বঙ্গবন্ধুর বীরাঙ্গনাদের ঠাঁই নেই সরকারের খাতায় !
২০ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৫:২৮
ইতিহাস বলে যে কোন প্রকার যুদ্ধাবস্থার মাঝে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় নারী। যুদ্ধের ময়দানে সৈনিকরা থাকে বন্দুক হাতে আর আক্রান্ত দেশটিকে জাতিগতভাবে ধ্বংস করার জন্য বেছে নেয়া হয় নারীদের। ব্যতিক্রম ঘটেনি বাংলাদেশেও।
১৯৭১ সালের সেই যুদ্ধে পাকিস্তানীরা কেবল আমাদের ৩০ লক্ষ মানুষকে খুন করেই থেমে থাকেনি। বাঙালী জাতিসত্তাকে পাল্টে দেবার মনোবাসনা নিয়ে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তেই তারা চালিয়েছিলো গণধর্ষণের মত অপরাধমুলক কাজ। কত নারী শারিরীক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো সে হিসাব এখনও চূড়ান্ত না হলেও দেশি বিদেশি সূত্রের হিসাবে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত যে পাকিস্তানীরা ধর্ষণ করেছিলো প্রায় ২ লক্ষ নারীকে।
যুদ্ধ থেমে গেলো, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলো কিন্তু এইসব ধর্ষিত নারীদের কী হবে? তাদের গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তানের পরিচয় কী হবে? এসব নিয়ে যখন নারীরা ছিলো পরিত্যক্তের তালিকায় তখন বঙ্গবন্ধু তাঁর দায়িত্ববোধের আরেক পরিচয় দিলেন। তিনি উপাধি দিলেন তাদের “বীরাঙ্গনা” বলে। পরবর্তীতে এটাই অফিসিয়াল পরিচিতি লাভ করে।
কিন্তু হায়, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পার করে এখন ৪৭ বছরে পা দিয়েছে বাংলাদেশ কিন্তু প্রতিষ্ঠা পায়নি সেসব বীরাঙ্গনাদের নাগরিক অধিকার। তারা এখনও পায়নি সে আত্মত্যাগের প্রতিদান। সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সচিব ও মন্ত্রী জানিয়েছেন সকল বীরাঙ্গনাদের তালিকায় আনা সম্ভব নয়। ২ লক্ষের মাঝে মাত্র ১৮৫ জনকে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে, অপেক্ষমান তালিকায় আছে আরও প্রায় ৬৫ জন। তাহলে বাকিদের কী হবে? তারা কী পাবেনা তাদের স্বীকৃতি? কিন্তু কেন? কোন ব্যর্থতা আজ আঁটকে দিচ্ছে আমাদের মন্ত্রনালয়কে? সেসব নারী কি তাহলে মৃত্যুর আগেও সামাজিক মর্যাদা পাবার অধিকার রাখে না? তারা কে কোথায় কেমন করে বেঁচে আছে সে খবর রাখার দায়িত্ব কি রাষ্ট্রের নয়?
এই যদি হয় বীরাঙ্গনাদের ভবিষ্যৎ তাহলে তাদের গর্ভে জন্ম নেয়া হাজার হাজার যুদ্ধশিশুদের কী হবে? ৭১ সালে পাকিস্তানী সৈনিকেরা যে পরিকল্পনা নিয়ে নারীদের গর্ভে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো তাদের বীজ সেসব শিশুদের হিসাবই বা কে রাখে?
যুদ্ধশিশু নিয়ে কাজ খুব একটা হয়নি বাংলাদেশে। সারাবিশ্বেই আছে এমন যুদ্ধশিশু। সবজায়গাতেই হিসাব আছে কারা তারা। কিন্তু বাংলাদেশের এই শব্দটির সাথেই নেই কোন পরিচয়। যুদ্ধশিশুদের সংখ্যা নিয়েও আছে বিতর্ক। কোথাও বলা হচ্ছে ২৫ হাজার আবার কোথাও বা এর সংখ্যা ১০ হাজার। আবার কেউ বলছে ২০ হাজারের বেশি হবে না। প্রকৃত সংখ্যা যাই হোক না কেন এটা ১০ থেকে ২০ হাজারের মাঝেই আছে বলেও কেউ কেউ মত দিয়েছেন।
তাহলে কোথায় সেসব শিশুরা? সেসব শিশুদের প্রত্যেকেই এখন যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে, পরিবার হয়েছে এবং নিশ্চয়ই এই সমাজেই কোথাও না কোথাও বসবাস করছে। যুদ্ধশিশুদের নিয়ে কাজ করছে এমন লোকও আছে বাংলাদেশ। জানা যায়, যুদ্ধশিশুদের অনেককেই দত্তক হিসাবে নিয়েছিলো সেসময় বিভিন্ন চার্চ বা কোন ব্যক্তি।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু সরকার পরিকল্পনায় যেমন রেখেছিল বীরাঙ্গনাদের ঠিক তেমনি হিসাবের তালিকাতে ছিলো এইসব যুদ্ধশিশুরাও। কিন্তু ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সরকারগুলো ক্ষমতায় এসে বন্ধ করে দিয়েছিলো সেসব কার্যক্রম। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের শপথ নিয়ে। তাহলে এই সরকারের কাছে যদি আমরা শুনি যে বীরাঙ্গনাদের সবাইকে তলিকাভুক্ত করা সম্ভব নয়, এমনকি মোট সংখ্যার অর্ধেকও সম্ভব নয় তখন স্বাভাবিকভাবেই আমরা আশঙ্কায় পড়ে যাই।
চারদিকে যেভাবে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির অনুচরেরা বেড়ে উঠছে ঠিক এই সময়টাতে যদি সরকার খুব পরিকল্পিতভাবে না আগায় তাহলে এই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী হবে সেটা অনুমান করতে চাই না। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবতার নিরিখে যদি আগানো না যায় তাহলে কেবল বিচ্ছিন্ন ভাবনা দিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠন করা সম্ভব হবে না।
একদিকে ৭১ এর ঋন অন্যদিকে পাকিস্তানীদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এই দুই বিষয়কে মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে আমাদের মন্ত্রনালয়কে। বীরাঙ্গনাদের যদি যথাযথ সম্মান না দিতে পারি তাহলে আমরা থেকে যাবো একটি অকৃতজ্ঞ জাতি হিসাবে। যুদ্ধশিশুদের কে কোথায় আছে সে বিষয়টা খুঁজে বের করা আমাদের ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের জন্যই দরকার। তাদেরকে খুঁজে বের করে যথযথ মর্যাদায় যদি এদেশের শিক্ষায় শিক্ষিত করা না যায় তাহলে এর ফলাফল হবে ঋনাত্মক। একদিকে পিতামাতার পরিচয় সংকট, অন্যদিকে জাতিসত্তার পরিচয় সংকট। সবকিছু মিলিয়ে তাদের ভিতরে জন্ম নিতে পারে এক অন্যরকম চিন্তার জগত। আর এই বড় অংশটিকে যদি বাংলাদেশের চেতনায় জাগিয়ে তোলা না যায় তারা বেড়ে উঠবে কোন শিক্ষায়?
আগামীর বাংলাদেশ নির্ভর করছে আজকের পরিকল্পিত কর্মপদ্ধতির উপর। মুখে কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোনার বাংলা বললেই হয়ে যাবে না। প্রতিটা কর্ণার ধরে ধরে আগাতে হবে সঠিক পদ্ধতিতে। তাই, আইনী হোক বা যে জটিলতাই হোক না কেন, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা বা যুদ্ধশিশু কোন বিষয়কেই ছোট করে বা অপ্রয়োজনীয় বলে ভাবার কোন অবকাশ নেই। মাথায় রাখতে হবে, ৭১ সালের সেই সময়টাতে পাকিস্তানীরা ও তাদের এদেশীয় দোসররা এগিয়েছিলো অনেক ঠান্ডা মাথায়। তাদের সেই টার্গেট এখনও পরিবর্তন হয়নি। আগাচ্ছে খুব কৌশলে, ধীরে ধীরে। একটা প্ল্যান ফেইল করলে অন্য আরেকটা প্ল্যানে আগায় তারা। আর আমরা? আমরা কী পারছি সেই তালে নিজেদের প্ল্যান ঠিক করতে? একই ছকে আঁকা পরিকল্পনায় আগামীর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা কী আদৌ সম্ভব?
সারাবাংলা/ এসএস