কখনো কি ভেবে দেখেছেন, যুদ্ধ যখন শুরু হয়, গোলাগুলির আওয়াজের ভেতর হারিয়ে যায় কোন কণ্ঠগুলো? যাদের চোখের জলে ভেসে যায় পুরোটা গ্রাম কিংবা শহর? সে কণ্ঠগুলো অনেকটা চেনা—মায়ের, বোনের, স্ত্রীর বা কন্যার।
প্রতিবছর ২৪ মে পালিত হয় ‘শান্তি ও নিরস্ত্রীকরণের জন্য আন্তর্জাতিক নারী দিবস’। এটি এমন একটি দিন, যেটি বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং যুদ্ধ ও সহিংসতা প্রতিরোধে নারীদের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানায়। নারী কণ্ঠ আজ কেবল ঘরের চার দেয়ালে নয়, বিশ্ব মঞ্চেও শান্তির দাবিতে উচ্চারিত হচ্ছে—আর এই দিবস তারই এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
এই দিবসের সূচনা ১৯৮০-এর দশকে নারীবাদী শান্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, সামরিক দখলদারিত্ব এবং পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা যখন চরমে, তখন নারীরা একজোট হয়ে বলেছিলেন: ‘শান্তি চাই, অস্ত্র নয়’। সেই সময়কার আন্দোলনের অংশ ছিলেন ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু নারীনেত্রী, যারা যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন—‘একটি শিশুর কান্না যেন কখনো ট্যাঙ্কের গর্জনের নিচে চাপা না পড়ে’।
নারীরা পরিবার ও সমাজের কেন্দ্রে অবস্থান করে। তারা সরাসরি যুদ্ধের শিকার না হলেও, যুদ্ধের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে নারীদের ওপর—পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, ধর্ষণ, বাস্তুচ্যুতি, অনিরাপত্তা এবং দারিদ্র্যের শিকার হন নারীরা। ফলে, তারা যখন শান্তির প্রশ্নে নেতৃত্বে আসে, তখন তা হয় অন্তর থেকে আসা একটি দাবী, একটি প্রয়োজন। এই দিবস সেই প্রাকৃতিক শান্তিপূর্ণ প্রবণতাকে স্বীকৃতি দেয় এবং নারীদেরকে আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আরও অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তোলে।
জাতিসংঘের ১৩২৫ নম্বর রেজুলুশনও এই বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েছে। রেজুলুশনটি নারীদের শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের ওপর জোর দেয় এবং বলেছে, টেকসই শান্তি অর্জনে নারীদের সমান অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এর তাৎপর্য কম নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট কিংবা জলবায়ু দুর্যোগ—সবক্ষেত্রেই নারীরা ছিলেন শান্তির অগ্রসেনানী। গ্রামীণ নারী থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে কাজ করা শান্তিকর্মী পর্যন্ত, তারা সমাজে শান্তি, সহমর্মিতা এবং সহনশীলতার বীজ বপন করে চলেছেন।
তবে এখনও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সামরিক ব্যয় যেখানে বেড়েই চলেছে, সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বরাদ্দ ও নারী নেতৃত্ব এখনো যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয় না। এই দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—নারীদের কণ্ঠ শুনুন, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ দিন এবং অস্ত্র নয়, শান্তির পথে হেঁটেই এগিয়ে চলুন।
নারীরা কখনো যুদ্ধ চায় না। তারা চায় ঘরে আলো, মাঠে ফসল, সন্তানদের হাসি। তবু ইতিহাস সাক্ষী, যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে সবচেয়ে বেশি কাঁদে নারী হৃদয়ই। ঠিক সেই জায়গা থেকেই এই দিবসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—নারী শুধু যুদ্ধের শিকার নয়, সে হতে পারে শান্তির পথপ্রদর্শক।
অনেক সময়, শান্তির কথাগুলো খুব নরম হয়ে যায়। হয়তো তাই তার কথা শোনা যায় না। কিন্তু যারা দিনশেষে যুদ্ধের ধুলো ঝেড়ে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে, তারা জানে—শান্তি মানে কেবল যুদ্ধবিরতি নয়, শান্তি মানে মানুষের নিরাপদ বেঁচে থাকা। শান্তি মানে, প্রতিটি মানুষকে সম্মান দিয়ে দেখা।
এই দিনে আমরা নারীদের সেই প্রচেষ্টাকে স্মরণ করি—যারা মুখে না বললেও, নিজেদের কাজের মাধ্যমে বদলে দিয়েছেন সমাজ, দেশ, এমনকি গোটা দুনিয়াকে।
কেউ হয়তো মাঠে কাজ করা কৃষাণী, কেউবা যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার একজন স্বাস্থ্যকর্মী। কিন্তু তাদের শান্তির জন্য সংগ্রাম সবসময়ই অব্যক্ত, অথচ অদম্য।
আমরা যদি সত্যিই চাই শান্তিপূর্ণ পৃথিবী, তবে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নারীদের অংশগ্রহণকে শুধু স্বীকৃতি নয়, অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাদের কণ্ঠে যে শান্তির গান, তা যেন দমিয়ে না যায় অস্ত্রের শব্দে।
লেখক: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা ডটনেট