Monday 18 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এক রাতেই নির্মিত হওয়া জ্বীনের মসজিদের রহস্য

ফারহানা নীলা
১৮ আগস্ট ২০২৫ ১৫:২৪

জনপ্রিয় নাম ‘জ্বীনের মসজিদ’। এই নামেই পরিচিত। তবে এই মসজিদের আসল প্রদত্ত নাম বালিয়া মসজিদ। যা ঠাকুরগাঁও জেলায় অবস্থিত।

জ্বীন-পরীরা কিভাবে তৈরি করলো মসজিদটি _

জনশ্রুতি বলে, বহু বছর আগে, এক অলৌকিক শক্তির প্রভাবে এক রাতের মধ্যেই মসজিদটি দাঁড়িয়ে যায়। কারা বানাল, কীভাবে বানাল— তার সঠিক প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় নেই। লোকমুখে প্রচলিত আছে, এক অমাবস্যার রাতে ‘জ্বীন-পরীরা’ এই মসজিদ তৈরি করে — সারারাত কাজ করে ভোরে শেষ আলো দেখে চলে যায়, তাই গম্বুজ কখনোই তৈরি হয়নি। সেই সঙ্গে দেখে চলে যায় কারুকার্যময় দেয়াল, অলংকরণ ও পুরু ইটের স্থাপনা— অপূর্ন থেকে যায় গম্বুজ, আর রয়ে যায় রহস্যের আবরণ।তবে স্থাপত্য বিশ্লেষণে বোঝা যায়, এটি মুঘল স্থাপত্যশৈলীর প্রভাবিত, যেখানে ছোট ছোট গম্বুজ, খিলান ও কারুকাজ মুগ্ধ করে।

বিজ্ঞাপন

সত্যতা কী?

মসজিদের দেয়ালে খোদাই করা আছে নির্মাণসন: ১৩১৭ বঙ্গাব্দ, অর্থাৎ ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ। উনবিংশ শতাব্দী শেষভাগে জমিদার মেহের বকস চৌধুরী এর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চালিয়ে বলেন, স্থপতিত্বে ছিলেন আগ্রা-মুর্শিদাবাদের স্থপতি, কিন্তু প্রধান স্থপতির অকাল মৃত্যু ও স্থানীয় কারিগরদের গম্বুজ তৈরির ব্যর্থতা মসজিদকে গম্বুজবিহীনই রাখে। মেহের বকস চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার ভাই উদ্যোগ নিলেও তিনি কাজ শেষ না করে মৃত্যুবরণ করেন, ফলে গম্বুজবিহীন অবস্থাই প্রায় ১০০ বছর এই মসজিদকে ছায়া দেয়।

স্থাপত্যের এক দৃষ্টান্ত _

নকশা ও নির্মাণশৈলী:

মসজিদ মূলত স্ট্যান্ডিং প্ল্যাটফর্মের ওপর অবস্থান করে, উচ্চতা: প্ল্যাটফর্ম থেকে মসজিদের ছাদ পর্যন্ত প্রায় ১৭ ফুট।

আয়তন: পূর্ব–পশ্চিম ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি, উত্তর–দক্ষিণ ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি। মূল নামাজঘরের প্রস্থ: ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি।

গম্বুজ ও মিনার:

তিনটি সমান আকৃতির গম্বুজ আছেও—আসলে পুনঃনির্মাণে নির্মিত, কারণ দীর্ঘকাল সেটি ছিল অনুপস্থিত।

মোট আটটি মিনার: কোণে চারটি বড়, মাঝখানে চারটি ছোট।

অলংকরণ ও কারুকাজ:

চুন-সুরকির মর্টার এবং হাতে পোড়া ইট ব্যবহার হয়েছে। দেয়ালে কাটা অলংকরণে কলস, ঘণ্টা, বাটি, পদ্ম, আমলকি ইত্যাদি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে— কোনো আস্তরণ বা আবরণ নেই।

বিশেষ ফটক:

মসজিদের প্রধান প্রবেশদ্বারটি বিশাল—দৈর্ঘ্য ২১ ফুট, প্রস্থ ৯ ফুট। এটি এই অঞ্চলের অন্য কোনও মসজিদে দেখা যায় না; তাই বিশেষ।

সংস্কারে প্রারম্ভ ও পুনরুদ্ধার _

পুনরুদ্ধারের সুর:

২০০৫ সালে বালিয়া মসজিদ পরিত্যক্ত থেকে প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউট ও স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকদের উদ্যোগে সংস্কার কাজ শুরু হয়।

গম্বুজের পুনঃনির্মাণ:

প্রদত্ত নির্দেশনায় আর্কিটেক্ট সৈয়দ আবু সুফিয়ান কুশল নকশা ও কামরুজ্জামান স্বাধীন ও জাকিরুল হক চৌধুরী তত্ত্বাবধানে নতুন করে গম্বুজ নির্মিত হয়।

জোনে উন্মুক্ত:

২০১০ সালে সংস্কারের কাজ শেষ হয়ে এটি নামাজের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

কেন প্রাসঙ্গিক— মানব, ইতিহাস ও রহস্যের সংযোগ _

বালিয়া মসজিদ শুধুই একটি পূর্ণাঙ্গ মসজিদ নয়; এটি ইতিহাস, তত্ত্ব, লোককথা আর স্থাপত্যশিল্পের মিলনস্থল।

এটি যেখানে মুঘল স্থাপত্য, স্থানীয় কারুশিল্প ও অলংকরণের সংমিশ্রণ ঘটেছে;
যেখানে মানুষের স্থাপত্য বোধ ও ধর্মীয় মানসিকতার সঙ্গে রহস্যের স্বাদ জুড়ে গেছে;
যেখানে শত বছরের অনুলীন ইতিহাস নতুন করে বেঁচে উঠেছে ২১ শতকের পুনঃনির্মাণে।

বালিয়া মসজিদ এমন এক নাম, যার চারপাশে জড়িয়ে আছে রহস্য, ইতিহাস আর লোককথার গন্ধ। স্থানীয়দের মুখে শোনা যায়, এই মসজিদটি এক রাতেই নির্মিত হয়েছিল। সেই অলৌকিক কাহিনি গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে, যেন সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া এক উপকথা। কিন্তু এর সৌন্দর্য, স্থাপত্যশৈলী আর আধ্যাত্মিক আবহে হারিয়ে যেতে হলে আপনাকে অবশ্যই একবার যেতে হবে বালিয়া মসজিদে।

বর্তমান অবস্থা _

বালিয়া মসজিদ এখনও দাঁড়িয়ে আছে সময়ের সাক্ষী হয়ে। এর গায়ে বয়সের ছাপ স্পষ্ট— শেওলা জমে সবুজ আভা, কিছু অংশে ইট ক্ষয়ে যাওয়া, তবে সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি। সবচেয়ে আনন্দের বিষয়, এখানে এখনও নামাজ আদায় করা হয়। স্থানীয় মুসল্লিরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য মসজিদে আসেন। বিশেষ করে জুমার দিনে এখানে ভিড় হয় বেশি।

দর্শনের প্রস্তুতি _

যদি আপনি বালিয়া মসজিদে যেতে চান, কিছু বিষয় মাথায় রাখুন…

পোশাক: শালীন ও পরিচ্ছন্ন পোশাক পরুন, বিশেষ করে মহিলাদের জন্য মাথা ঢাকার ব্যবস্থা রাখা ভালো।

জুতা: ভেতরে প্রবেশের আগে জুতা খুলে রাখতে হবে।

সম্মান: স্থানীয় ধর্মীয় আবেগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন, ছবি তুলতে হলে অনুমতি নিন।

সময়: নামাজের সময়ের বাইরে গেলে ভিড় কম থাকবে, তবে নামাজের সময় গেলে আধ্যাত্মিক পরিবেশ বেশি অনুভব করা যাবে।

ভ্রমণ ও শিক্ষণীয় দিক _

বালিয়া মসজিদ শুধু দর্শনীয় স্থান নয়, এটি একটি শিক্ষা। ইতিহাস হয়তো সব রহস্যের উত্তর দিতে পারে না, কিন্তু এটি মনে করিয়ে দেয়—মানুষের বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিকতার শক্তি কতটা গভীর হতে পারে। এখানে গিয়ে আপনি বুঝবেন, পুরনো স্থাপনা কেবল ইট-পাথরের গাঁথুনি নয়; এটি সময়, সংস্কৃতি আর মানুষের আত্মার স্মারক।

শেষ কথা _

বালিয়া মসজিদ ভ্রমণ আপনাকে ইতিহাসের এক টুকরো ছুঁতে দেবে, অনুভব করাবে মুঘল স্থাপত্যের ছোঁয়া, আর শেখাবে শ্রদ্ধা ও ঐতিহ্যের মূল্য। হয়তো এর অলৌকিক কাহিনির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই, কিন্তু কখনো কখনো রহস্যই ভ্রমণের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। বালিয়া মসজিদ তার নির্মাণকালীন দুর্দান্ত পরিকল্পনাকে ছাড়াও তার নকশা, অলংকরণ, গল্প আর সংস্কারের মাধ্যমে একটি জীবনবোধময় ভ্রমণ উপহার দেয়। এক রাতের জাদুর কাহিনী কবেকার লোককথা, আর নির্মাণ-উদ্যোগ ইতিহাসের মিলনে গড়েছে একটি স্মৃতির স্থাপনা, যা দেখতে এবং অনুভব করতে প্রতিটি ভ্রমণপিপাসু বা ইতিহাসপ্রেমিকে কেউই মিস করা উচিত নয়।

সারাবাংলা/এফএন/এএসজি

জ্বীনের মসজিদ ঠাকুরগাঁও বালিয়া মসজিদ