পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষার্থী ছদ্দ নাম ছন্দা (নাম-পরিচয় ও সময় প্রকাশে অনুচ্ছুক) সারাবাংলাকে তিনি জানান, পরীক্ষায় ফেল করার যে গ্লানি, সাথে বন্ধুদের ভালো রেজাল্ট, টিচারদের আর পরিবারের কথা শুনে সংকিছু মিলিয়ে পরীক্ষার ফলাফলের দিনই বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া টাই ভালো মনে করেছিলেন। বেছে নিয়েছেন মায়ের ঘুমের ওষুধের এক বোতলের সব কয়টি ওষুধ। কিন্তু উপরওয়ালা সহায় থাকায় তিনি সেদিন সবার মাঝে ফিরে এসেছিলেন। তার সেই ফিরে আসা, সাথে সবার অনুপ্রেরণায় পরেরবারের পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করেন।
কিন্তু সবাই তার মতো ভাগ্যবান হয় না। কারণ প্রতিবছর পরীক্ষার ফলাফলের দিন অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। যা আশংকাজনকভাবে বাড়ছে।
পরিসংখ্যান কী বলছে:
পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর ২০২৪ সালে ফল প্রকাশের প্রথম ছয় ঘণ্টার মধ্যে শতাধিক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা করে, মারা যায় নয়জন। এদের মধ্যে ছয়জন মেয়ে। তার আগের বছর প্রথম ছয় ঘণ্টায় মারা যায় চারজন মেয়েসহ মোট ছয়জন।
এছাড়া, প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে আরও কয়েকগুণ বেশি শিক্ষার্থী! অনেক আত্মহত্যার খবর পত্রিকায় আসেও না!
সুইসাইড অ্যাওয়ারনেস ভয়েসেস অব এডুকেশন (SAVE) তাদের সংগৃহীত প্রমাণের ভিত্তিতে জানিয়েছে, আত্মহত্যার চেষ্টাকারী প্রতি ২৫ জনের মধ্যে মাত্র একজন সফল হয়। যখন এটি রিপোর্ট করা হয় তখন আমরা কেবল এটুকুই জানি। আমরা ২৪ জন বেঁচে যাওয়া ব্যক্তির সম্পর্কে জানি না। যদি তাদের চিকিৎসা না করা হয় বা মানসিক-সামাজিক সহায়তা না দেওয়া হয়, তা হলে তারা আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে। কেউ ফল ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কেউ একদিন অপেক্ষা করে, কেউ দুই দিন। তাদের মধ্যে কেউ ১৫, কেউ ১৬, কেউ ১৭ বছর বয়সী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, দ্বিতীয়বার আত্মহত্যার চেষ্টাকারী ব্যক্তিদের মধ্যে সাফল্যের হার অনেক বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
লেখক ও গবেষক গওহর নঈম ওয়ারা সারাবাংলাকে বলেন, যখন কোনো ছাত্র প্রত্যাশিত নম্বর পেতে ব্যর্থ হয়, তখন বেশির ভাগ সময় অভিভাবকরা এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ান না। অভিভাবকরা যদি একটু চেষ্টা করেন এবং তাদের সন্তানদের পাশে দাঁড়ান, তা হলে অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব।
পরিবারের পক্ষ থেকে মিষ্টি বিতরণের পাশাপাশি অনেকে তাদের সন্তানের ‘কৃতিত্ব এবং আনন্দের’ এই খবরটি সোশ্যাল মিডিয়ায় অতি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে একটার পর একটা পোস্ট করতে থাকে। তাদের সোশ্যাল মিডিয়ার দেয়ালগুলো অতি অভিনন্দন এবং দীর্ঘ শুভেচ্ছা বাণীতে উপচে পড়ে। ফেইসবুকের পোস্টার নানা বিতর্ক আর মিষ্টি বিতরণের মাঝে পরীক্ষায় ‘ভালো’ করতে না পারা শিক্ষার্থীদের জীবন একে একে ঝরতে থাকে।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা রোধে সুপারিশ:
শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা দিতে কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন তিনি। ফল ঘোষণার দিন বাবা-মা বা অভিভাবকদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকা উচিত, তাদের সঙ্গে সময় কাটানো উচিত এবং তাদের মানসিক সাহস ও আশ্বাস দেওয়া উচিত। ফলাফল প্রত্যাশা অনুযায়ী না হলে কোনো অবস্থায়ই শিশুকে তিরস্কার করা, অপমান করা বা অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়। ভবিষ্যতের জন্য শিশুর পাশে থাকার বার্তা দিন, সাহস জোগান এবং আশাবাদী মনোভাব গড়ে তুলুন।
আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীদের আচরণ ব্যঙ্গাত্মক বা অপমানজনক হওয়া উচিত নয় বলে অভিভাবকদের সচেতন করুন। ফল ভালো হলে অতিরিক্ত আনন্দ প্রকাশ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট না করা।
সেসঙ্গে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, পরীক্ষার এই প্রতিযোগিতা থেকে এই কিশোর কিশোরীদের রক্ষায় ফেসবুক বন্ধ করে দেয়া উচিত। সেসঙ্গে পরীক্ষার পদ্ধতির পরিবর্তন চান তিনি। বলেন, এ লেভেল বা ও লেভেলের মতো পদ্ধতি রাখা উচিত। সেসঙ্গে প্রয়োজন মানসিকভাবে শক্তিশালীভাবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা আর প্রয়োজন জোরালো মনিটরিং। স্কুল শিক্ষকরাই এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এজন্য আলাদা করে মনোবিজ্জানী স্কুলে রাখার প্রয়োজন নেই। বলেন, একজন শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে একজন শিক্ষকই পারে শক্তিশালীভাবে গড়ে তুলতে।
সর্বোপরি বাবা-মাকে পেরেন্টিংয়ের উপর যোগ দেন এই বিশেষজ্ঞ।
এ বিষয়ে সাইকোলজিস্ট আদ্রিতা খান অন্তরা সারাবাংলাকে বলেন, এসএসসির ফল ঘোষণার দিনটি একজন কিশোরের জীবনের একটি বিশেষ দিন। তাই এই দিনে বাবা-মায়ের পাশে থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সবাই কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
এ সময় শিক্ষার্থীদের সাথে অনেক অভিভাবক এই মহাউল্লাসে ফেটে পড়েন! পাশাপাশি ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এসব কাণ্ডকারখানা দেখে যতটা না মেনে নেওয়ার কথা তার চেয়ে বেশিমাত্রায় হতাশা ও বিষন্নতায় ডুবে যান একজন অকৃতকার্য শিক্ষার্থী। অকৃতকার্য শিক্ষার্থী নিকটজনের কাছ থেকে কটূক্তি, গালমন্দ ও পাশে না থাকার মতো চিত্র দেখতে পান। হতাশা ও গ্লানি ধারণ করে অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত বেছে নেয়!
তাই এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্যদের সবচেয়ে আগে প্ৰয়োজন পরিবারের মেন্টাল সাপোর্ট। তাহলে তারা আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়া থেকে সরে আসবে।
সেসঙ্গে তিনি পরীক্ষায় অকৃতকার্যদের জন্য স্কুলগুলোতে মেন্টাল সাপোর্ট টিম গঠন করার কথাও বলেন।
পরিশেষে _
বয়:সন্ধিকালের এই সময় কিশোর কিশোরীদের প্রতিনিয়ত পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় ছেড়ে দেয়ার ফলে তাদের মধ্যে হতাশা অবসাদের মতো জটিল মানসিক টানাপোড়েন শুরু হয়। এ অবস্থায় তাদের শুধু পাঠ্যবইয়ের চাপে না রেখে সৃজনশীল কাজের প্রতি উৎসাহিত করার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞরা। সেসঙ্গে ভালো ফল দিয়ে নয় বরং মানবিকতার চর্চার আহ্বান জানান তারা। জানান, পরীক্ষার্থীদের আত্মহত্যা থেকে রক্ষায় সম্মিলিত পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নাই।