মানুষের একটি ভুল, সময় আর সাগরের ঢেউয়ের স্রোতে ভেসে এক আশ্চর্য অপরূপ সৌন্দর্যের সৃস্টি করতে পারে, তার এক উজ্জাল দৃষ্টান্ত ‘গ্লাস বিচ’। নামেই হয়তো অনেকেই বুঝতে পেরেছেন বলছি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার ফোর্ট ব্র্যাগের গ্লাস বিচ বা কাঁচের সৈকতের কথা। যে সমুদ্রের পারে বালুর পরিবর্তে রয়েছে অসংখ্য কাঁচের তৈরী পাথর।
আজ জানবো পৃথিবীর এক অনন্য সৌন্দর্য গ্লাস বিচ বা কাঁচের সৈকতের কথা …
অবস্থান _
গ্লাস বিচ বা কাঁচের সৈকতের অবস্থান আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার ফোর্ট ব্র্যাগের কাছের ম্যাক্যারিচার স্টেট পার্কে। ক্যালিফোর্নিয়ার পরিচিত ও বিখ্যাত শহরগুলোর একটি সান ফ্রান্সিসকো, সেখান থেকে প্রায় ঘণ্টা চারেক লাগে কাচের সৈকতে পৌঁছাতে। সান ফ্রান্সিসকো থেকে তিন ঘণ্টার দূরত্বে এই সমুদ্র সৈকত অবস্থিত। কাঁচের পার্কটি ম্যাককেরিচের রাজ্য পার্কের একটি অংশ।
এ সৈকতের ইতিকথা _
৯৪৯-৫০ সালের দিকে এ সৈকতের আশপাশের এলাকা ছিল মানুষের আবর্জনা ফেলার জায়গা। ফোর্ট ব্রাগের বাসিন্দারা তাদের নিত্য ব্যবহার্য বাতিল জিনিস এই সৈকতে ফেলা শুরু করে। বাতিল মালের বেশির ভাগই ছিলো অপ্রয়োজনীয় কাঁচের টুকরো ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। কিছুদিন পর বাতিল মাল খুব বেশি পরিমাণে জমে গেলে দাহ্য বাতিল মালগুলো পুড়িয়ে ফেলা হতো।
১৯৬০-র দশকের গোড়ার দিকে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখানে জঞ্জাল ফেলা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু হয়। সর্বপ্রথম বিষক্রিয়াজনিত আবর্জনা সরানোর উদ্দ্যেগ নেয়া হয়। সেখানে আবর্জনা ফেলতে নিষেধ করা হয়।
১৯৬৭ সালে নর্থ কোস্ট ওয়াটার কোয়ালিটি বোর্ড অর্থাৎ এই উপকূলের পানির দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাদের দায়িত্ব, তারা বুঝতে পারে কত বড় একটা ভুল হয়ে আসছে এত বছর ধরে। জায়গাটিতে এ ধরনের জঞ্জাল ফেলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৯৮ সালে গ্লাস বিচ জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এর আগে অবশ্য পাঁচ বছরব্যাপী এক বিরাট সংস্কারকর্ম চালানো হয় বিচে।
২০০২ সালে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট পার্ক কর্তৃপক্ষ ৩৮ একরের কাচের সৈকত এলাকাটি কিনে নেয়। প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়ে একে ম্যাককেরিচার স্টেট পার্কের অন্তর্ভুক্ত করে। তারপর থেকে কাঁচের সৈকত হয়ে ওঠে পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য।
কাঁচের বিচের আসল রহস্য _
একসময় দূষণের প্রতীক হিসেবে পরিচিত এই উপসাগর, আজ ‘গ্লাস বিচ’ (Glass Beach) নামে বিশ্ববিখ্যাত একটি পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু কেন বা কিভাবে হলো এই কাঁচের বিচ।
আগের দিনে প্রতিটি পরিবার তাদের জিনিসপত্র পুনর্ব্যাবহার করত। যখন মানুষ তাদের আবর্জনা কোথায় জমা করতে পারেন, কিভাবে এগুলোর ব্যাবহার করবেন এসবের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যার ফলে পরিবেশ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হত। বছরের পর বছর বায়ুমণ্ডলের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু এসব আবর্জনার স্তূপ জমা হয়ে, এতো সুন্দর কিছু হতে পারে, তা কেও কোনদিন কল্পনাও করে নি।
ফোর্ট ব্রাগের বাসিন্দাদের ফেলা সে জঞ্জাল বছরের পর বছর ধরে সাগরের ঢেউ ধুয়ে-মুছে নিয়ে যায়। তারপর এক সময় জলের তোড়ে এগুলো আবার ফিরে আসে, তবে চেহারা একেবারেই বদলে। সমুদ্রের প্রবল ঢেউ ভাঙা কাঁচ ও চীনামাটির টুকরোগুলিকে ক্ষয় করে মসৃণ, ছোট ছোট রঙিন নুড়ি-পাথরে পরিণত করেছে। লাল, সবুজ, নীল, সাদা এবং বাদামি রঙের কাঁচের টুকরোগুলি সূর্যের আলো পড়লে ঝলমল করে, যা সৈকতকে রূপকথার জগতের মতো সৌন্দর্য ফুটে উঠে। যেগুলোকে দেখে রত্নপাথর বলেই মনে হয়।
আর জ্বলজ্বলে এই কাঁচগুলোই এখন দেখতে পান পর্যটকেরা। বিশেষ করে সূর্যের আলো পড়ে যখন জ্বলজ্বল করে ওঠে তখন মনে হতে পারে গুপ্তধনের কোনো রাজ্য আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
প্রকৃতির এক অনন্য শিক্ষা _
গ্লাস বিচ শুধু সৌন্দর্যের জন্যই বিখ্যাত নয়, এটি আমাদের মানুষের জন্য পরিবেশগত বিশাল এক শিক্ষা। এটি দেখায় কীভাবে প্রকৃতি মানবসৃষ্ট দূষণকেও রূপান্তরিত করতে পারে। বিশ্বজুড়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক অনুপ্রেরণা। গ্লাস বিচ আমাদের শেখায় যে পরিবেশ রক্ষা করা এবং প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
ভ্রমণকারীদের জন্য সতর্কবার্তা _
বছরজুড়ে যে কোনো সময়ই সেখানে যেতে পারেন। তবে পর্যটকের ভিড়-বাট্টা বেশি থাকে জুন, জুলাই আর আগস্টে। সৈকতজুড়ে বিছিয়ে থাকা রং-বেরঙের কাচ দেখার পাশাপাশি প্রশান্ত মহাসাগরের অসাধারণ দৃশ্য উপভোগেরও সুযোগ মেলে। চাইলে কোনো একটি ট্রেইল ধরে হাঁটতেও পারবেন বেশ খানিকটা সময়। কাচের সৈকতে গেলে সি গ্লাস মিউজিয়ামটাও দেখতে ভুলবেন না।
তবে সৈকতের এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলেও সৈকতের কাঁচ পকেটভর্তি করে নিয়ে আসার ভুল কখনোই করবেন না। কারণ ধরা পড়লে গুনতে হবে মোটা অঙ্কের জরিমানা!
ঠিক একইরকম সৈকত ক্যালিফোর্নিয়ার বেনিসিয়া ও হাওয়াই-এর হানাপেপে-তেও রয়েছে।