কর্মক্ষেত্রে বাড়ছে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি- সাহায্য করবে কে?
২৭ নভেম্বর ২০১৭ ১২:৫৬
মারজিয়া প্রভা
কেস স্টাডি ১ – পিউ বিবিএর অনার্স ফাইনাল শেষে ইন্টার্নশিপের জন্য গেলো এক অফিসে। অফিস থেকে তাকে জুনিয়র এক্সিকিউটিভের পদ দেওয়া হলো। ভীষণ খুশি সে। তার ইমিডিয়েট বস ছিলেন একজন নারী। অফিসের প্রথম দিন এমডি স্যারের সঙ্গে পিউকে সাক্ষাৎ করতে বলা হলো। এমডি স্যার পিউর বিচক্ষণতায় তাকে সরাসরি এক্সিকিউটিভ পদে পদোন্নতি দিলেন। ইমিডিয়েট বস পিউকে নতুন অফার লেটার দিয়ে বললেন এমডি স্যারকে ধন্যবাদ জানিয়ে আসতে।
পিউ এমডি স্যারের রুমে গেল ধন্যবাদ জানাতে। এমডি স্যার বলে উঠলেন, “এই অফিস এতোদিন তোমার মত মেয়েই খুঁজছিল। এত বুদ্ধিমতী, আকর্ষণীয়! আসো তোমাকে আদর করে দেই!”
দরজা খুলে ওখান থেকে বের হয়েই পিউ চাকরিটা ছেড়ে দেয়।
কেস স্টাডি ২- নতুন অফিসে রুহিসহ প্রায় ৭ জন একসঙ্গে যোগ দিলেন। সবার চাইতে বয়সে ছোট হয়েও কাজ ভালো হওয়ার কারণে মাত্র ৬ মাসের মাথায় রুহি পায় পারফরমেন্স বোনাস। সবাই ভালোবাসতো রুহিকে। কলেজ লাইফ থেকেই রুহি ছিল উচ্ছল ও আড্ডাবাজ।
প্রশাসন বিভাগের প্রধান একদিন রুহিকে আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে যেতে চাইল। সব স্যাররাই স্নেহ করেন যেহেতু, রুহিও সরল মনে আইসক্রিম খেতে গেলেন। মতিঝিলের রাস্তা তেমন একটা চিনতেন না। মধুমতি সিনেমা হল থেকে বিজয়নগর পর্যন্ত বস রুহিকে ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। রুহি কোন চিল্লাচিল্লি না করে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে বললেন, সময় বের করে জানাবেন। তিনি ঠিক করলেন চাকরিটা তিনি ছাড়বেন না। এরপর বুদ্ধি খাটিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলেন।
এরই পরের মাসে বিজয়নগর শাখায় বদলি হলো তার, তবুও যা তা কাজের কথা বলে কর্পোরেট অফিসে ডেকে পাঠাতেন প্রশাসন প্রধান। কর্পোরেট অফিসের সহকর্মি তসলিম ভাই বসে থাকতেন রুহির জন্য যাতে তার কোন ক্ষতি না হয়। এভাবেই তিন বছর চাকরি করে গেছেন রুহি। চাকরি ছাড়ার আগে প্রশাসন প্রধান রুহিকে বললেন, এই অফিসে কোন মেয়ে রুহির নখের সমান বুদ্ধি রাখে না!
কেস স্টাডি ৩- অনার্স শেষে মাত্র জবে ঢুকল ফারহানা। গার্মেন্টসের কালার বেচতো কোম্পানিটি। ফারহানা ছিল মানবসম্পদ বা এইচআর ডিপার্টমেন্টে। বস ছিলেন পাঁচ সন্তানের বাবা। কারণে অকারণে প্রথম প্রথম ফারহানাকে ডেকে পাঠাতেন। দীর্ঘ সময় গল্প করতেন। প্রেমিক ছেড়ে কেন তাকে সময় দেওয়া হয় না এইসব নিয়েও কথা বলতেন। এরপর একদিন ফাইভ স্টার হোটেলের রুমে রুম ডেট করার অফার দেয়। ফারহানা রাজি না হলে অফিস রুমেই গায়ে হাত দিয়ে জোরাজুরি করে। না পারতে ফারহানাকে চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয় সেদিন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয় দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে, এর পেছনে অর্থনৈতিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন বড় একটি ভূমিকা পালন করছে। আমাদের দেশের জিডিপি উন্নয়নে শতকরা ৩৪ ভাগ আসে কর্মজীবী নারীর অবদান থেকে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ১৮.৪ মিলিয়ন নারী শ্রমবাজারের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এই বিশাল সংখ্যক নারী তার কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ না! তারা কর্মক্ষেত্রে নানা রকমের হয়রানির শিকার হচ্ছে।
এই বছরের শুরুতে একটি সমীক্ষায় জানা যায়, উন্নত দেশ ব্রিটেনের প্রায় ৩০ ভাগ কর্মজীবী নারীই কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার। বাংলাদেশে প্রকৃত চিত্রটা এখনো পাওয়া যায় নি। তবে একশন এইডের একটি হিসাব অনুযায়ী, কেবল ঢাকা শহরেরই ৭৮ ভাগ নারী যৌন হয়রানির শিকার। যার মধ্যে কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, যানবাহন।
নানাভাবে একজন নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হতে পারে। উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ক্ষমতার প্রয়োগ করে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাওয়া, অফিস কলিগের অস্বস্তিকর যৌন নিপীড়নমূলক কৌতুক, ইমেইল, ফেসবুকে বা মোবাইল ফোনে অহেতুক ফোন দিয়ে বিরক্ত করা, কোন নারীর পিসি বা ল্যাপটপে বসে উদ্দেশ্যমুলক পর্নোগ্রাফি দেখে সেই ব্রাউজার ওপেন করে রাখা, কাজের বাইরে অন্য কোন সম্পর্ক তৈরি করার উদ্দেশে জোরজবরদস্তি করা, সরাসরি যৌন সম্পর্ক করতে চাওয়া, গায়ে হাত দিতে চাওয়া বা দেয়া, যৌন সম্পর্কের কথা বলা- এই সবকিছুর মাধ্যমেই কর্মক্ষেত্রে একজন নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়। একজন তার সহকর্মিকে অবশ্যই ভালোলাগার প্রস্তাব দিতে পারে। কিন্তু সেটি হতে হবে শোভন এবং অপরজন সেটাতে অরাজি থাকলে যদি তাকে জোর করা হয় তবে সেটিও হবে যৌন হয়রানি।
অনেক মেয়েই এইসব বিষয় নিয়ে মুখ খুলতে চায় না। কারণ এদেশের সমাজ ব্যবস্থা ও অধিকাংশ মানুষের রক্ষণশীল মানসিকতা। তাই দাঁতে দাঁতে চাপ কাজ করে যায় বেশিরভাগ কর্মজীবী নারী। না পারলে চাকরি ছেড়ে দেয়। গার্মেন্টসের কর্মজীবী নারীদের উপর জরিপ করে দেখা গেছে, মাত্র ২.২% মেয়ে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করে।
তাহলে কি কেবল বেড়েই চলবে কর্মজীবী নারীদের প্রতি এই হয়রানি! কোন কি সুরাহা নেই? এই বিষয়ে কথা হয়েছিল আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানার সাথে। তিনি জানান, “যৌন হয়রানি একটি স্বতন্ত্র ফৌজদারি অপরাধ। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিয়ে ২০০৯ সালের ১৪ মে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নীতিমালাতেও শাস্তির বিধান সম্পর্কে বলা আছে”।
এই নীতিমালার ১১ ধারা অনুযায়ী কর্মস্থল কিংবা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো নারী যৌন হয়রানির শিকার হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে পারেন এবং ছাত্রদের ক্ষেত্রে, অভিযোগ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী তাদের শ্রেণিকক্ষে আসা থেকে বিরত রাখতে পারেন। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণ হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা অপরাধ হিসেবে গণ্য করবে এবং সব সরকারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রের শৃঙ্খলা বিধি অনুসারে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পাশাপাশি যদি ওই অভিযোগ ফৌজদারি আইনের যে কোনো ধারা অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় তাহলে প্রয়োজনীয় ফৌজদারি আইনের আশ্রয় নিতে হবে যা পরে সংশ্লিষ্ট আদালতে বিচার হবে।
২০০৯ সালের নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি অফিসে একটি করে অভিযোগ কমিটি (Sexual Harrasement Redressal Committie) থাকতে হবে। এই কমিটিতে সদস্য থাকবে ৫ জন এবং নারী সদস্য বেশি থাকতে হবে। কমিটির প্রধান থাকবেন একজন নারী। অফিস কর্মকর্তার পাশাপাশি সুষ্ঠু বিচারের জন্য বাইরে থেকে দক্ষ কাউকে যুক্ত করা যাবে এই কমিটির সঙ্গে। অভিযোগকারীর সমস্ত তথ্য বরাবরের জন্য গোপন রাখবে এই কমিটি এবং সেই অনুযায়ী বিচারকাজ শেষ করবে।
কিন্তু বাস্তবতা কি বলে?
প্রতিবেদন লেখার উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ৩০ হাজার সদস্যবিশিষ্ট একটি মেয়েদের গ্রুপে পোষ্ট দেওয়া হয়েছিল কোন অফিসে কি এই ধরণের কমিটি রয়েছে কিনা! বেশিরভাগের ক্ষেত্রে উত্তর এসেছে- ‘না’। শুধু আইসিডিআরবিসহ কিছু কোম্পানিতে রয়েছে এই কমিটির ব্যবস্থা যা শতকরা ৫০ ভাগও পূর্ণ করে না।
কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বাড়ছে প্রচণ্ড আকারে। আর এই হয়রানি মেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবার পথে এক বিরাট বাঁধা। সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদার চাপে অনেকেই মুখ খোলেন না এইসব বিষয়ে। যারা মুখ খুলতে চান, তাদেরও কাছাকাছি সেই প্লাটফর্ম নেই সাহায্য চাইবার। খারাপ অঙ্গভঙ্গি বা কথা বললে থানায় কেস বা মামলা করতেও আগ্রহী হন না অনেকেই। অথচ সেসবও একধরণের হয়রানি। আর এইসব কিছুর বদৌলতে পার পেয়ে যাচ্ছে কিছু অসাধু ব্যাক্তি। যাদের বেশিরভাগই ক্ষমতার জোরে তাদের নারী সহকর্মির উপর নিয়মিতভাবে হয়রানি চালিয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় প্রত্যেকটি অফিসে যৌন হয়রানি অভিযোগ কমিটি গঠন করার জন্য চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কমিটি গঠন ও তা নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছে কি না তা মনিটরিং করার পাশাপাশি হয়রানির শিকার হলে অভিযোগ জানাতে মেয়েদের সাহস দেবার কাজটিও করতে হবে।
অলংকরণ- আবু হাসান
সারাবাংলা এমপি / এসএস