Monday 12 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রযুক্তিই আগামী দিনের প্রতিরক্ষা

এম আর লিটন
১১ মে ২০২৫ ১৮:২০

বিশ্বায়নের এ যুগে কোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কেবল আবেগ দিয়ে রক্ষা করা যায় না। সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো কেবল অস্ত্র দিয়ে না। তারা প্রযুক্তি, অর্থনীতি, তথ্যযুদ্ধ ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের মাধ্যমেও অন্য রাষ্ট্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হওয়া একান্ত অপরিহার্য। মনে রাখতে হবে, প্রযুক্তিই আগামী দিনের প্রতিরক্ষা।

বিজ্ঞাপন

আমরা আবেগপ্রবণ জাতি। ভালোবাসি দেশকে। কিন্তু ভালোবাসা যথেষ্ট নয়। যদি বাস্তবতা না বুঝি, যদি প্রস্তুতি না নিই—তবে আবেগ দিয়ে জাতি টিকে না। আগে সাম্রাজ্যবাদ মানে ছিল শারীরিকভাবে দখল। এখন এটি মানসিক দখল। আগে লড়াই হতো বন্দুক দিয়ে। এখন হয় ব্র্যান্ড দিয়ে। গ্লোবাল কোম্পানিগুলো এখন একেকটা রাষ্ট্র। তাদের আছে ডেটা, প্রযুক্তি, যোগাযোগব্যবস্থা। তারা কী খাওয়াবেন, কী পরাবেন, কী ভাবাবেন—সব নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা ভাষা বদলায়। সংস্কৃতি বদলায়। ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়। আমরা হুঁশ করতে করতেই দেখি, আমরা হয়ে গেছি তাদের মতো তারা আমাদের বাজার দখল করে। আমাদের মানসিকতাও দখল করে। এটি নিঃশব্দ আগ্রাসন।

বিজ্ঞাপন

ডেটা এখন তেল নয়, ডেটা এখন অস্ত্র। কে কত তথ্য নিয়ন্ত্রণ করে, কে কত বিশ্লেষণ করতে পারে—তা নির্ধারণ করে ক্ষমতার ভারসাম্য। বিশ্বে এখন ক্ষমতা চলে গেছে প্রযুক্তির হাতে। বড় কোম্পানির হাতে। তারা রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী।

উদাহরণ দিই—মেটা, গুগল, অ্যাপল, অ্যামাজন, টিকটক—তারা আমাদের জীবন জানে। তারা আমাদের চিন্তা জানে। তারা চাইলে আমাদের মনোভাব বদলে দিতে পারে। যারা তথ্যের ওপর দখল রাখে। তারা আসলে ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করে।

১৯৫০ এর দশকে দক্ষিণ কোরিয়া ছিল এক ধ্বংসস্তূপ। যুদ্ধ শেষ হলেও কিছুই ছিল না। কিন্তু তারা থেমে থাকেনি। তারা শিক্ষা সংস্কার করেছে। প্রযুক্তি ও গবেষণায় বিনিয়োগ করেছে। তারা বলেছে—‘আমরা শুধু ব্যবহার করব না, আমরা তৈরি করব।’ তাদের স্কুলে বিজ্ঞান শেখানো হয় হাতে-কলমে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বাধ্যতামূলক। সরকার স্টার্টআপে উৎসাহ দেয়।আজ তারা তৈরি করেছে স্যামসাং, হুন্দাই, এলজি—যারা শুধু পণ্য নয়, রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার প্রতীক।তাদের ‘কে-পপ’ এখন বিশ্বের তরুণদের মন জয় করেছে। তাদের সিনেমা, ভাষা, পোশাক—সব ছড়িয়ে পড়েছে। এটাই সফট পাওয়ার।

ইসরায়েল ছোট দেশ। তারাও নিরাপত্তার বিষয়টি নতুনভাবে দেখেছে। তারা শুধু সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করেনি। তারা সাইবার প্রতিরক্ষা গড়েছে। তারা শিশুদের ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তি শেখায়। হ্যাকিং শেখায়। ডেটা বিশ্লেষণ শেখায়। তারা জানে, ভবিষ্যতের যুদ্ধ হবে সাইবারে। তাদের অনেক বড় স্টার্টআপ আছে। তাদের অনেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমেরিকা ও ইউরোপ। তারা জানে, অস্ত্রের চেয়ে বেশি কার্যকর তথ্য ও প্রযুক্তি।

আমাদের বাস্তবতা। আমরা এখনো বই মুখস্থ করি। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেলে খুশি হই। গবেষণা করি না। প্রশ্ন করে চিন্তা করতেও শেখাই না। আমাদের পাঠ্যবই পুরোনো। শিক্ষকেরা নিজেরাও অনেক কিছু বোঝেন না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত নয়।

তরুণরা চাকরি খোঁজে। উদ্ভাবন করতে ভয় পায়। প্রযুক্তির ব্যবহার জানে, কিন্তু তৈরি করতে পারে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাগার নেই। নেই পর্যাপ্ত গবেষণা তহবিল। সরকারি বাজেটে গবেষণার জন্য বরাদ্দ খুবই কম। আমরা আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি ব্যবহার করি। কিন্তু আমাদের নিজস্ব কিছু নেই। এই নির্ভরতা আমাদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।

আমাদের সমাজে আমরা প্রায়ই দেখি যে কোনো জাতীয় সংকট বা বৈশ্বিক ইস্যুতে আবেগপ্রবণ ফেসবুক পোস্ট, ইউটিউব ভিডিও কিংবা নানা রকম প্রোপাগান্ডার ছড়াছড়ি হয়। এগুলো মাঝে মাঝে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখলেও, বাস্তবিক অর্থে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তা কার্যকর নয়। কারণ, আজকের পৃথিবীতে যুদ্ধে বিজয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অর্থনৈতিক সক্ষমতা, প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ ও তথ্য ব্যবস্থাপনার দক্ষতা।

আবেগ দিয়ে একসময় স্বাধীনতা অর্জন হয়। কিন্তু তা ধরে রাখতে চাই দক্ষতা। চাই প্রযুক্তি। চাই জ্ঞান। যদি আমাদের সন্তানরা শুধু ভোক্তা হয়, তবে ভবিষ্যতে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তারা অন্যদের সিদ্ধান্ত মেনে চলবে।

এমতাবস্থায় আমাদের করণীয়—

১. শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন জরুরি। মুখস্থ বাদ দিতে হবে। হাতে-কলমে শিক্ষা, প্রকল্পভিত্তিক পাঠদান চালু করতে হবে।

২. গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্ভাবন উৎসাহিত করতে হবে।

৩. প্রযুক্তি খাতে স্টার্টআপ গড়ে তুলতে হবে। তরুণদের জন্য প্রণোদনা দিতে হবে।

৪. সাইবার নিরাপত্তায় দক্ষতা বাড়াতে হবে। তথ্য সুরক্ষা ছাড়া কোনো স্বাধীনতা টিকবে না।

৫. জাতীয় তথ্যভিত্তিক নীতিমালা দরকার। বিদেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করব, কিন্তু আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে নিজের হাতে।

৬. মাধ্যমিক স্তর থেকেই কোড শেখানো উচিত। বিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স—এসব বিষয়ে আগ্রহ তৈরি করতে হবে।

৭. নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ভিডিও প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা দরকার। এতে তথ্য নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে থাকবে।

আগামী দিনের যুদ্ধ হবে অদৃশ্য। সেখানে শত্রু মানে শুধু সেনাবাহিনী নয়। শত্রু হতে পারে সফটওয়্যার, হতে পারে ভুয়া খবর, হতে পারে ম্যালওয়ার। আমরা যদি প্রস্তুত না হই, তাহলে প্রযুক্তিই আমাদের বিপদে ফেলবে। আবার প্রযুক্তিই পারে আমাদের রক্ষা করতে। তাই আমাদের দরকার নিজের তৈরি সফটওয়্যার, নিজের তৈরি হার্ডওয়্যার, নিজের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আমাদের সন্তানদের বইয়ের পাশাপাশি ল্যাপটপ দিতে হবে। তাদের শুধু কবিতা নয়, কোডও শিখতে হবে। শুধু সাহিত্য নয়, সায়েন্সও ভালোবাসতে হবে।

একটি জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকে তার সংস্কৃতিতে। যদি আমাদের সিনেমা, গান, ভাষা হারিয়ে যায়, তাহলে জাতি হিসেবে আমরাও বিলীন হব। তাই দরকার আমাদের সংস্কৃতিকে আধুনিক প্রযুক্তিতে তুলে ধরা। বাংলা গান হোক ইউটিউবে ট্রেন্ডিং। বাংলা সিনেমা যাক আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে।নিজের ভাষায় বানানো গেম, অ্যাপ, সফটওয়্যার—এসবই সফট পাওয়ার। যেটা দুনিয়াকে বলে—আমরা আছি, আমরা আলাদা, আমরা শক্তিশালী।

সার্বভৌমত্ব মানে কেবল স্বাধীন পতাকা নয়। এটি মানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। যদি সেই ক্ষমতা অন্যের হাতে যায়, তবে স্বাধীনতা কাগুজে থাকে।আমরা যদি প্রযুক্তির মালিক না হই, তথ্যের দখলে না থাকি—তাহলে অন্যরা আমাদের চালাবে।ভবিষ্যৎ লড়াই হবে স্মার্ট, দ্রুত, নিরব। সেখানে আগে প্রস্তুতি নেওয়াই হবে বুদ্ধিমত্তা।

একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শক্তি তার জনগণ। আর জনগণের সবচেয়ে বড় শক্তি—তাদের জ্ঞান, দক্ষতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা। আমরা যদি শুধু আবেগে থাকি, বাস্তবতা বুঝি না—তাহলে একদিন হারিয়ে যাব। কিন্তু যদি আমরা জ্ঞানকে শক্তি করি, প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করি—তাহলে কেউ আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।

স্বাধীনতা অর্জন বড় কথা নয়। সেটি টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ। আর সেটি করতে হলে, আমাদের দরকার সাহস, চিন্তা ও তৈরি হওয়ার মানসিকতা।তবেই আমরা হব একটি জাগ্রত, প্রগতিশীল, মর্যাদাসম্পন্ন জাতি।

লেখক: সাংবাদিক

সারাবাংলা/এএসজি

এম আর লিটন প্রযুক্তি ফিচার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রযুক্তিই আগামী দিনের প্রতিরক্ষা