Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এ ঘর তোমারও, আমারও!


২৭ নভেম্বর ২০১৭ ১৩:০০

মাকসুদা আজীজ

নুসরাত একজন উন্নয়ন কর্মকর্তা, কাজ করেন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে। তার স্বামী কাজ করেন একটি ব্যাংকে।  এই দম্পতির পাঁচ ও দুই বছর বয়সী দুটি সন্তান রয়েছে। নুসরাত জানান, আমি এবং আমার স্বামী সামাজিক ও আর্থিক প্রতিপত্তিতে সমান-সমান। আমাদের একে অন্যের প্রতি সম্মানও সমান। এমন কখনও হয় না আমার স্বামী আমাকে ঘরের কাজের জন্য চাপ দেন বা কথা শোনান। ‘এটা হলো না কেন ওটা হতেই হবে’ গোছের আবদারও তার নেই। কখনও কখনও তিনি আমাকে ঘরের কাজে সাহায্যও করেন। তবে এসব গৃহস্থালি কাজে তার আন্তরিকতা থাকলেও দক্ষতা নেই। সর্বোপরি তিনি যদিও অনেক উৎসাহ নিয়ে আমার সাথে কাজ করেন, একজন পুরুষ হয়েও ঘরের কাজ করার জন্য তাকে অনেক সময় সামাজিক লজ্জার সম্মুখীন হতে হয়।

বিজ্ঞাপন

নুসরাতের মতো সমস্যায় ভোগেন অনেক কর্মজীবী বা গৃহিণী নারী। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাওয়ায়, নারীর  বাইরে কর্মজীবী হওয়ার হার বাড়ায় এবং কাজের লোকের অপ্রাপ্তিতে ঘরের কাজ এখন প্রায় সব পরিবারেই বেশ টেনশনের বিষয়। আর এর দায় পড়েছে পুরোটাই নারীর ঘাড়ে। সব দিক সামলাতে নারীরা হিমসিম খাচ্ছেন এবং পুরুষেরা প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী দায় থেকে নিজেকে নানান কারণে গুটিয়ে রাখছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ড. সানজীদা আখতার বলেন, এই একবিংশ শতাব্দিতে এসে এখন নারী অনেকটাই স্বনির্ভর সামাজিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে। তবে সমস্যা হচ্ছে, ঘরের কাজে পুরুষেরা এখনও পরনির্ভর। ঘরের বাইরে তারা যত রকমের কাজই করুক, ঘরে এসে পানি ঢেলে খাওয়ার জন্যও তাদের মা, বোন, বৌ, মেয়ে বা অন্য কোনো নারীর সহায়তা লাগছে।

বিজ্ঞাপন

এ ধরণের কাজ করতে না পারা বা কাজ এড়িয়ে চলা দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য বেশ ক্ষতিকর, জানান ড. সানজীদা।

ধরুন একটা পরিবার যেখানে স্বামী স্ত্রী দুইজন অফিস থেকে এসেছেন। বাসায় ফিরে স্ত্রীটি ঘরের কাজে লেগে গেলেন এবং স্বামী খেলা দেখতে বসলেন। খেলার খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো মুহূর্ত তিনি স্ত্রীর সাথে ভাগ করে নিতে চাইছেন। এদিকে স্ত্রী রান্নাঘরে অথবা ঘর গুছানোর কাজ নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন। স্বামীকে সঙ্গ দেওয়ার মতো সময় বা মানসিকতা তখন তার কাছে কই? এভাবে দিনের পর দিন তারা একটা আলাদা ভুবনে চলে যাচ্ছেন, যেখানে অন্যের প্রতি দায়িত্ব পালন ছাড়া আর কিছুই নাই – ব্যাখ্যা করেন ড. সানজীদা।

সম্প্রতি “বেলাশেষে” নামে ভারতীয় একটি চলচ্চিত্র বেশ আলোচনায় এসেছে। এ চলচ্চিত্রে দেখা যায় শেষ জীবনে এসে স্বামীটি স্ত্রীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে যেতে চান, তার অভিযোগ, স্ত্রী কখনও তার পাশে ছিলেনই না। যখন স্ত্রীও নিজের কথা বলেন, তখন বোঝা যায় একাকীত্বের অভিযোগ শুধু স্বামীর একা ছিল না। কোথাও না কোথাও স্ত্রীও পরিবার, শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি দায়িত্ব পালন একা হাতে করে গিয়েছেন, যেখানে স্বামীর কোনো ভূমিকাই ছিল না। ফলে সে জানেই না তার অলক্ষ্যে তার স্ত্রী কেমন একটা জীবন পার করে দিয়েছে।

ড. সানজীদা বলেন, এমন একটা দাম্পত্য কিছুতেই কাম্য নয়। একটা দাম্পত্য সফল করতে হলে তাদের একে অন্যকে জানতে হবে, একে অন্যের কষ্ট বুঝতে হবে। এটা শুধু কোনো সামাজিক প্রথা বা দায়িত্ব পালন না।

বিয়ের মাধ্যমে পুরুষ ও নারী একটা দল গঠন করে। পরিবার নামে এই দল সব সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি। দীর্ঘ একটা সময় এরা একে অন্যের সাথে থাকবে,সুখে-দুঃখে, রোগে-শোকে। যৌথ পরিবার প্রথা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ফলে এখন স্বামী এবং স্ত্রীই একে অন্যের সহায়। তাই নিজেদের মধ্যে সাহায্য,  সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও উদারতার মাধ্যমেই কেবল একটা সুন্দর দাম্পত্য কাটিয়ে দেওয়া যায়। যার সুফল সন্তানরাও ভোগ করে এবং সমাজে একটা সুন্দর অবস্থা তৈরি হয়। এভাবেই দাম্পত্যে দুইজনের সমান অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরেন ড. সানজীদা।

ড. কামরুল হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপক। ঘরের কাজে পুরুষদের অংশগ্রহণ এবং স্ত্রীকে সাহায্য করার বিষয়ে তিনি সবসময় খুব ইতিবাচক ধারণা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকেন।
ড. হাসানের স্ত্রী দোনাতেল্লা চেস্কা ইতালির নাগরিক। স্ত্রী এবং দুই কন্যাকে নিয়ে তিনি ঢাকাতেই বসাবাস করেন। ড. হাসান বলেন,  আমার শ্বশুরের বয়স ৭৬ বছর আর শাশুড়ির ৭৩। সকাল থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দুইজনই প্রায় পুরোটা সময় কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকেন। ঘর পরিষ্কার, কাপড় ধোয়া, আয়রন করা, বাজার করা, রান্নাবান্না করা, হাড়ি-পাতিল ধোয়া, বাসার সামনের বাগানের দেখভাল করা, বাড়ির পিছনে সবজি বাগানের দেখভাল করা ইত্যাদি সব কিছুই নিজ হাতে করেন।
তিনি আরো বলেন,  ইতালিতে সাধারণ মানুষের জন্য কাজের মানুষ বলতে কোন শব্দ কারও জানা নেই। আমার স্ত্রীর আরও একটি বোন আছে। তাদের আছে দুই কন্যা। তাদের ছোট মেয়েটির বাচ্চা রাখা, সপ্তাহে অন্তত দুইদিন রান্না করা – এসব করে কর্মচঞ্চল দিনে কাটে তাদের। এরকম কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে বলেই দুজনে এই বয়সেও নীরোগ সুস্থ জীবন যাপন করতে পারছেন। অথচ আমরা আমাদের দেশে এই বয়সের মানুষকে সমস্ত কাজ কাজ থেকে অবসর দিয়ে দেই।

ড. হাসান বলেন, আমি আমার অনেক শিক্ষককে দেখেছি অবসরে যাওয়ার কয়েক বছর আগে থেকেই মানসিকভাবে অবসরে চলে যান। তারা ক্লাস নিতে চান না, ল্যাবে থাকতে চান না,কোনো পরীক্ষা কমিটিতে থাকতে চান না। অবসরে যাওয়ার পর বাসায়ও তেমন কোনো কাজ করেন বলে মনে হয় না।

আমাদের প্রতি ঘরেই রান্নার জন্য বুয়া, কাপড় ধোয়ার জন্য বুয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলে নেওয়ার জন্য বুয়া, গাড়ি চালানোর জন্য ড্রাইভার। তারপরও আমাদের অনেক অভিযোগ-  উফফ কাজ করতে করতে জীবন শেষ। সেই জন্যই দেখা যায় নানা রোগ শোকে কাতর হয়ে যাই। ড. হাসানের মতে, একসাথে দুজন মিলে কাজ করা শুধু একজন আরেকজনকে সাহায্য করা নয়। এটা একটা পারিবারিক সময় কাটানোর কৌশলও। যেখানে একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করা সম্ভব হয় এবং সন্তানরাও স্বনির্ভর হওয়ার একটা সুন্দর শিক্ষা পায়।

একে অপরকে সহযোগিতা করার চেয়েও যেটা জরুরী তা হচ্ছে সহমর্মি হওয়া। আপনি যদি প্রতিদিন আপনার স্ত্রীর সাথে হাতে হাত লাগিয়ে ঘরের কাজ করেন তবে আপনি জানবেন, বাসায় কোন্ জিনিসটা নেই, অথবা আজকে আপনার সঙ্গীর জন্য নির্ধারিত কাজগুলোর করার মতো অবস্থা আদৌ তার আছে কি না। যেহেতু তারও একটা ক্যারিয়ার আছে এবং সেখানে তার সমস্যা থাকতে পারে, একসাথে কাজ করলে এই অসুবিধার সময়গুলো পার হতে সঙ্গীর অসুবিধা হবে না।

স্ত্রীর সাফল্য মানে কিন্তু আমারও সাফল্য- জোর দিয়ে বলেন ড. হাসান।

ড. হাসানের কথার সমর্থন পাওয়া যায় ড. সানজীদার কাছেও। তার মতে, এখন যুগটা শুধু চাকরিক্ষেত্রে মেধা দেখানোর নয়। ভীষণ প্রতিযোগিতার এই যুগে সামাজিক সম্পর্ক তৈরি প্রায় কাজে দক্ষ হওয়ার মতোই জরুরি। এখন একজন মানুষ যদি শুধু অফিস করে এসে বাকি সময়টা ঘরের কাজেই ব্যয় করে ফেলেন তাহলে তিনি তো বিশ্রামের সময়ই পাবেন না, সম্পর্ক তৈরি তো তার জন্য অসম্ভব।

একটা সফল পরিবার ব্যবস্থার জন্য ঘরের কাজে পুরুষদের অংশগ্রহণের বিষয়ে জোর দেন ড. সানজীদা। তিনি বলেন, শৈশব থেকেই একটা ছেলেকে ঘরের কাজে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত করতে হবে। এখনও আমাদের সমাজ পুরুষদের কাজ করার বিষয়টিকে সহজভাবে নেয় না। অধিকাংশ পুরুষ এ নিয়ে নিজেরা হীনমন্যতায় ভোগেন এবং অন্যদেরও হীনমন্যতায় ভোগান। এমনকি পরিবারের অনেক নারী সদস্যও পুরুষদের ঘরের কাজ থেকে দূরে রাখেন।

ড. সানজীদার মতে, গৃহস্থালি কাজ করা, রান্না শেখা স্বনির্ভর হওয়ার একটা কৌশল। এগুলো করে কেউ নিচু বা উঁচু হয়ে যায় না। স্বনির্ভরতার কোনো নারী-পুরুষ ভেদাভেদ হতে পারে না। নিজের প্রয়োজনে প্রতিটা মানুষকে এসব কাজ জানতে হবে এবং দৈনিক তা অনুশীলন করতে হবে। তবেই একটা সুন্দর শক্তিশালী পরিবার গঠণ করা সম্ভব হবে।

 

অলংকরণ- আবু হাসান

ছবি- ইন্টারনেট

সারাবাংলা/ এমএ/ এসএস

 

ঘর দুজনের সংসার নারী পুরুষ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর