতিয়ে রাখেন নানা বয়সী নারী, পুরুষ ও শিশুরা।
আইন ও সালিস কেন্দ্র এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ২৫৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এছাড়া ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ২০০ জন ও যৌন হয়রানির শিকার ২২১ জন নারী। এদের মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৫১ জন, ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৬২টি এবং আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন।
এছাড়া ধর্ষণের প্রতিবাদে খুন হয়েছেন তিন জন নারী ও ২ জন পুরুষ। এই তথ্যানুযাইয়ী ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৬৭ জন শিশু আর ধর্ষণ চেষ্টার শিকার ১৩৫ জন শিশু। যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৮০ জন মেয়ে শিশু এবং ২৬ জন ছেলে শিশু।
আজকের প্রতিবাদ সমাবেশে আয়োজক ও বক্তারা বলেন, ঘরে-বাইরে, রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবখানে নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতন চলছে। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি ছাড়াও অ্যাসিড আক্রমনসহ নানাবিধ সহিংসতার শিকার হচ্ছেন তারা। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও নিরাপদ নয় নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী ও শিশু।
নারী পক্ষের সাবেক সভানেত্রী ও প্রচার সম্পাদক রেহানা সামদানী লিখিত বক্তব্যে বলেন, দেশের প্রতিটি নারী ও শিশু সহিংসতার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। এর মূল কারণ, নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন না করার দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ। আদিকাল থেকেই আমাদের দেশে ও সমাজে নারীকে অধস্থন অবস্থানে দেখে বলেই এমনটা সম্ভব হচ্ছে, বলেন তিনি। এছাড়া মামলার দীর্ঘসূত্রিতা যেমন ন্যাবিচার প্রাপ্তিকে অনিশ্চিত করে তেমনি তড়িঘড়ি নিষ্পত্তি ন্যায়বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
পাঁচ জুলাই ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া শিশু সামিয়া ইসলাম সাইমার বাবা বলেন, একের পর এক ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চলেছে যা দেখে মনে হয় আমরা মানুষ নই, পশুতে পরিণত হয়েছি। তিনি বলেন, একটা ঘটনার পর সেটা নিয়ে কিছুদিন হইচই হলেও কয়েকদিনের মধ্যেই বিচারবিভাগ, মিডিয়াসহ সবখানেই ধামাচাপা পড়ে যায়। মাঝখান দিয়ে আরেকটা ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটে যায়। মিডিয়ার কাছে তিনি অনুরোধ করেন, পূর্ববর্তী ঘটনাগুলো যেন নিয়মিত ফলোআপ করা হয়।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, সবাই মিলে ঐকবদ্ধ হলে কয়েকটি মাত্র ধর্ষককে প্রতিরোধ করা অসম্ভব নয়। তিনি বলেন, আজ (২৭ নভেম্বর) নারী নির্যাতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়েছে। এই উপলক্ষে সারা দেশে মোট ৩১০টি স্থানে প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজিত হয়েছে। শাহীন আনাম আরও বলেন, এই আয়োজনের উদ্দেশ্য মানুষের বিবেক জাগ্রত করা। তিনি এই আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আফসানা মিমি বলেন, শহীদ মিনার এমন একটি জায়গা যেখানে আমরা প্রতিবাদ করতে আসি, সংহতি জানাতে আসি। তিনি বলেন, ভাষা আন্দলন, মুক্তিযুদ্ধের বীত্বপূর্ণ ইতিহাস যে জাতীর গৌরব সেই জাতিকে আজ ধর্ষণের বিরুদ্ধেও একত্র হয়ে প্রতিবাদ জানাতে হবে। পরিবার থেকে শিশুদের নারীকে সম্মান করতে শেখানোর কথা বলেন।
আয়োজনে ছিল আমরাই পারি জোট, ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, অ্যাকশন এইড, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নারীপক্ষ, ব্রতী, কোস্টট্রাস্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, এশিয়াটিক, ব্র্যাক, আইপিডিএস, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্লাস্ট, নবোলোক, কর্মজীবী নারী, সহায়, উবিনীগ, নারী মৈত্রী, সিপিডি, বিলস, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতিসহ আরও কয়েকটি সংগঠন।
https://youtu.be/PjX929kelmw