নতুন সম্ভাবনার ডাক: খেলতে খেলতেই পরিবেশ শিক্ষা
৪ মে ২০২৫ ১৬:৫৭
তাপমাত্রা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাসের ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে, পরিবেশ শিক্ষায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা হচ্ছে, আর সেটি হচ্ছে খেলার মাধ্যমে শেখা।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাস – এই তিনটি শব্দ এখন আর শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক আলোচনার বিষয় নয়। এগুলো আজ বাস্তব, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ। বিশ্বজুড়ে যখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মানুষকে বিপর্যস্ত করছে, তখন পরিবেশ শিক্ষার গুরুত্ব ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর সেই শিক্ষাই যদি হয় আনন্দের মাধ্যমে, তবে তা শিশুর মনে গেঁথে যাবে অনেক গভীরে।
ইউনেস্কোর ১০০টি দেশের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মাত্র ৫৩ শতাংশ জাতীয় শিক্ষা পাঠ্যক্রমে জলবায়ু পরিবর্তনের উল্লেখ রয়েছে, এবং যেসব ক্ষেত্রে এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে, সেখানে এটি প্রায়শই খুবই কম গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইউনেস্কো’র ২০২১ সালের ‘Learn for our Planet’ রিপোর্ট অনুযায়ী, যে ৪৬টি ইউনেস্কো সদস্য দেশের শিক্ষানীতি ও পাঠ্যক্রম বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তার অর্ধেকেরও বেশিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো উল্লেখই নেই। শুধুমাত্র ১৯ শতাংশ পাঠ্যক্রমে জীববৈচিত্র্যের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরে পরিবেশবিজ্ঞান বিষয়টি আংশিক অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, প্রাথমিক স্তরে অর্থবহ জলবায়ু বিষয়ক শিক্ষা এখনো সীমিত। এই শিক্ষার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বে। অথচ শিশুকালেই গড়ে ওঠে সচেতনতা, দৃষ্টিভঙ্গি, সহানুভূতি, দায়িত্ববোধ ও মানসিকতার বীজ।
ইউনেস্কোর সংবিধানে একটি কথা আছে, ‘যেহেতু যুদ্ধের শুরু মানুষের মনে, সেহেতু শান্তির প্রতিরক্ষা ব্যূহও গড়ে তুলতে হবে মানুষের মনেই।’
এই শিক্ষাগত ব্যবধান কাটিয়ে ওঠার জন্য বিশ্বজুড়ে উদ্ভাবকরা নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করছেন। হাতে-কলমে শেখা এবং খেলার মাধ্যমে শিক্ষার মডেল এখন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, যেখানে শিশুদের সামনে জটিল বিষয় সহজ ও আনন্দময় করে উপস্থাপন করা হয়।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সুপার কিড ইনিশিয়েটিভস এর তৈরি ক্লাইমেট হিরো কার্ড গেম এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এটি একটি অভিনব শিক্ষামূলক কার্ড গেম, যেখানে পরিবেশগত জ্ঞান আর খেলার আনন্দের মেলবন্ধন ঘটেছে। এটি শুধুমাত্র একটি খেলা নয়, বরং একটি হাতিয়ার যা ভবিষ্যতের প্রজন্মকে তৈরি করছে জলবায়ু সচেতন নাগরিক হিসেবে।
ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) -এর এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২০ সাল ছিল ইতিহাসের সর্বাধিক উষ্ণ বছরগুলোর একটি। বর্তমানে ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। আমরা প্রতিবছর পৃথিবীর যে পরিমাণ সম্পদ উৎপাদন করতে সক্ষম, তার চেয়েও বেশি ব্যবহার করি। আমাদের বর্তমান জীবনধারা টেকসই নয়। তাৎক্ষণিক পরিবর্তন অপরিহার্য, তবে স্থায়ী পরিবর্তন সম্ভব নয় শিক্ষা ছাড়া।
এই ধারণাকে বাস্তব রূপ দিয়েছে ক্লাইমেট হিরো কার্ড গেম। গেমটিতে মোট ৪৮টি কার্ড রয়েছে, যার মধ্যে ৪২টি প্রধান কার্ড এবং ৬টি বিশেষ ‘ট্রিক কার্ড’। প্রতিটি কার্ড পরিবেশ সম্পর্কিত কোনো সমস্যা বা সমাধান উপস্থাপন করে।
ক্লাইমেট হিরো গেমের কার্ডগুলো বায়ু, পানি এবং মাটি এই তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে; রয়েছে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উপাদান। শিশুরা দুটি ভিন্ন মোডে এই গেম খেলতে পারে। প্রথমত, সেইভ দ্যা প্ল্যানেট মোড – সমস্যা চিনে সমাধান বের করার খেলা ও ছোটদের জন্য উপযোগী। দ্বিতীয়ত, হ্যান্ড জিরো মোড – বড়দের জন্য চ্যালেঞ্জিং মোড, যেখানে কৌশলের মাধ্যমে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়।
ব্রুকলিন ইনস্টিটিউট ফর প্লে কর্তৃক ২০১৮ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, খেলা শিশুদের শেখার দক্ষতা ২০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে। এর কারণ, খেলার সময় শিশু মনোযোগী থাকে, আবেগের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শেখে। আর যদি সেই খেলা পরিবেশ নিয়ে হয়, তবে শিশুরা প্রকৃতির সাথেও গভীর সংযোগ তৈরি করে।
তানজিল হাসান, সুপার কিড ইনিশিয়েটিভস-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ক্লাইমেট হিরো কার্ড গেমের নির্মাতা বলেন, ‘ক্লাইমেট হিরো গেম শিশুদের কাছে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জটিল বিষয়গুলো খেলার ছলে সহজভাবে উপস্থাপন করে। এটি শিশুদের ইকো-ক্রিটিক্যাল চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটায়, যা তাদের একাডেমিক উন্নতিতে সহায়ক এবং ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার পথ প্রশস্ত করে।’
এই কার্ড গেমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শুধু খেলবেই না, বরং শিখবে কিভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কিভাবে দলগতভাবে কাজ করতে হয় এবং কিভাবে সমস্যার বাস্তব সমাধান খুঁজতে হয়। শিক্ষক ও অভিভাবকদের কাছ থেকে গেমটি নিয়ে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। অনেকেই এটিকে ক্লাসরুমে শিক্ষামূলক ফ্ল্যাশকার্ড হিসেবেও ব্যবহার করতে আগ্রহী।
এই সময়োপযোগী উদ্যোগ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ১৩ ও ৪.৭ পূরণে অবদান রাখছে। সুপার কিড ইনিশিয়েটিভস এই গেমের বৈশ্বিক সংস্করণ তৈরি করতে আগ্রহী, যাতে দেশ ও দেশের বাইরের শিশুরাও নিজেদের ভাষায়, সহজভাবে খেলতে ও শিখতে পারে। তারা স্কুল, এনজিও, এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতায় অংশীদারিত্ব গড়ে তুলে পরিবেশ শিক্ষাকে শিশুদের নাগালের মধ্যে আনতে চায়।
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। যদি তারা ছোটবেলা থেকেই পরিবেশ ও জলবায়ু সম্পর্কে সচেতন হয়, তবে ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে আরও সবুজ, আরও সহানুভূতিশীল। ক্লাইমেট হিরো কার্ড গেম কেবল একটি গেম নয়, এটি এক নতুন শিক্ষার ভাষা, এক নতুন সম্ভাবনার ডাক।
সারাবাংলা/এএসজি