সকালটা ছিল আগস্টের, ঢাকায় তখন বর্ষার পরশ। ভোরের বাতাসে আর্দ্রতা, আকাশে হালকা মেঘের ভিড়। অফিসার্স ক্লাবের সুইমিংপুলে সেদিনও তার প্রিয় সকালবেলার সাঁতার চলছিল। পানির ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসি ভেসে বেড়াচ্ছিল চারপাশে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরই—সবকিছু থমকে যায়। অধ্যাপক মাহফুজা খানম নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকুও যেন পাননি। সেদিন, ১২ আগস্ট ২০২৫, সকালেই তিনি চলে গেলেন— আমাদের জীবনের আকাশে এক বিশাল শূন্যতা রেখে।
তাকে চেনা মানুষরা বলেন— ‘মাহফুজা আপা ছিলেন আলোর মতো।’ আর আলো যেমন অন্ধকারকে তাড়ায়, তিনিও তেমনই ছিলেন সমাজের অসাম্য, অবিচার আর অশিক্ষার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নাম।
শৈশব থেকে স্বপ্নের বীজ
১৯৪৬ সালের ১৪ এপ্রিল, কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম মাহফুজা খানমের। তখনো দেশভাগ হয়নি। শৈশব কেটেছে পরিবারে শিক্ষার অনুপ্রেরণা ও মানবিক মূল্যবোধের মধ্যে। ছোটবেলা থেকেই গণিত আর বিজ্ঞান ছিল তার প্রিয়, আর বই ছিল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরিবারে অনেকেই অবাক হতেন—’মেয়ে হয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়বে?’ কিন্তু মাহফুজা হাসতেন—’জ্ঞান তো ছেলে-মেয়ের পার্থক্য মানে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম আলো
১৯৬৩ সালে তিনি ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। সেসময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল কেন্দ্র, আর মহিলা শিক্ষার্থীর সংখ্যা তখন ছিল হাতে গোনা। কিন্তু মাহফুজা খানম কখনো পিছিয়ে যাননি।
১৯৬৬ সালে স্নাতক শেষ করে পরের বছর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই সময়েই ঘটে যায় এক ঐতিহাসিক ঘটনা—তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নারী ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবার কোনো নারী এই পদে বসেন। ১৯৬৬-৬৭ মেয়াদে তার এই অর্জন কেবল ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, নারীর রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে থাকে।
একটি হারানো সুযোগ, এবং নতুন পথ
১৯৬৮ সালে লন্ডনের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তখনকার শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সংকীর্ণতা তার স্বপ্নের পথে দেয়াল তুলে দেয়—পাসপোর্ট দেওয়া হয় না।
‘আমার স্বপ্ন কেড়ে নেওয়া হয়েছে,’—তার এই কথায় ছিল তীব্র বেদনা। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েননি। ঠিক করলেন—যে সুযোগ তিনি পাননি, সেটি যেন অন্য কেউ না হারায়। এভাবেই শুরু হয় তার আজীবন সংগ্রাম—সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার।
শিক্ষক, অভিভাবক, পথপ্রদর্শক
দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে সরকারি কলেজে পদার্থবিজ্ঞান পড়িয়েছেন তিনি। কিন্তু তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না—তিনি ছিলেন একজন অভিভাবক। আর্থিক কষ্টে থাকা অসংখ্য শিক্ষার্থীর পড়ালেখার খরচ বহন করেছেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রায় ১৭টি শিক্ষা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেছেন।
ছাত্রীরা যখন দোটানায় পড়ত—উচ্চশিক্ষা নেবে নাকি বিয়ে করবে—তিনি বলতেন, ‘শিক্ষা তোমার অধিকার, তা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না।’
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মঞ্চে আলো
শিক্ষাক্ষেত্রের পাশাপাশি তিনি ছিলেন সক্রিয় সাংস্কৃতিক কর্মী। খেলাঘর আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে শিশুদের সৃজনশীল বিকাশে কাজ করেছেন। এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তিনি ছিলেন অগ্রভাগে—শুধু সমর্থক নন, সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। নারী যোদ্ধা হিসেবে তার সাহসের গল্প এখনো অনুপ্রেরণা জোগায়।
স্বীকৃতি, কিন্তু বিনয়ের আবরণে
বেগম রোকেয়া পদক (২০১২), অনন্যা শীর্ষ দশ (২০১৩), জয়া আলোকিত নারী (২০১৭), একুশে পদক (২০২১)—অর্জনের তালিকা লম্বা। কিন্তু মাহফুজা আপা কখনো পুরস্কার নিয়ে গর্ব করতেন না। বলতেন, ‘এগুলো কেবল আমাকে মনে করিয়ে দেয়—আমার দায়িত্ব এখনো শেষ হয়নি।’
শেষ দেখা
তাকে শেষবার যারা দেখেছেন, তারা বলেন—সেদিনও তিনি হাসছিলেন। সাঁতার শেষে খেলাঘরের এক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্য যেন অন্য গল্প লিখে রেখেছিল।
তার চলে যাওয়ার পর অনেকেই বলেছে—’মাহফুজা আপা চলে গেছেন মানে যেন আমাদের নৈতিক দিশারি হারিয়ে গেল।’
যে আলো নিভে যায় না
মাহফুজা খানম চলে গেছেন, কিন্তু তার দেখানো পথ এখনো জ্বলজ্বল করছে—মেয়েদের শিক্ষা, সামাজিক সমতা, ন্যায়ের জন্য অবিচল সংগ্রামের পথ।
যখনই কোনো মেয়ে প্রথমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট পেরোয়, কিংবা কোনো শিক্ষার্থী আর্থিক সাহায্য পেয়ে নতুন জীবন শুরু করে—সেই মুহূর্তে কোথাও না কোথাও মাহফুজা আপার স্বপ্ন বেঁচে থাকে।
এই গল্প শেষ হয় না, কারণ যে মানুষের জীবনকে ঘিরে লেখা—তিনি নিজেই ছিলেন অসংখ্য গল্পের জন্মদাত্রী। শুধু নাম মনে রাখলেই হবে না, তার কাজকে বাঁচিয়ে রাখাই হবে প্রকৃত শ্রদ্ধা।