দুনিয়া বদলে দেওয়া সাত নারী বিজ্ঞানী
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১০:৩০
ম্যালেরিয়া থেকে জীবন বাঁচানো প্রাচীন চাইনিজ ওষুধ থেকে শুরু করে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈন্যদের কাজে আসা মোবাইল এক্স-রে ইউনিট, আর মহকাশযানের জন্য অতি আধুনিক ট্রানজেক্টরিজ এমন সব আবিষ্কারের পেছনে আছে মেধাবী নারীর অনন্য মেধার ব্যবহার।
হাজার বছর ধরে নারীরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারে অসাধারণ অবদান রাখছেন। জীবন বাঁচানো ওষুধ থেকে শুরু করে দুনিয়া বদলে দেয়া যন্ত্রপাতি ও সুদূরপ্রসারী গবেষণা কী না করেছেন তারা। অনেক ক্ষেত্রেই নারীর অবদানকে অবহেলা করা হয়।
দীর্ঘদিন ধরেই স্টেম (STEM) অর্থাৎ সাইন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যাথম্যাটিকসে অবদান বিবেচনার ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য করা হত। অতীতেও যেমন বর্তমানেও তেমনি নারীদের অবদান তেমন গুরুত্ব পায় না। এর কারণ হিসেবে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও নেতৃত্বে নারীদের অংশগ্রহণ অনেকটাই কম। আবার এসব ক্ষেত্রে নারীদের কেরিয়ার গড়তে এমনভাবে নিরুৎসাহিত করা হয় যে তারা দূরে থাকে।
নানারকম বাধা স্বত্বেও সৃষ্টিশীল ও উদ্যমী মেয়েরা সবসময়ই নিজদের সীমাবদ্ধতাকে উতরে গিয়েছেন এবং নিত্য নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পেছনে মেধা ও শ্রম দিয়েছেন। তাদের কাজের মাধ্যমে তারা প্রতিনিয়ত চেনা পৃথিবী বদলাতে ভূমিকা রেখেছেন। অচেনা সব গল্পকে সামনে এনেছেন অথবা নতুন করে বলেছেন।
আজ রইল সাতজন নারী বিজ্ঞানী এবং তাদের যুগান্তকারী আবিষ্কার নিয়ে কিছু কথা। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম-এ প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে ভাষান্তর করেছেন রাজনীন ফারজানা।
টু ইউইউ
চাইনিজ ওষুধ রসায়নবিদ ইউইউ প্রাচীন চায়নার ম্যালেরিয়ার ওষুধ নিয়ে গবেষণা করেন। তার আবিষ্কৃত আর্টেমিসিনিন ম্যালারিয়ায় আক্রান্ত রোগীর রক্ত থেকে প্ল্যাজমোডিয়াম জীবাণুর পরিমাণ কমায় যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়।
ফার্মাকোলজির ছাত্র হিসেবে তার গবেষণার বিষয় ছিল বিভিন্ন ওষধি বৃক্ষের রাসায়নিক উপাদান ও গঠন। কেরিয়ারের শুরুতে তিনি ম্যালেরিয়ার প্রকোপ নিয়ে পড়াশোনা করেন। সেই সময় থেকেই তিনি প্রাচীন আমলের চিকিৎসা বিষয়ক বইপত্র ঘাটাঘাটি শুরু করেন ও চীনের বিভিন্ন রেইনফরেস্টে ওষধি বৃক্ষের খোঁজ করেন।
বেশ কয়েকবছরের গবেষণার পর ইউইউ ও তার গবেষক দল চীনের রেইনফরেস্টে একধরণের সুইট ওয়ার্মউডের খোঁজ পান। এই গাছ আজ থেকে ৪০০ বছর আগে প্রাচীন চীনে ম্যালেরিয়ার অন্যতম লক্ষণ একটানা জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হত। তারা এই গাছ থেকে আর্টেমিসিনিন নামক সক্রিয় উপাদান পরীক্ষা করে তার ফলাফল প্রকাশ করেন। এখন বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার প্রথম প্রতিষেধক হিসেবে আর্টেমিসিনিন কম্বিনেশন দিয়ে চিকিৎসা করতে পরামর্শ দেন। ইউইউ বলেন, সব বিজ্ঞানীই এমন কিছু আবিষ্কার করতে চান, যার দ্বারা বিশ্ববাসী উপকৃত হবে। ২০১৫ সালে ইউইউ এবং তার দুই সহকর্মী প্রথম চাইনিজ হিসেবে ফিজিওলজি এবং মেডিসিনে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন। এমনকি তিনি চায়নার প্রথম নারী নোবেল লরিয়েট।
কিয়ারা নির্ঘিন
‘ছেলেবেলা থেকেই আমি এই বিশ্ব কীভাবে চলে সেটি জানতে বেশি আগ্রহী’, বলছিলেন ২০১৬ সালে গুগল সাইন্স ফেয়ারে পুরষ্কার বিজয়ী ১৯ বছর বয়সী কিয়ারা নির্ঘিন। সেই মেলায় কিয়ারা অধিক শোষণক্ষমতা সম্পন্ন পলিমার আবিষ্কার করেন যা তার আকারের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি তরল শোষণ করতে পারে। ক্ষরার সময় ফসলের জন্য পানি ধরে রাখতে কাজে লাগবে এই পলিমার। কমলা ও অ্যাভোকাডোর খোসা দিয়ে বানানো এই পলিমারের খরচও কম আর বায়োডিগ্রেডেবল অর্থাৎ যা মাটিতে মিশে যাবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার মেয়ে নির্ঘিন ২০১৫ সালে তার দেশে ক্ষরার নিদারুণ অভিজ্ঞতা লাভ করেন। চোখের সামনে পানিভর্তি কূপকে শুকিয়ে যেতে দেখেন। সেই অভিজ্ঞতাই তাকে এই পণ্যটি বানানোর অনুপ্রেরণা জোগায়। ‘আমি সবসময় জানতাম আমাকে এই ক্ষরা থেকে বাঁচার জন্য কিছু একটা করতে হবে’, ২০১৯ সালে নারী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের একটি অনুষ্ঠানে নির্ঘিন বলেন।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত কিয়ারা নির্ঘিন এই বিষয়ে আরও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ক্যাথেরিন জনসন
গণিতবিদ হিসেবে নাসায় কাজ করছেন ক্যাথরিন। পৃথিবীর কক্ষপথে এবং মহাশূন্যে যাওয়া প্রথম নভোযানের জন্য তিনি ট্র্যাজেকটরিজ, লঞ্চ উইন্ডোজ এবং এমার্জেন্সি রিটার্ন পাথ ইত্যাদি হিসাব করেন। অসম্ভবকে সম্ভব করার এই জার্নি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার ছিল অসীম কৌতুহল। কী ঘটছে, কেন ঘটছে তার সব জানতে চাইতাম আমি।’
প্রথম আফ্রিক্যান-আমেরিকান নারী হিসেবে তিনি গ্রাজুয়েট স্কুলে যান এবং নাসার স্পেস প্রোগ্রামে যোগ দেন।
লিঙ্গ, জাতিগত বৈশিষ্ট্য ও গায়ের রঙের জন্য বৈষম্যের শিকার হলেও তার আত্মবিশ্বাস কমেনি কখনোই। নাসার সেই গবেষক দলে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী সদস্য।
১০১ বছর বয়সী জনসন বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও গণিতে নারীদের জন্য অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি মনে করেন যেকোন কাজের ক্ষেত্রেই নারী ও পুরুষ একইরকম দক্ষ। তিনি সবসময় মেয়েদের স্বপ্ন পূরণের জন্য উৎসাহ দেন। মেয়েদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘নিজের স্বপ্ন খুঁজে বের কর এবং সেটি পূরণে কাজ কর। কারণ পছন্দের কাজ করলে, সেটিতে ভালো করতে পারবে।’
ম্যারি কুরি
একাধারে পদার্থবিদ এবং রসায়নবিদ ছিলেন দুইবার নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি। রেডিওএক্টিভিটি নিয়ে তার গবেষণাই আধুনিক পারমানবিক বিজ্ঞানের নানা গবেষণার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত এক্স-রে থেকে শুরু করে রেডিওথেরাপি আবিষ্কার তারই অবদান। প্রথম নারী হিসেবে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন তিনি। এবং প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বিজ্ঞানের দুটি আলাদা বিষয়ে নোবেল পান।
নিজ দেশ পোল্যন্ডে বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ করে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তার স্বামী আরেক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পিয়েরে কুরির সঙ্গে মিলে পোলনিয়াম ও রেডিয়াম নামের দুটো রেডিওএক্টিভ মৌল আবিষ্কার করেন। পোল্যান্ডের ওয়ারশতে একটি মেডিক্যাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন এবং বহনযোগ্য এক্স-রে যন্ত্র আবিষ্কার করেন যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এক মিলিয়নেরও বেশি আহত সৈন্যর জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়।
রেডিএক্টিভিটি নিয়ে গবেষণা করতে করতে বিকিরণজনিত রোগে ভুগে মারা যান মহৎ এই বিজ্ঞানী। শুধু নারীদের জন্যই নয়, যুগে যুগে সব বয়সী মানুষের জন্য অন্যতম আদর্শ একজন ম্যারি কুরি। তিনি বলেন, ‘জীবনে ভয় পাওয়ার মত কিছু নাই। এখন সময় আরও বেশি বুঝতে পারার যাতে আমাদের ভীতি দূর হয়।’
মার্সিয়া বারবোসা
ব্রাজিলিয়ান প্রকৃতিবিদ মার্সিয়া বারবোসা পানির অনুর জটিল কাঠামো নিয়ে গবেষণার জন্য বিখ্যাত। বারবোসার মতে পানি আসলে ভীষণ অদ্ভুত। তিনি মনে করেন, পানির অনুর ব্যতিক্রমি গঠন নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে বিশুদ্ধ পানির সংকট দূর করতে সাহায্য করতে পারবেন।
বারবোসা পানির বৈশিষ্ট্যগুলোর একাধিক মডেল তৈরি করেছেন যা বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের বোঝার পরিধি বাড়াতে পারে। যেমন, কীভাবে ভূমিকম্প হয়, কীভাবে প্রোটিন সংগঠিত হয়, ক্লিন এনার্জি বা পরিষ্কার শক্তি উৎপাদিত হয় এবং বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা হয় ইত্যাদি বুঝতে সাহায্য করেছে। ২০১৩ সালে তাকে বিজ্ঞানে অবদানের জন্য তাকে ল’রিয়েল-ইউনেস্কো পুরষ্কার দেয়া হয়।
গবেষণার পাশাপাশি মেয়েদের জন্য স্টেমে (stem) কাজের সুযোগ তৈরিতে তার অবদান অনস্বিকার্য। তিনি নারী পদার্থিবিদদের জন্য একাধিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। ভূতত্ত্ববিদ্যা এবং বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে একাধিক গবেষনাপত্র লিখেছেন।
সেগেনেট কেলেমু
আনবিক উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববিদ সেগেনেটের গবেষণার বিষয় অল্প জমির মালিকরা কীভাবে আরও ফসল উৎপাদন করতে পারবে তাই নিয়ে গবেষণা করছেন। সেগেনেট বলেন, ‘আমার জীবনের চালিকা শক্তি মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনা এবং আফ্রিকার কৃষির উন্নয়ন ঘটানো।’
কেলেমুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইথিওপিয়ার একটি দরিদ্র পরিবারে। সেখানে এতটাই অভাব যে মানুষ খাবার কিনবে না কলম কিনবে তাই বুঝে উঠতে পারে না। এলাকার প্রথম মেয়ে হিসেবে কলেজ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তার ভাষ্যমতে, ‘আমার গ্রামে মেয়েদের খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায় কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমি এতটাই প্রতিবাদী ছিলাম যে কেউ আমার জন্য বিয়ে ঠিক করার সাহস পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলাম আমি।’
দীর্ঘ পঁচিশ বছর বিদেশে পড়াশোনা এবং কাজের পর নতুন প্রজন্মের এক দল গবেষকের নেতৃত্ব দিতে আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার নাইরোবিতে আসেন তিনি। কৃষিতে অভাবনীয় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৬ সালে চাইনিজ সরকারের কাছ থেকে পুরষ্কার পান। এবং তারপরই আফ্রিকা ফিরে আসার ব্যপারে মনঃস্থির করেন তিনি। তার মতে, আফ্রিকান কৃষিতে অবদান রাখার মানে সমগ্র মানবজাতির জন্য কাজ করা। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখায় অনেক বেড়ে যাবে। তখন খাবারের চাহিদা বাড়বে বর্তমানের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ। তাই তিনি কৃষি বিষয়ক গবেষণায় যুক্ত করেছেন নিজেকে।
২০১৪ সালে বিজ্ঞানের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ল’রিয়েল-ইউনেস্কো পুরষ্কার অর্জন করেন। ২০১৫ সালে ফোর্বস আফ্রিকার ১০০ জন প্রভাবশালী আফ্রিকান নারীর তালিকায় স্থান অর্জন করেন তিনি। একইবছর বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমির একজন সম্মানিত ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হন।
সেগেমেট বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম নারী হিসেবে অবদান রাখেন। নিজ বিষয়ে একজন নায়ক হিসেবে বিবেচিত সেগেমেট আমাদের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও কারণের জন্য কাজ করতে অনুপ্রেরণা জাগান।
মারিয়াম মির্জাখানি
ইরানের তেহরানে বেড়ে ওঠা মারিয়ামের স্বপ্ন ছিল লেখক হওয়ার। হাই স্কুলে উঠে তিনি গণিতের প্রতি ভালোবাসা আবিষ্কার করেন ও এই ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতা ও মেধা দেখানোর সুযোগ পান।
১৯৯৪ সালে প্রথম ইরানি নারী হিসেবে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ৪২ এর মধ্যে ৪১ পয়েন্ট পেয়ে সোনার পদক অর্জন করেন মারিয়াম। ২০১৫ সালে একই প্রতিযোগিতায় শতভাগ স্কোর করতে সক্ষম হন তিনি।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জটিল পৃষ্ঠের গতিবিদ্যা ও জ্যামিতির উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং এই বিষয়ে একজন শির্ষস্থানীয় পণ্ডিত। ২০১৪ সালে প্রথম নারী হিসেবে গণিতে সবচেয়ে নামী পুরিষ্কার ফিল্ডস মেডাল অর্জন করেন। নিজ গবেষণা সম্পর্কে মারিয়াম বলেন, ‘গণিতে যত সময় দেই, তত বেশি উত্তেজনা অনুভব করি আমি। নতুন কিছু আবিষ্কারের ও বোঝার যে উত্তেজনা এবং আনন্দ তার সঙ্গে পর্বতচূড়ায় দাঁড়িয়ে সবকিছু পরিষ্কারভাবে দেখতে পাওয়ার আনন্দের তুলনা করা যায়।’
২০১৭ সালে মৃত্যুবরণ করা মারিয়ামের অবদান মেয়েদের জন্য গণিতের মত বিষয়ে আরও মনোনিবেশ করতে উৎসাহ দেয়।
কিয়ারা নির্ঘিন ক্যাথেরিন জনসন টু ইউইউ নারী বিজ্ঞানী নাসা মারিয়াম মির্জাখানি মার্সিয়া বারবোসা ম্যারি কুরি সেগেনেট কেলেমু