কুরবানি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর অন্যতম দিক হলো, কুরবানিকৃত পশুর গোশত সঠিকভাবে, ভারসাম্যের সঙ্গে বণ্টন করা। কুরআন ও হাদিসে এ বিষয়ে যেমন সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, তেমনি সাহাবায়ে কেরাম ও ইসলামি চিন্তাবিদদের জীবনাচরণেও এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
কুরআন ও হাদিসের দিকনির্দেশনা
আল্লাহ তাআলা বলেন – ‘তোমরা তা থেকে খাও এবং সেই অভাবগ্রস্তকে খাওয়াও, যে কিছু চায় না; এবং তাকেও খাওয়াও, যে সাহায্য চায়।’ (সূরা হজ্জ: ৩৬)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তা থেকে আহার করো এবং দুঃস্থ, অভাবগ্রস্তকে খাওয়াও।’ (সূরা হজ্জ: ২৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা নিজেরা খাও, অন্যকে খাওয়াও এবং সংরক্ষণ কর।’ (সহিহ বুখারি: ৫৫৬৯)
এই নির্দেশনাগুলো থেকে বোঝা যায়, কুরবানির মাংস বণ্টনের উত্তম পন্থা হলো, একাংশ নিজে খাওয়া, একাংশ আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের উপহার দেওয়া এবং একাংশ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা।
সুন্নাহভিত্তিক উত্তম পন্থা
ইসলামি ফিকাহবিদ ও সাহাবায়ে কেরাম বর্ণিত রেওয়ায়েতে দেখা যায়, কুরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করা মুস্তাহাব (উত্তম)। যথা –
১. এক ভাগ- নিজের পরিবারের জন্য
২. এক ভাগ- আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের জন্য
৩. এক ভাগ- গরিব ও মিসকিনদের জন্য
তবে এই তিন ভাগের পরিমাণ নির্ধারিত নয়। এটি একটি সুন্নাহসম্মত উত্তম দৃষ্টান্ত। কেউ চাইলে পুরো মাংস দান করতেও পারেন। আবার পারিবারিক প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের জন্য বেশি রাখাও বৈধ।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘কুরবানির দিন পশু যবেহ করো; এক ভাগ নিজে খাও, এক ভাগ মিসকিনদের দাও এবং এক ভাগ ভাইয়ের ঘরে পাঠাও।’ (আস-সুনানুল কুবরা, বাইহাকি)
দরিদ্র আত্মীয়দের অগ্রাধিকার
বর্তমান সময়কার স্কলার শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, কুরবানির মাংস বণ্টনে দরিদ্র আত্মীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। যদি আত্মীয়দের মাঝে কেউ অভাবগ্রস্ত থাকেন, তবে তারা এ মাংস পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি হকদার। আত্মীয়দের প্রয়োজন পূরণের পর বন্ধু ও অন্যান্য পরিচিতজনদের দেওয়া উত্তম।
যদি কোনো ব্যক্তি নিজেই অভাবগ্রস্ত হন, তবে তিনি গোটা মাংস নিজের পরিবারের জন্য রেখে দিতে পারেন। ইসলামে এর অনুমতি রয়েছে।
তাকওয়ার সঙ্গে ইবাদতের পূর্ণতা
কুরবানি একটি ইবাদত। এটি লোক দেখানো বা কেবল উৎসব উদ্যাপনের উপলক্ষ হিসেবে পালন করা অনুচিত। বরং এতে থাকতে হবে খাঁটি নিয়ত ও তাকওয়ার ছাপ। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, বরং তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে।’ (সূরা হজ্জ: ৩৭)
তাই যারা কুরবানি করেও গোটা মাংস ফ্রিজে তুলে রাখেন, দরিদ্র আত্মীয় কিংবা আশপাশের মিসকিনদের কিছুই দেন না, তারা মূলত আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত হন।
কিছু বিধি ও সতর্কতা
• কুরবানির পশুর গোশত, চামড়া, চর্বি বা কোনো অংশ বিক্রি করা বৈধ নয়।
• কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে কুরবানির মাংস দেওয়া জায়েয নয়। হাদিসে এসেছে, ‘তাকে প্রস্তুত করণে তার থেকে কিছু দেওয়া যাবে না।’ (সহিহ বুখারি: ১৭১৬; সহিহ মুসলিম: ১৩১৭)
• তবে কসাইকে দান বা উপহার হিসেবে মাংস দেওয়া বৈধ।
অমুসলিম দরিদ্রদের মাংস প্রদান
বিশেষ ক্ষেত্রে কুরবানির মাংস অমুসলিম দরিদ্রদেরও দেওয়া যায়, যদি তা ইসলামের প্রতি অনুরাগ ও সহানুভূতি সৃষ্টি করে। এটি ইসলামের মহানুভবতা ও উদারনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। (মুগনী, ১৩/৩৮১; ফাতহুল বারি, ১০/৪৪২)
কুরবানির মাংস একা খাওয়াও বৈধ, তবে উত্তম পন্থা হলো তা তিন ভাগে ভাগ করে দরিদ্রদের হক আদায় করা। এর মাধ্যমে সমাজে সহানুভূতি, আত্মীয়তার বন্ধন এবং তাকওয়ার চর্চা প্রতিষ্ঠা পায়। কুরবানি যেন হয় ইখলাস ও তাকওয়ার ভিত্তিতে, এটাই হওয়া উচিত প্রত্যেক মুসলমানের চেতনা ও অভিপ্রায়।
তথ্যসূত্র_
• কুরআন মাজিদ: সূরা হজ্জ (২৮, ৩৬, ৩৭)
• সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম
• আস-সুনানুল কুবরা (বাইহাকি)
• ফাতহুল বারি, মুগনী
• শায়খ আহমাদুল্লাহর বয়ান
লেখক: শিক্ষার্থী, বোরহানউদ্দিন কামিল মাদরাসা