নারী দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বর্তমান বাস্তবতা
৭ মার্চ ২০২০ ১৩:৪৭
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দিন। বর্তমানে নানা আড়ম্বরের মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হলেও দিবসটির পেছনের ইতিহাস প্রায় ভুলতে বসেছি আমরা। আজকের লেখায় নারী দিবস কী, কেন পালন করা হয় এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করা হবে। সেই সঙ্গে উঠে আসবে বর্তমান বাংলাদেশে নারীদের অবস্থান।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস রচনা করেছেন নারী শ্রমিকরা। প্রায় দুইশত বছর আগে শিল্প বিপ্লবের পর নারীরা শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দিতে শুরু করেন। শ্রমিক হিসেবে নারীরা ছিল ভীষণ অমানবিক আচরণের শিকার। স্বল্পমজুরি দিয়ে তাদের সস্তা শ্রম কেনা হত। এমনকি নির্ধারিত ছিল না তাদের শ্রম ঘণ্টাও। এমন কাজ তাদের দেয়া হতো যা ছিল সময়সাপেক্ষ। অথচ মজুরি ছিল পুরুষদের তুলনায় অর্ধেক। কিন্ত জীবনধারনের জন্য শ্রম বিক্রি ছাড়া নারীদের আর কোন উপায়ও ছিল না।
সেই সময়ের পরিস্থিতি অনেকটা আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে মিলে যায়। গার্মেন্টসে এখন ৩৫ শতাংশ পুরুষ, বাকি সবাই নারী শ্রমিক। আজকের মতো সেদিনও শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি, ছুটি ও কর্মঘণ্টার দাবি তুলেছিল। ১৮২০ সালের দিকে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে বিভিন্ন কারখানায় অমানবিক কাজের পরিবেশ, বেতন বৈষম্য এবং নানা নির্যাতনের প্রতিবাদে নারী শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ে সামিল হয়ে ধর্মঘট আহবান করেন। একই সময়ে আমেরিকায় বর্ণবাদের প্রতিবাদেও শ্রমিকরা প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় বস্ত্র কারখানার প্রায় ৫০০০ নারী-পুরুষ আন্দোলনে অংশ নেয়। দানা বাঁধতে থাকে আন্দোলন।
১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সেলাই কারখানায় নারী শ্রমিকরা উপযুক্ত বেতন, উন্নত কর্মপরিবেশ ও ১০ ঘণ্টা কর্মদিবসের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে। এ আন্দোলন দমনে পুলিশ সেদিন হাজার হাজার নারী শ্রমিকদের মিছিলে গুলি চালায়। ধারণা করা হয়, নারী আন্দোলনের ইতিহাসে এটি ছিল প্রথম গুলি চালানোর ঘটনা। গ্রেফতার হন অসংখ্য নারী শ্রমিক। ফলে আন্দোলন আরও জোরদার হয়। এর তিন বছর পর ১৮৬০ সালে সুঁই কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের নিজস্ব ইউনিয়ন গঠন করেন। একদিকে নারী আন্দোলন যেমন সংগঠিত রূপ নিতে থাকে, অন্যদিকে শ্রমিক আন্দোলনও দানা বাঁধতে থাকে। সে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আসে ১৮৮৬ সালের ১ মে। জন্ম নেয় বিশ্ব শ্রমিক দিবসের ইতিহাস।
অন্যদিকে ১৮৮৮-৮৯ সালে ইংল্যান্ডে ম্যাচ ফ্যাক্টরির নারী শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করে। ম্যাচ ফ্যাক্টরির নারী শ্রমিকদের সাথে যোগ দেয় সিগারেট, বিস্কুট, কম্বল, পাট, জ্যাম ও আচার ফ্যাক্টরির শ্রমিকরাও। অর্থাৎ পুরো উনিশ শতক জুড়ে চলতে থাকে নারীশ্রমিকদের আন্দোলন।
এসময়কালেই ১৮৮৯ সালে মহামতি ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের উদ্যোগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলন। এ সম্মেলনে জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন নারী-পুরুষের সমানাধিকারের প্রশ্ন উত্থাপন করে বক্তৃতা দেন। তাঁর এ বক্তব্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারীদের মধ্যে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর ১৯০৭ সালে স্টুটগার্ডে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ১৫টি দেশের ৫৯ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একই সালে ‘আন্তর্জাতিক নারী সংস্থা’(International women’s Bureau) প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তার সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনেই নারীদের ভোটাধিকারের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে।
এরপর ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্কে শ্রমঘণ্টা কমানো, মজুরি বৃদ্ধি ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ভোটাধিকারের দাবিতে প্রায় ১৫,০০০ নারী ও অভিবাসী শ্রমিকদের অংশগ্রহণে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তাদের স্লোগান ছিল ‘Bread and Roses’. ‘Bread’ ছিল তাদের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার প্রতীক এবং ‘Roses’ হলো তাদের জীবনমান উন্নয়নের প্রতীক।
এই সমাবেশ বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক নারী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ঐ দিবস স্মরণে ‘সোসালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা’ ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি আমেরিকাব্যাপী ‘জাতীয় নারী দিবস’ পালনের ঘোষণা দিয়েছিল। একই বছরের নভেম্বর মাসে ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট কারখানায় শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করেন। ধর্মঘটরত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই ছিলো নারী। তাদের এ ধর্মঘট ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলতে থাকে। সেবছরের ‘মে দিবসে’ ৬০ হাজার শ্রমিক প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। সবদিক থেকেই এ আন্দোলনের প্রভাব ছিল প্রচুর। একদিকে শ্রমিক আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল, অন্যদিকে নারী-পুরুষের ভোটাধিকারের দাবিও জোরালো হয়ে উঠেছিল।
এই উত্তাল পরিস্থিতিতে ১৯১০ সালের আগস্ট মাসে কোপেনহেগেনে সমাজতন্ত্রীদের ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সমাজতন্ত্রী নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালনের প্রস্তাব দেন।
ওই বছরই কোপেনহেগেনে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদের দ্বিতীয় সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে নিউইয়র্কের নারী শ্রমিকদের আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়ে ক্লারা জেটকিন প্রতিবছর ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। মহামতি লেনিনের সমর্থনে অপরাপর সদস্যবৃন্দ সেই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। সম্মেলনে ঠিক হয় মার্চ মাসের যেকোন দিন এই দিবসটি পালন করা হবে। পরের বছর অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানিতে প্রথমবারের মতো নারী দিবস পালিত হয়। ১৯১৩ ও ‘১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিবাদ হিসেবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়।
উল্লেখ্য, ১৯১০ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত মার্চের যেকোন দিন বিভিন্ন দেশে নারী দিবস পালন করা হত। কিন্তু, ১৯১৪ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে ৮ মার্চ নারী দিবস পালিত হতে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালকে জাতিসংঘ ‘নারী বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। তখন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে ৮ মার্চ কে ‘আন্তজার্তিক নারী দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
কেমন আছেন এদেশের নারী
এ বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ১১০ তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। মানুষ হিসেবে একজন নারী সামাজিক কর্মকান্ডের বিভিন্ন ধারায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সর্বত্র নারী সমাজ তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা ও পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা এর জন্য দায়ী। ফলাফলে নারীর উপর পাশবিক সহিংসতা বেড়েছে চরমভাবে। এই বছরেরই জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় ২১১ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের মতো নির্মম নিপীড়নের শিকার হয়েছে (তথ্যসূত্র: ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার)। ঘরে-বাইরে কোথাও নারী-শিশু নিরাপদ নয়।
একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করেও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। দেশের বিদ্যমান আইনেও নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য চরম মাত্রায় বিরাজমান। সেজন্য নারীসমাজের পক্ষ থেকে সিডও সনদের পূর্ণ স্বীকৃতি ও বাস্তবায়নের দাবি উত্থাপন করা হলেও তা উপেক্ষিত হয়েছে বার বার। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণীত হলেও সেখানে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকার নীতি হিসেবে ঘোষিত হয়নি। অথচ সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে – কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ-নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।
ফলে শুধু নারী দিবসেই নারীর অধিকার আদায়ারে দাবি উত্থাপন করলে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। এর জন্য ধারাবাহিক নারী আন্দোলন প্রয়োজন। ৮ মার্চ তথা আন্তর্জাতিক নারী দিবস আমাদের সেকথাই মনে করায়। কিন্তু ভাবতে কষ্ট হয় যখন দেখি, নারী দিবসের উজ্জ্বল মহিমাকে ম্লান করে দিয়ে বিভিন্ন বাণিজ্যিক কোম্পানি নারী দিবসকে ‘পণ্যের বিজ্ঞাপনের দিন’ হিসেবে ব্যবহার করে কিংবা পণ্যের মোড়কে শরীর প্রদর্শনীর মধ্যেই কেবল নারীর সকল বুদ্ধিবৃত্তিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়কে লুকিয়ে ফেলা হয়।
এই সমস্ত অপচেষ্টার বিরুদ্ধে কথা বলা, ঘরে-বাইরে নারীর স্বাধীনতা, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেই কেবল ৮ মার্চের প্রকৃত তাৎপর্য আমরা অনুধাবন করতে পারবো। আসছে নারী দিবসে সেই চেতনা যেন জোরালো ভূমিকা পালন করে সেই স্বপ্নই বাংলাদেশের নারী সমাজ দেখবে বলে আশা করছি।
তথ্যসূত্র:
১. ক্লারা জেটকিন – শ্যামলী গুপ্ত
২. আটই মার্চ – আন্তর্জাতিক নারী দিবস – নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা
৩. ইন্টারনেট
৪. দৈনিক পত্রিকা