সকালটা ছিল একেবারেই স্বাভাবিক।
বাবা-মায়ের আদরের সোনামণি স্কুলের পোশাক পরে আয়নায় হাসছিল। মা তার জন্য চুলে রিবন বেঁধে দিচ্ছিলেন, বাবা রিকশার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। বইয়ের ব্যাগ পিঠে নিয়ে সে বেরিয়ে গিয়েছিল স্কুলের পথে। প্রতিদিনের মতোই, ঠিক সময়েই পৌঁছে গিয়েছিল ক্লাসরুমে।
কিন্তু কে জানতো, এই সকালটাই হবে তার জীবনের শেষ সকাল?
কে জানতো, তার স্কুল ভবনের ওপর মৃত্যু নামক ছায়া এমন করে ভর করবে?
রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুলে আজ ঘটলো এক ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা। আকাশ থেকে ভেঙে পড়লো একটি ছোট বিমান—মাইলস্টোন স্কুলের ছাদের উপর। মুহূর্তেই মৃত্যু নেমে এলো নিরপরাধ ছোট ছোট শিশুদের উপর। ঘরে ফেলে আসা আদর-ভরা সকালটা এক লাশ হয়ে ফিরে এলো পরিবারের জন্য।
কোনো কোনো শিশুর দেহ গলে গেছে ধ্বংসস্তূপের আগুনে, কারো হাত নেই, কারো চোখ। একটি শিশুকে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না—সে ছিল সকালে মা’র কোলে বসে থাকা আদরের রত্ন, এখন হয়ে গেছে বেওয়ারিশ দেহ!
একটা মেয়ে—বয়স বড়জোর আট—বেডে শুয়ে হুঁশে আসলে শুধু বলছিল, ‘আম্মু, আমি বাঁচবো তো?’ তার মা পাশে দাঁড়িয়ে শুধু কাঁদছেন—চোখের পানি শেষ হয়ে গেছে, কান্নার শব্দ আটকে গেছে গলায়।
এক বাবা ছুটে এসেছেন স্কুলের সামনে। তিনি চিৎকার করে বলছেন, “আমার মেয়েটার হাত আমি আজ সকালে ধরেছিলাম, ও তো কিছুক্ষণ আগেই হেসে বলেছিল, ‘বাবা, আজ আমার প্রেজেন্টেশন আছে’। এখন? এখন আমি কি জবাব দেব ওর অপেক্ষায় থাকা ছোট ভাইটাকে?”
আজ যে মা তার সন্তানের জন্য রান্না করেছিলেন, লাঞ্চবক্সে ভরে দিয়েছিলেন পছন্দের খাবার, তিনি এখন হাসপাতালের করিডরে ছুটে বেড়াচ্ছেন সন্তানের নিথর মুখটা একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য। আজ সেই লাঞ্চবক্স শুধু একটি অসমাপ্ত গল্প।
এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটা একটি জীবন থামিয়ে দেওয়া ভয়াবহতা।
প্রশ্ন উঠছে—কেন স্কুলের উপর দিয়ে উড়ছিল বিমান?
কোথায় সেই নিরাপত্তা, যেখানে শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার কথা?
এই ক্ষত শুধু রক্তের নয়, এটা আস্থা ও আশার ক্ষত। শত শত বাবা-মা আজ বুঝতে পারছেন না, আগামীকালও কি তারা নিশ্চিত থাকতে পারবেন—তাদের সন্তান স্কুল থেকে ফেরত আসবে?
এই সমাজ, এই রাষ্ট্রের কাছে এ প্রশ্ন জ্বলন্ত আগুন হয়ে রইলো:
সন্তানকে স্কুলে পাঠানো কি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া?
এই কান্নার উত্তর কে দেবে?
এই হারানোর ক্ষতিপূরণ কোথায়?
একটি শিশু মানেই তো একটি ভবিষ্যৎ।
সেই ভবিষ্যৎগুলো আজ ভস্ম হয়ে গেছে মাইলস্টোন স্কুলের ছাদে।
লেখক: সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা ডটনেট