করোনা এবং নারীর জীবিকা
৯ এপ্রিল ২০২০ ১৬:১৫
বাংলাদেশের নারীদের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রভাব ও উপস্থিতি দেখা দিতে শুরু করেছে। এটা অনস্বীকার্য যে করোনাভাইরাস নারী ও পুরুষ সবার জীবিকাকেই বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করছে। কিন্তু নারীর ওপর এর প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়। অবশ্য এমন দাবিও করা যাবে না যে করোনার দুর্বিষহ প্রভাব সব শ্রেণির নারীর ওপর একইভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ ধর্ম-বর্ণ, গোত্র-শ্রেণিভেদে নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের যেমন পার্থক্য আছে, সেই বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতেই তাদের ওপর করোনার ঘাত-প্রতিঘাতের মাত্রাও ভিন্ন— এই বাস্তবতাও অনুধাবন করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী ভূমিহীন। অন্যান্য দেশের নারীদের মতো বাংলাদেশের নারীরা সম্পত্তি কেনাবেচার সম্পূর্ণ অধিকার পায় না। সাংবিধানে স্বীকৃতি থাকলেও পুরুষরা দেশের ৯৬ শতাংশ জমির মালিক, যেখানে নারীদের মালিকানায় রয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ জমি। প্রথাগতভাবে মুসলিম ও অভিজাত হিন্দু নারীদের ভূমিতে মালিকানা থাকলেও তারা নিজেরা কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় সাধারণত মাঠের কাজে নিয়োজিত থাকে না।
তবে এসব পরিসংখ্যান দরিদ্র নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। দরিদ্র নারীরা সম্পত্তি অর্জন করতে পারে না। তবে চাষাবাদ থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কর্মরত তারাই। আইএলও বা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট চাকরিজীবীর সংখ্যা ছয় কোটি ৩৭ লাখ । এর মধ্যে চার কোটি ৫৭ লাখ পুরুষ, বাকি এক কোটি ৮১ লাখ নারী। চাকরিজীবী নারীর সংখ্যা ২০০৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ৩৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৮১ লাখে। একই সময়ে চাকরিজীবী পুরুষের সংখ্যা ১১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে চার কোটি ৫৭ লাখ।
ক্রমবর্ধমান শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণের পেছনে কাজ করেছে মূলত সরকার প্রণীত নারীবান্ধব নীতি। আর এজন্যে কৃতিত্বের দাবিদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক চেষ্টায় মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসে উন্নীত করা, গার্মেন্টস নারী শ্রমিকদের ডে-কেয়ার, বাসস্থান, বাচ্চাদের স্কুল সুবিধাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ।
২০০৫-০৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশের ১ কোটি ২০ লাখ শ্রমিকের ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী। এই গ্রামীণ নারীর প্রায় ৭৫ শতাংশ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত। এই হতদরিদ্র অপুষ্টিতে ভোগা ক্লিষ্ট সন্তানসহ নারীদের আমরা গত ৪ এপ্রিল পায়ে হেঁটে, ভ্যানে চড়ে, ট্রাকের শিকলের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে মালিকদের ‘কারখানা খোলা এবং বেতন প্রদান করা হবে’— এমন নির্দেশেই ঢাকায় ফিরতে দেখেছি। গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি অবশ্য বলেছেন, রাস্তার সব শ্রমিক গার্মেন্টস শ্রমিক নয়। ফলে মালিকদের দায়ী করা অনুচিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো— পোশাক কারখানার শ্রমিকদের জন্য কারখানা খোলা বা বন্ধ রাখা নিয়ে সঠিক বার্তাটিও পৌঁছে দেওয়া হয়নি। ছুটির মধ্যেও শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে ঢাকা আসা এবং এর পরদিন এসে কারখানা ১১ এপ্রিল পর্যন্ত রাখার সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে, বিষয়টি নিয়ে তারা পূর্ণ মাত্রায় সচেতন ছিলেন না।
করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার (মন্দার আশঙ্কাও রয়েছে) পরিণতি নারীর ওপর হবে ভয়াবহ। বৈশ্বিক চিত্রে উঠে এসেছে, লকডাউন অবস্থায় নারী নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছে। অনেক বাড়িওয়ালা ৪ তারিখ ঢাকায় ফেরত আসা নারী শ্রমিকদের ঘরে ঢুকতে দেয়নি। তাদের অনেককেই খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিক্ষিপ্তভাবে মজুরি আদায়ের লড়াইয়ে তাদের মালিকপক্ষের লোকদের হাতে নিগৃহীত হতে হয়েছে।
এই দোদুল্যমান অবস্থার মধ্যে বিজিএমইএ সভাপতি তৈরি পোশাক কারখানাগুলো ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ রাখতে মালিকদের আহ্বান জানান। কিন্তু এখানেও লক্ষণীয়, ২৬ মার্চ থেকে বেশিরভাগ কারখানা বন্ধ থাকলেও ক্রয়াদেশ থাকা কারখানাগুলো চালু ছিল। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের আদেশে বলা হয়েছিল, যেসব রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক ক্রয়াদেশ আছে এবং যারা পিপিই বানাচ্ছে, সেসব মালিকরা শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সাপেক্ষে কারখানা চালু রাখতে পারেন।
মালিকপক্ষের কারখানা চালু ও বন্ধের এই দুই সিদ্ধান্তের কারণে হাজার হাজার শ্রমিকের ঘর থেকে বেরিয়ে দল বেঁধে রাস্তায় চলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের সমন্বিত উদ্যোগের সঙ্গে বিজিএমইএ’র এসব কাজ সাংঘর্ষিক বলেই মনে হয়েছে। একবার ৪ এপ্রিল তাদের আসতে বলা, থাকতে বলা, আদৌ তাদের যেতে বলা হবে কি না— এই পুরো বিষয়টি সমন্বয়হীনতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। এই যে হাজার হাজার শ্রমিক এলেন, তাদের মধ্যে কেউ যদি সংক্রমিত হয়ে থাকেন, সেটা কেবল তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। আর এই শ্রমিকরাও কেবল বসে থাকতে পারবেন না। নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে তাদের বাইরে যেতে হবে, যেতে হবে কারখানায়।
প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও শ্রমিকদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির জন্য তিনি সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেছেন। এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বিজিএমইএ’র সভাপতি, সংসদ সদস্যসহ সুনির্দিষ্ট কয়েকজন ও বাণিজ্যমন্ত্রীকে সরাসরি দায়ী করেছেন। পরিতাপের বিষয়, শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার অক্ষমতাকে পুঁজি করে গার্মেন্টস মালিকরা ২ শতাংশ প্রসেস ফি দিয়ে সরকার ঘোষিত পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার আশ্বাস পেলেন, সেটিও তাদের জন্য যথেষ্ট হলো না!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরি গায়েনের মতে, শ্রমিকদের দিয়ে শোডাউন করে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আরও বড় প্রণোদনার হিসাব কষেছেন তারা, যেখানে কোনো শর্ত থাকবে না। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রায় চার দশক পার করে দেওয়া গার্মেন্টস শিল্প কোন দুর্যোগে আর কবে তার শ্রমিকদের দুয়েক মাসের বেতন দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করবে? ডিজিটাল বাংলাদেশেও কেন একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতন তোলার জন্য সশরীরে কারখানায় উপস্থিত হতে হবে? কেন প্রত্যেক শ্রমিকের একটি জাতীয় পরিচয়পত্র এবং বিকাশ বা রকেট হিসাব থাকবে না?
যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল যেন কেবল শ্রমিকদের বেতন ও কল্যাণ বাবদ ব্যয় হয়, সে বিষয়ে স্বচ্ছতার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে নারী শ্রমিক যেন পিতৃতান্ত্রিকতার কষাঘাতে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত না হয়।
এখন পোশাক মালিকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে তাদের ক্রয়াদেশ বাতিল হচ্ছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে পোশাক কারখানাই বন্ধ করে দিতে হবে। সেক্ষেত্রেও কিন্তু জীবিকা হারাতে হবে নারীকেই। তবে বিজিএমইএ আবার বলছে, ক্রয়াদেশ বহালও রাখছে বিদেশি ক্রেতারা। তার পরও অনেকেই হয়তো অনেক মালিকই করোনাভাইরাসের প্রভাবে কারখানার ক্ষতির ‘কারণ’ দেখিয়ে ছাটাই করবে, যার বলি হতে হবে নারীদেরই। এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি নিশ্চয় আমরা চাই না।
এই প্যাকেজের বাইরে প্রধানমন্ত্রী করোনাসৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার জন্য ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজও ঘোষণা করেছেন, যা নিঃসন্দেহে আশাব্যাঞ্জক এবং সময়োপযোগী। বিশেষ করে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
তথ্য কমিশনারের দায়িত্বে থাকার সময় (২০০৯-২০১৪) জনগণকে দেখেছি ব্যাপকভাবে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ ব্যবহার করে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের কারচুপি নিয়ে অভিযোগ দিতে। তাই লক্ষ রাখতে হবে, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের সাফল্য নির্ভর করবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর। এই সাফল্যের হাত ধরেই করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত নারীর জীবিকা সম্পর্কিত ন্যায্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
লেখক: ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক তথ্য কমিশনার
অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম করোনা করোনাভাইরাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নারী শ্রমিক বিজিএমইএ বিজিএমইএ সভাপতি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ