পুরুষতন্ত্রের শিকার তিনজন নারীর কথা
১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৩:৪০
কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করে লেখাটি শুরু করছি। ঘটনাগুলো খুব কাছ থেকে দেখা। বলা যায় এসব ঘটনার মধ্যদিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে এবং এখনো যাচ্ছি।
১
প্রায় নিরক্ষর আমার মায়ের বয়স এখন পঁচাত্তর। বিধবা হয়েছেন ত্রিশ বছর আগে। তারও অনেক আগে সেই আর্লি ফিফটিজে, বিয়ের সাত বছরের মাথায় আমাদের দ্বিতীয় মা’কে বরণ(!) করে নিতে বাধ্য হন। নানা-মামা’রা চেয়েছিলেন মা’কে নিয়ে যেতে। বলেছিলেন, ‘তালাক দিয়ে চলে আয়। সতীনের ঘর করতে হবে না’। মা প্রস্তাবে সাড়া দেননি। তাঁর তখন দুটি ছোট ছোট ছেলে সন্তান। প্রথম স্বামীকে তালাক দিয়ে পুনরায় বিয়ে করলে সন্তানদের কী হবে, লোকে কী বলবে, সমাজে মুখ দেখাবেন কী করে! এসব বিবেচনায় তিনি তাঁর বর্তমান ও ভবিষ্যতকে মেনে নেন ও মানিয়ে নেন।
২
আমার স্কুলের বন্ধু উর্মি (সঙ্গত কারণে আসল নাম বাদ দেওয়া হলো)। এইচএসসি পাশ করে উর্মি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, আমি চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে। স্মার্ট-সুন্দরী উর্মি লেখাপড়ায় ছিল দুর্দান্ত ব্রিলিয়ান্ট! মেরিট উইথ বিউটি’র (যদিও বাক্যটি সবাই লেখে ‘বিউটি উইথ মেরিট’। বিউটিকে কেন্দ্রে রাখতে ইচ্ছুক নই বলে উলটে দিলাম) সাক্ষাত দর্শন ছিল ও। ভ্যাকেশনে খুলনা গেলে ওর সাথে দেখা হতো। গল্পে আড্ডায় জানাতো ওর স্বপ্নের কথা। জুডিশিয়ারি পরীক্ষা দিয়ে জজ হওয়ার ইচ্ছের কথা বলতো। বাংলাদেশের প্রথম নারী চিফ জাস্টিস হয়ে দেখিয়ে দেবে বলে আমার মুখের উপর তুড়ি ছুঁড়ে দিতো। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ঠাট্টাচ্ছলে বলতাম, ‘হুম, ঘোড়ার ডিম হবা। দু’দিন পর বিয়ে করে একগণ্ডা বাচ্চার মা হবা। অবসরে রিমোট কন্ট্রোল টিপে হিন্দি সিরিয়াল খুঁজবা’। ও চোখ পাকিয়ে বলতো, ‘ ভালো হবে না রাহাত, এতো কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে এতোদূর পর্যন্ত এসে তরী ডোবানোর কোনও ইচ্ছে নেই। তুমি নিজের চরকায় তেল দাও’। উর্মি এখন তিন সন্তানের গর্বিত জননী! আমার ঠাট্টা অমন সত্যি হয়ে যাওয়ায় মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস লুকাই।
৩
রিয়া (কল্পিত নাম) আমার ভাতিজির নাম। এবার এইচএসসি দেবে। পড়াশুনায় মোটামুটি। আঁকাআঁকির প্রতি দারণ ঝোক। ওর ইচ্ছে এবং আমাদেরও ইচ্ছে চারুকলায় পড়ানোর। যাহোক, কয়েকদিন আগে দুপুরের দিকে দরোজায় ঠক ঠক ঠক …! কী ব্যাপার, এ সময়ে কে এলো? দরোজা খুলে দেখি তিনজন লোক। তাঁরা রিয়া সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে এসেছেন। অপরিচিত বিধায় ঘরে ঢুকালাম না। ওনাদের সাথে বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথাবার্তা সারলাম। ঘটনা হলো, ফেইসবুকে রিয়ার ছবি দেখে একটা ছেলে ওকে পছন্দ করে। পরে ওদের মধ্যে ইনবক্সে আলাপচারিতা হয়। ভাললাগা ভালবাসার ব্যাপারটাও ওই অন্তর্জাল পর্যন্ত। ছেলে ইন্টার পাশ করে সাউথ আফ্রিকা চলে যায়। ওখানে ব্যবসা করে। ছেলের মামা খালুরা এসেছে বৃত্তান্ত জানতে। ওনাদের বিদায় দিয়ে কিছু হিসাব মেলাবার চেষ্টা করলাম। ওনারা আমাদের বাসার ঠিকানা পেলেন কীভাবে? নিশ্চয়ই রিয়াই দিয়েছে। তার মানে মেয়েটি এখনই বিয়ের চিন্তা করছে। এটা বুঝতে পারার পর, একরাশ হতাশা আঁকড়ে ধরলো। কষ্ট হলো খুব।
আমার মা’কে সবাই প্রশংসা করে। তাঁর স্যাক্রিফাইস অত্যন্ত সম্মানের সাথে বিবেচিত হয়। শিশু সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে তিনি একটা জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন। এরকম স্নেহশীলা, পতিব্রতা, সুলক্ষণা, সহিষ্ণু নারী কয়টা আছে এ সমাজে? মা নিজেও তাঁর উপর বর্ষিত ওইসব প্রশংসাসূচক বিশেষণ উপভোগ করেন। কিন্তু আমি জানি, আমি দেখেছি সারাটাজীবন তিনি অসম্মানিত অপদস্ত হয়েছেন। প্রথমে পিতার তত্ত্বাবধানে, বিয়ের পর স্বামীর সংসারে এবং স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেদের উপর নির্ভর করে তিনি বেঁচে আছেন। পুরুষতন্ত্রের ছকে বাঁধা সমীকরণে দীর্ঘ একটা জীবন কাটিয়ে দিলেন তিনি। অথচ জানলেন না, স্বনির্ভর হয়ে বাঁচতে পারার আনন্দটা কী। তাঁর সীমাবদ্ধ গণ্ডির ভেতরে একজন নারীর জীবনের মানে হয়তো এটাই। কিন্তু এটাকে জীবনযাপন বলে না, একে বলে জীবন কাটিয়ে দেওয়া। এই সমাজ ব্যবস্থায় এখনো অধিকাংশ নারী এভাবেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। স্বামীর প্রতারণা, লাম্পট্য এখানে বড় হয়ে উঠছে না। ওটা যে প্রতারণা তা-ই তো জানে না নারীরা, মানে না সমাজ। বিশ্বাস করে না রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা।
ইচ্ছে করলেই একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রীকে আইনসিদ্ধভাবে ঘরে তুলতে পারেন। ধর্মে ম্যাণ্ডেট দেওয়া আছে। ব্যাপারটাকে জায়েজ করার জন্য চমৎকার কথার মন্ত্রণা আছে। বলা হচ্ছে, প্রত্যেক স্ত্রীকে সমানভাবে ভালবাসতে হবে, সমান ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু যে কথাটি আলোচনা করতে গিয়ে আমরা সঙ্কুচিত হয়ে উঠি, যে কথাটি ভুলে থাকতে পছন্দ করি তা হলো, ভালবাসাই যদি থাকবে তবে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ বিবাহ কেনো? ভালবাসা না থাকার ফলাফলই তো একাধিক বিয়ে।
উর্মির সাথে দেখা হয় না অনেক বছর। দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম, ভার্সিটি থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে কি লাভ হলো বন্ধু? রসুইঘরে আইনজীবী সনদ কি কাজে লাগছে প্রিয়? রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পাওয়া উচ্চশিক্ষার এমন নিদারুণ অপচয় দেখতে ভাল লাগে? সন্তানকে ঘুম পাড়াতে সুকুমার রায়ের ছড়া নাকি আইনের জটিল সব ধারা সহায়ক হচ্ছে? স্বামী অফিস থেকে ফেরার পর তীব্র আলিঙ্গনে, চুম্বনে সংবিধানের কোনও অনুচ্ছেদ কি মনে পড়ে?
জানি অনেকেই আমার সাথে দ্বিমত করবেন। বীরযোদ্ধা নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করিয়ে দেবেন, ‘তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেবো।’ উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন, মহাবীর সাহেব শিক্ষিত মা’কে গৃহের চৌহদ্দির মধ্যে কল্পনা করে ওরকম ডায়লগ রচনা করেছিলেন। আমাদের মাথায় আসবে না, শিক্ষিত জাতি তৈরির ভার কেবল শিক্ষিত মায়ের উপর কেনো, শিক্ষিত পিতার দরকার নেই? আসলে ষড়যন্ত্রটা এখানেই। শিক্ষিত পিতার দরকারটা আপনারাও স্বীকার করেন, তবে অর্থমূল্যহীন গৃহকর্মের জন্য নয়, ওই এলাকা নারীর জন্য সংরক্ষিত। তা সে নারী শিক্ষিত হোক, কী শিক্ষাবঞ্চিত – মূর্খ্য। শিক্ষিত পুরুষ তাঁর অধীত বিদ্যা সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও উপার্জনের নিমিত্তে খরচ করবে। এটাইতো জনপ্রিয় কনসেপ্ট। আমার বন্ধুটিও নিশ্চয়ই এখান থেকেই সান্ত্বনা খুঁজে নেয়। নেপোলিনীয় শিক্ষিত জাতি তৈরির ক্ষুদ্রতম একক পরিবারের ভার নিয়ে ও হয়তো মহান কর্তব্য সাধন করার তৃপ্তিতে দিবস-রজনী কাটিয়ে দিচ্ছে। জানি না, কন্যা সন্তানটির কানে কানে ওই একই মন্ত্র ঢুকিয়ে দিচ্ছে কী না! না দিলেও ক্ষতি নেই, পরিবারে উচ্চশিক্ষিত মায়ের ভূমিকা দেখে নিশ্চয়ই মেয়ে সন্তানটিও তাঁর ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাচ্ছে। বিপরীত কোনও দর্শন দ্বারা প্রভাবিত না হলে ওই কন্যা শিশুটিও হয়তো উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে স্বামীর ঘরে ‘শিক্ষিত জাতি’ সৃষ্টির মহান দায়িত্ব স্বাচ্ছন্দে গ্রহণ করবে।
বিদ্যা অর্জনের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকার পরেও একটি মেয়ে যখন শিক্ষা জীবনের মাঝপথে বিয়ে নামক শৃঙ্খলে অসময়ে নিজেকে জড়াতে চায় তখন ব্যাপারটিকে একটু ভিন্নভাবে, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে দেখার দরকার পড়ে। রিয়াকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষটা প্রথমত ওর বাবা-মা তথা পরিবারের, দ্বিতীয়ত এই সমাজ-রাষ্ট্রের। মোটাদাগে বললে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার। ওর ভেতরে কেউ একটা সুন্দর স্বপ্ন গেঁথে দিতে পারেনি। ও হয়তো বিখ্যাত মেক্সিকান নারী চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কাহলোর নামই শোনেনি। নারীর অভিজ্ঞতা ও রূপের আপোষহীন প্রকাশের জন্য নারীবাদীদের কাছে খ্যাত ফ্রিদার কাজের কথা ও হয়তো জানেই না। ও হয়তো জানেই না শৈশবের সড়ক দুর্ঘটনার আঘাত সহ্য করেও ফ্রিদা কীভাবে লড়াই করে জীবন সংগ্রামে বিজয়ী হয়েছিল। ও হয়তো জানেই না ফ্রিদার মতো স্বপ্নের পিছনে কীভাবে ছুটতে হয়। ইচ্ছে থাকলেও ওর হয়তো সেই সাহসই গড়ে ওঠেনি। গড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি। টিনএজ বয়সের ভাললাগাকে চূড়ান্ত মর্যাদা দিতে গিয়ে বুঝতেই পারছে না জীবনের চূড়ান্ত ভুলটি সম্ভবত ও করতে যাচ্ছে।
আমরা ওকে বুঝাতে পারি, ওর সুন্দর জীবনের দিশার কথা বলতে পারি। কিন্তু সিদ্ধান্তটা তো আলটিমেটলি ওকেই নিতে হবে। কিন্তু কথা থেকে যায়, কোন ভিতের উপর দাঁড়িয়ে ও সাহসী হয়ে উঠবে? সেই ভিত্তিটাই তো নেই মেয়েটির। এই ভিত্তি একরাতের কাউন্সিলিং কিংবা একদিনের ডায়লগে তৈরি হয় না। বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় স্বপ্ন, সাহস, জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য, লক্ষ্য গড়ে তুলতে সাহায্য করতে হয়। হাজার বছর ধরে পরিবারে, সমাজব্যবস্থায় সেট করা নারীর প্রথাসিদ্ধ রোলগুলোর বাইরে জীবনের বৃহত্তর মানের সন্ধান দিতে হয়। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার জেণ্ডার নির্ধারিত ব্যাটা ছেলে, অবলা-পরগাছা-স্বামীজীবী নারী তৈরির পারিবারিক কারখানা বন্ধ করতে হয়। বিষয়গুলো আসলে জীবন সম্পর্কে একটা সামগ্রিক দর্শনের।
আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতে আঠার/উনিশ বছরের একটা ছেলের চাইতে একটা মেয়ের দেখার, দর্শনের বয়স বেশিই হয়ে থাকে। এই বয়সেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বাঁধাবন্ধনহীন, শাসনহীন, ছন্নছাড়া হতে চায়। বুদ্ধি-বিচেনার থেকে আবেগ দ্বারা শাসিত হয় শরীর ও মন। তাই এ বয়সে ভুল হওয়ার, ভুল করার সম্ভাবনা থাকে সব থেকে বেশি। অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই প্রেমিকার/প্রেমিকের হাত ধরে নিরুদ্দেশের পথে পাখা মেলতে প্ররোচনা দেয় এই বয়স। এবং ভুল করেই বুঝতে পারে ভুল হয়েছিল। ততদিনে কারও কারও সুযোগ থাকে শুধরে নেওয়ার। অধিকাংশের সে সৌভাগ্য হয় না। একঘেয়ে, নিস্তরঙ্গ, নিরানন্দ, বিষাদগ্রস্ত, বিষণ্ণ জীবনের ঘানি টেনে ফুরিয়ে যায় সোনালি সময়।
উপরের ঘটনাগুলো অভিনব নয়। আমাদের অভিজ্ঞতার ভেতরে প্রতিনিয়ত এসব ঘটনার সঞ্চারণ চলছে। সমাজের শক্তিশালী কেন্দ্র থেকে বলা হচ্ছে এসবই নিয়ম, মেনে নাও। অধিকাংশক্ষেত্রে রাষ্ট্র ওই নিয়মগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল নয়তো উদাসীন। তথাপি, কিছু মানুষ ওই নিয়মগুলোর প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে, চ্যালেইঞ্জ জানাচ্ছে প্রথাবদ্ধ সমাজ – সংসারের জীর্ণ, দীর্ণ ব্যবস্থাকে? শিক্ষিত নারীদের ভেতরে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটা সামগ্রিক লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। পিতৃতন্ত্রের দ্বারা বাজেয়াপ্ত করে রাখা নারীর সব অধিকার তাঁরা ছিনিয়ে নিতে উদগ্রীব। নারীর এই লড়াইয়ে বন্ধু-সহযোদ্ধা হিসেবে ‘প্রায় মুক্ত’ কিছু পরুষকেও দেখা যাচ্ছে। ওই পুরুষেরা প্রকৃত অর্থেই বুঝতে সক্ষম হচ্ছে যে পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্রের দ্বারা নিপীড়নের শিকার প্রধানত নারী হলেও পুরুষ স্বয়ং পুরুষতন্ত্রের শিকার। সুতরাং নারী-পুরুষের যৌথ প্রয়াসে সমাজ শরীর থেকে পুরুষতন্ত্রের শেকল খসে পড়বে। মুক্ত হবে আমাদের মা, বন্ধু, প্রিয়জন।
সারাবাংলা/ এসএস