‘বিচারহীনতায় বাড়ছে যৌন সহিংসতা’
৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ২৩:৩০
বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থায় নারী নির্যাতনের বিচার হতে অনেক সময় লেগে যায়। অনেক সময় বছরের পর বছর আটকে থাকে বিচার ও শাস্তির প্রক্রিয়া। এতে নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
‘নারী পুরুষ সমতা, রুখতে পারে সহিংসতা’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে একটি কর্মসূচি পালিত হয়। ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ-২০১৯’ পালনের অংশ হিসাবে জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মসূচি ইউএনএফপিএ, বাংলাদেশ সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদফতর, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ ও কেয়ার বাংলাদেশ যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে আসকের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, পত্রিকার খবর ও আসকের তদন্তে বিগত ১০ বছরের পরিসংখ্যানে জানা যায়, ১০ হাজারেরও বেশি ধর্ষণ ও ১০ হাজারেরও বেশি অন্যান্য যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। চাঞ্চল্যকর রূপা ধর্ষণ ও হত্যাসহ অধিকাংশ মামলার রায় নিম্ন আদালতে হলেও উচ্চ আদালতে এসে থমকে গেছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, অনেকসময় প্রয়োজনীয় তত্ত্ব, সাক্ষ্য ইত্যাদির অভাবে পিছিয়ে যায় এই প্রক্রিয়া।
এছাড়াও অনেকসময় স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন থেকে সাহায্য পায় না ভুক্তোভোগী নারী। থানায় গেলে মামলা নিতে চায় না অনেকসময়। শীপা হাফিজা বলেন, দেশে প্রচলিত ১৮৬০ সালের আইন অনুযায়ী নির্যাতনের শিকার পুরুষ ও তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তির নির্যাতনের বিচার হচ্ছে না। কারণ এই আইনে ধর্ষণকে ঠিকমত সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এর প্রতিকারের উপায় হিসেবে তিনি পাঁচটি বিষয় তুলে ধরেন—
১. জনণের সম্পৃক্ততায় পুলিশ, স্থানীয় সরকার, আইনজীবী, বিচার বিভাগ, জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা চালু করা;
২. পুলিশের কাছে সেবা পাওয়া কঠিন, সেই প্রক্রিয়া সহজ করা;
৩. আইন সেবা জেলা পর্যন্ত থাকলেও একে আরও উন্নত করা এবং নারী, শিশু, তৃতীয় লিঙ্গ, প্রতিবন্ধীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা;
৪. প্রান্তিক পর্যায়ের নারীর বিচার পাওয়া নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের এগিয়ে আসা; এবং
৫. আদালতের বাইরে কোনো ধরনের আর্থিক আপস বন্ধ করা।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই অ্যাকশন এইডের উপপরিচালক শাহরিয়ার কবির বলেন, অ্যাকশন এইডের গবেষণা অনুযায়ী ২০১৮ সালে অক্টবর পর্যন্ত, ১২০০’র বেশি নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে যাদের মধ্যে ৬০০ এর বেশি শিশু। তিনি বলেন, নারী যেন নিজেকে রক্ষা করতে পারে তাই প্রতিটি নারীর আত্মরক্ষার কৌশল শেখা জরুরি। এই ব্যপারে তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সারা দেশে নারীদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখাতে কাজ করছে, বলেন তিনি।
এসময় ময়মনসিংহের ফুলবাড়ির বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা আত্মরক্ষার বিভিন্ন কৌশল প্রদর্শন করে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে খাদিজা আক্তার সাথী বলেন, আত্মরক্ষার কৌশল শিখে তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে অনেকটাই। তারা এখন যেকোন পরিস্থিতিতে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন।
https://youtu.be/gH-uCHZvAUA
এরপর মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের উপপরিচালক সুলতানা রাজিয়া বলেন, আমাদের সবার উদ্দেশ্য এক। সবাই মিলে কাজ করে আমরা নারী নারী নির্যাতনকে প্রতিরোধ করব। তিনি বলেন, বিজয়ের এই মাসে ফুলবাড়িয়া থেকে আসা শিক্ষার্থীদের প্রদর্শনে নারীরাও যে মানুষ, সেটা জোরালোভাবে উচ্চারিত হল।
এসময় টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে রূপা খাতুনকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার ধারাবাহিকতার মূল ঘটনা অ্যানিমেশনের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন কথাসাহিত্যিক দিপু মাহমুদ ও নুসরাত রাইসা।
বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত হ্যারি ভারয়েইজ বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা দূর করতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এবং এক্ষেত্রে তার দেশ সবসময় সাহায্য করবে। এসময় তিনি নারীর ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশে নারীদের অগ্রায়নে ভূমিকা রাখায় তিনি এদেশের সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
কানাডার রাষ্ট্রদূত বেনয়েট প্রেফন্টেইন বলেন, শুধু বাংলাদেশই নয়, কানাডার মতো উন্নত দেশেও নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে অনেক কাজ করছে। আরও অনেক কাজ করার আছে।
ইউএনএফপিএ’র প্রতিনিধি ড. আসা টরকেলসন বলেন, প্রতিটা মানুষ যদি উপলব্ধি করতে পারে ধর্ষণ কী, তাহলে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হয়ে যাবে।
কেয়ার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর জিয়া চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে এখনো পারিবারিক ও সামাজিক সংস্কৃতি এবং কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতায় অধিকাংশ সহিংসতার ঘটনা আলোচনা করা হয় না। সহিংসতা বন্ধে এটা লুকিয়ে না রেখে আমাদের কথা বলতে হবে।
নারী অধিকার ও নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে সোচ্চার বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান বাংলাদেশে নারীদের বর্তমান অবস্থার চিত্র তুলে ধরে— এমন দু’টি সংগীত পরিবেশন করেন। গান পরিবেশনের পাশাপাশি তিনি বলেন, অভিভাবকদের তাদের ছেলে সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই নারীদের সম্মান করতে ও সমান চোখে দেখতে শেখাতে হবে।
অনুষ্ঠানে তিনটি গান পরিবেশন করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের ব্যান্ড ‘এফ মাইনর’। এরপর বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের নানা চিত্র উঠে আসে ওয়ার্দা রিহ্যাব ও তার দলের নৃত্যভিত্তিক পরিবেশনায়। সবশেষে ছিল ঢাকা থিয়েটারের তিন জন প্রতিবন্ধী নাট্যশিল্পীর পরিবেশনা।